এ আলোচনাটির পাঠ করে আপনি- কৃষিপণ্যের বিপণন কি, কৃষিপণ্যের বিপণনের গুরুত্ব জানতে পারