কৃষিকাজ আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে ফসল চাষ, মাছ চাষ ও গৃহপালিত পশু-পাখি পালনের উপর। আবার জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।
আমরা আজকের এই আলোচনাটিতে আবহাওয়া ও জলবায়ুর ধারণা, উপাদানসমূহ এবং কৃষিকাজে এর প্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব। পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলগুলো কী, কী? বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস প্রবণ অঞ্চলগুলো সম্পর্কেও জানব।
আলোচনাটি থেকে আমরা কৃষি কার্যক্রমে আবহাওয়া ও জলবায়ুর গুরুত্ব, আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভিত্তিতে কৃষি পরিবেশ অঞ্চল চিহ্নিত, বাংলাদেশের মানচিত্রে কম বৃষ্টি, বেশি বৃষ্টি, বন্যাপ্রবণ, জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ অঞ্চল ইত্যাদি চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করতে পারবকরতে পারব।
(১) আবহাওয়া ও জলবায়ু কাকে বলে? আবহাওয়ার উপাদানসমূহ
ক) আবহাওয়া: আমরা রেডিও ও টেলিভিশনে আবহাওয়ার খবর শুনি। এ খবর থেকে দিনের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি তথ্য জানতে পাই। আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, আকাশ কেমন থাকবে সে তথ্যও জানতে পারি। আগাম এসব তথ্যকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলে। সুতরাং কোনো স্থানের দৈনন্দিন বায়ুমণ্ডলের অবস্থাকে আবহাওয়া বলে।
আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে দেওয়া হলো-
- স্থানীয় মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
- আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তনশীল।
- মাটির গুণাবলিতে তেমন প্রভাব ফেলে না।
- কোনো কোনো অঞ্চলে ফসলের পরিচর্যায় আবহাওয়া প্রভাব বিস্তার করে।
খ) জলবায়ু: জলবায়ু পরিবর্তনের কথাটি আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। জলবায়ু সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে হয়। কোনো স্থানের ২৫-৩০ বছরের আবহাওয়ার গড়কে সেই স্থানের জলবায়ু বলে।
জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে দেওয়া হলো-
- জলবায়ু কোনো স্থানের দীর্ঘ সময়ের বায়ুমণ্ডলের গড় অবস্থা।
- জলবায়ু ধীরে পরিবর্তনশীল।
- মাটির গুণাবলিতে প্রভাব ফেলে।
- কোনো কোনো অঞ্চলে ফসলের প্রকার ও জাত নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে।
গ) এখন আমরা আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদান সমূহ:
আবহাওয়ার উপাদানসমূহ হলো-
১। বারিপাত: ৰায়ুমণ্ডল থেকে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত পানিকে বারিপাত বলে। বৃষ্টি, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, কুয়াশা, শিশির ইত্যাদি বারিপাতের অন্তর্ভুক্ত।
২। তাপমাত্রা: কোনো স্থানে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কত গরম বা ঠাণ্ডা, তাই তাপমাত্রা।
৩। বায়ুর গতি: কোনো স্থানে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বাতাস কত বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, তাই বায়ুর গতি।
৪। বায়ুর দিক: ৰাতাস কোন দিক থেকে কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, সেটাই বায়ুর দিক।
৫। বায়ুর আর্দ্রতা: বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণকে বায়ুর আর্দ্রতা বলে।
৬। বায়ুর চাপ: ভূ-পৃষ্ঠের উপর বায়ু যে বল প্রয়োগ করে, তাকে বায়ুর চাপ বলে।
৭। মেঘমালা: আকাশে মেঘের পরিমাণ।
৮। দৃষ্টিগ্রাহ্যতা: খালি চোখে যত দূর পর্যন্ত দেখা যায়, তাকে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা বলে।
৯। সূর্যালোক: দিনে কত ঘন্টা সূর্যের আলো পাওয়া যায় তার পরিমাণকে সূর্যালোক বলে।
১০। সৌরবিকিরণ: পৃথিবীতে সব শক্তির উৎস হলো সৌরশক্তি। স্থান ও ঋতু ভেদে সৌরবিকিরণ প্রাপ্তির পার্থক্যের কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুর তারতম্য হয়ে থাকে। সৌরবিকিরণ পৃথিবী পৃষ্ঠকে উষ্ণ করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া পানির বাষ্পীভবন, বায়ুর গতিশীলতা, মেঘমালা সৃষ্টি ইত্যাদি সৌরবিকিরণের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়।
১১। বায়ুপুঞ্জ: বায়ু পুঞ্জীভূত আকারে নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। বায়ুপুঞ্জের উৎস স্থানের উপরও কোনো স্থানের আবহাওয়া ও জলবায়ু নির্ভর করে।
১২। বায়ুচাপ প্রক্রিয়া: বায়ুচাপের হ্রাস-বৃদ্ধি বৃষ্টিপাতের মৌসুমকে প্রভাবিত করে। বায়ুচাপ হ্রাস পেলে সাইক্লোন, মেঘ-বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। বায়ুচাপ বাড়লে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে।
১৩। সমুদ্রস্রোত: সমুদ্রস্রোত উপকূলবর্তী অঞ্চলের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। শীতল স্রোতের উপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়ে এলে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কমে। স্রোত উষ্ণ হলে দুটোই বাড়ে।
১৪। ভূমিবন্ধুরতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কোনো স্থানের উচ্চতা ঐ স্থানের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। উচ্চতা বাড়লে তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ কমে।
(২) কৃষিকাজে আবহাওয়া ও জলবায়ুর গুরুত্ব
কৃষিকাজ আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদন আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এখন আমরা ফসল চাষ, মাছ চাষ ও গৃহপালিত পশু-পাখি পালনে আবহাওয়া ও জলবায়ুর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
ক) ফসল চাষ: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে সারা বছর নানা ধরনের ফসল জন্মে। বিভিন্ন ফসলের জন্য বিভিন্ন ধরনের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকায় এ দেশ শস্য-শ্যামলা দেশে পরিণত হয়েছে।
মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে এ দেশে প্রচুর ধান, পাট, শাকসবজি, ফলমূল জন্মে। অন্যদিকে শীতকালীন জলবায়ুর প্রভাবে নানা প্রকার ডাল, তৈলবীজ, শাকসবজি, মসলা ইত্যাদি রবি শস্য জন্মে। সুতরাং কৃষি উৎপাদনে জলবায়ুর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে দৈনন্দিন কৃষিকাজ আবহাওয়ার উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। জমি তৈরি, বীজ বপন, সার প্রয়োগ, পানিসেচ, ফসল কর্তন, রোগ ও পোকামাকড়ের বিস্তার ইত্যাদি আবহাওয়ার উপাদান দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন-বৃষ্টি হলে জমি চাষ করা যায় না, আবার রোপা আমন রোপণের জমি তৈরির জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন।
খ) মাছ চাষ: বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে নদ-নদী, খাল- বিল, পুকুর-ডোবা ইত্যাদি পানিতে ভরে যায়। এসব জলাশয়ে প্রচুর মাছ উৎপাদিত হয়। মাছের উৎপাদন ও বংশবিস্তারে মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব খুবই বেশি।
গ) গৃহপালিত পশু-পাখি: বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু-পাখি পালনের উপযোগী। পশু-পাখির খাদ্যের জন্য এদেশে বিভিন্ন ধরনের ঘাস, লতা, গুল্ম প্রচুর পরিমাণে জন্মে। বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ফলে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে।
এবার আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানব।
ক) জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের গ্রিনহাউস প্রভাব বুঝতে হবে। শীতপ্রধান দেশে দামি সবজি, ফল গ্রিনহাউস বা কাচঘরে জন্মায়। কাচঘরের তাপমাত্রা বাইরের থেকে পরম থাকে, যা ঐ সব ফসলের জন্য অনুকূল। কাচঘরে যে আলো প্রবেশ করে তা বাইরে বের হতে পারে না বরং দুর্বল হয়ে তাপ উৎপাদন করে। ফলে কাচঘর গরম থাকে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও গ্রিনহাউসের মতো অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠছে। মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এ গ্যাসগুলো তাপ শোষণ করে বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে তুলছে। একে গ্রিনহাউস প্রভাব বলে এবং এর জন্য দায়ী গ্যাসগুলোকে গ্রিন হাউস গ্যাস বলে।
উনিশ শতকের শেষভাগ হতে গ্রিনহাউস প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে আবহাওয়া ও জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এটাই জলবায়ু পরিবর্তন।
খ) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ: শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, যানবাহন, গৃহকার্যে জৈব জ্বালানি পোড়াতে হয়। ফলে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে।
অন্যদিকে বিশ্বে প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের খাদ্য, আবাসন ইত্যাদির জন্য বিপুল পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে। ফলে গাছ কর্তৃক কার্বন ডাই- অক্সাইড গ্রহণের ভারসাম্য বজায় থাকছে না।
গ) জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চল ও পর্বতের হিমবাহের বরফ গলা, মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টি, খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, বন্যার তীব্রতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি, অতি গরম, অতি ঠাণ্ডা ইত্যাদি দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
(৩) বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কেমন?
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে উচ্চতা ও দূরত্ব, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এ দেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ বা সমভাবাপন্ন। পরিমিত বৃষ্টিপাত, মধ্যম শীতকাল ও আর্দ্র গ্রীষ্মকাল বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে শীতকালে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত বায়ুতে তেমন জলীয়বাষ্প থাকে না। ফলে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না। অন্য দিকে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত মৌসুমি বায়ুতে যথেষ্ট জলীয়বাষ্প থাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তাছাড়া মার্চ-এপ্রিল মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হঠাৎ ঝড় ও ঘূর্ণিঝড় হতে দেখা যায়। এটি কালবৈশাখী ঝড় নামে পরিচিত। এ ঝড়ের সাথে প্রায়ই শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে। এছাড়া গ্রীষ্মকালে সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মাঝে মাঝে ঘূর্ণিঝড় উপকূল এলাকায় আঘাত হানে।
বাংলাদেশের জলবায়ুর কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো-
ক) তাপমাত্রা: বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা 20 সেলসিয়াস। এ দেশে শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১১° সেলসিয়াস হয়ে থাকে। জানুয়ারি শীতলতম মাস এবং গড় তাপমাত্রা ১৭.৭ সেলসিয়াস হয়ে থাকে। শীতকালে দেশের দক্ষিণভাগে উপকূলের কাছাকাছি তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং উত্তর দিকে তাপমাত্রা কম থাকে। শীতের স্থায়িত্ব ও তীব্রতার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, যথা- T1, T2, T3, T4 ও T5। তবে T1 অঞ্চলে শীতের স্থায়িত্ব ও তীব্রতা সবচেয়ে কম, পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে T, অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি হয়।
খ) বৃষ্টিপাত: বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতের যথেষ্ট তারতম্য হয়ে থাকে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১০০ মিলিমিটার থেকে ৪৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ বৃষ্টিপাতের প্রায় ৯০ শতাংশ এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে হয়ে থাকে। শীতকালে অতি সামান্য বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দেশের পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয় নাটোরের লালপুরে এবং সর্বোচ্চ সিলেটের লালাখালে।
গ) আর্দ্রতা: ঋতুভেদে এদেশে আর্দ্রতার বেশ পার্থক্য দেখা যায়। শীতকালে বায়ুতে জলীয়বাষ্প কম থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বায়ু বেশ আর্দ্র থাকে। বায়ুতে এ আর্দ্রতা বৃষ্টিপাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। শীতকালে বাতাসের গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৩% থেকে ৮৪% হয়ে থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে যা ৮৩% থেকে ৮৯% পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ প্রায়ই অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়।
(৪) মাটি, পানি ও জলবায়ুর ভিত্তিতে বাংলাদশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলসমূহ
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটি, পানি ও জলবায়ুর ভিন্নতা রয়েছে। এ ভিন্নতার কারণেই এক এক অঞ্চলে এক এক রকম ফসল ভালো জন্মে। মাটি, পানি ও জলবায়ুর ভিত্তিতে সমগ্র বাংলাদেশকে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে।
এই বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এর শ্রেণিভাগটি মাটির ধরন, উর্বরতা, ফসল জন্মানোর প্রকৃতি, জমিতে বন্যার সময় পানির উচ্চতা, এলাকাভেদে ফসল জন্মানোর সময়সীমা, বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রাকে বিবেচনা করে করা হয়েছে।
৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. পুরাতন হিমালয় পাদদেশীয় সমভূমি অঞ্চল, ২. সক্রিয় তিস্তা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৩. তিস্তা বাঁক প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৪. করতোয়া-বাঙালি প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৫. নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা অঞ্চল ৬. নিম্নতর পুনর্ভবা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৭. সক্রিয় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৮. নতুন ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ৯. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১০. সক্রিয় গঙ্গা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১১. উঁচু গঙ্গা নদী প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১২. নিচু গঙ্গা নদী প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১৩. গঙ্গার জোয়ার-ভাটা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১৪. গোপালগঞ্জ খুলনা বিল অঞ্চল, ১৫. আড়িয়াল বিল অঞ্চল, ১৬. মধ্য মেঘনা নদী প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১৭. নিম্নতর মেঘনা নদী প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১৮. নতুন মেঘনা নদী প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ১৯ পুরানো মেঘনা মোহনা প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ২০. সুরমা-কুশিয়ারা পূর্বদিকস্থ প্লাবিত ভূমি অঞ্চল, ২১, সিলেট অববাহিকা অঞ্চল, ২২. উত্তর ও পূর্বাঞ্চল পানদেশীয় সমভূমি অঞ্চল, ২৩. চট্টগ্রাম উপকূল সমভূমি অঞ্চল, ২৪. সেন্টমার্টিন্স প্রবাল দ্বীপ অঞ্চল, ২৫. সমতল বরেন্দ্র অঞ্চল, ২৬. উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল, ২৭. উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল, ২৮ মধুপুর অঞ্চল, ২৯. উত্তরাঞ্চলীয় ও পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চল, ৩০. আখাউড়া সোপান অঞ্চল।
(৫) বাংলাদেশের বন্যা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ অঞ্চল
ক) বন্যা: বন্যা পানিজনিত সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বাংলাদেশে চার ধরনের বন্যা দেখা যায়, যথা-
i) ঢল বন্যা: বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চলে এ ধরনের বন্যা দেখা দেয়। হঠাৎ করে এপ্রিল ও মে মাসে সীমান্তে পাহাড়ি ঢলের কারণে এ বন্যা সৃষ্টি হয়। এ বন্যার পানি কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। হাওর এলাকার বোরো ধান পাকার সময় প্রায়ই ঢল বন্যায় ফসলহানি হয়ে থাকে।
ii) বৃষ্টিজনিত বন্যা: অতিবৃষ্টির কারণে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এ বন্যা দেখা দেয়। দেশের উত্তর, পশ্চিম এবং মধ্যাঞ্চলে এ ধরনের বন্যা দেখা দেয়।
iii) নদীবাহিত বন্যা: বাংলাদেশের উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে সে পানি বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। দেশের প্রধান নদ-নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হওয়ায় এ বিপুল পরিমাণ পানি দ্রুত পরিবহন করতে পারে না। ফলে দেশের মধ্যাঞ্চল তথা পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা হয়। বিগত ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালে এ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল।
iv) উপকূলীয় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসজনিত বন্যা: বঙ্গোপসাগরে বড় ধরনের নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে তার প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সাথে উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়। সাগরের লোনা পানি উপকূলীয় এলাকায় তীব্র বেগে উঁচু হয়ে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের জীবনহানিসহ ফসল, মাছ, গবাদি পশু- পাখি, ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন: বিগত সিডর ও আইলার কারণে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
খ) খরা: শুষ্ক মৌসুমে ক্রমাগত ২০ দিন বা এর বেশি দিন ধরে কোনো বৃষ্টিপাত না হলে তাকে খরা বলে। খরার ফলে মাটিতে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় রসের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে ফসলের ফলন ১৫-৯০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা অতি খরাপ্রবণ এলাকা।
[সূত্র: এনসিটিবি]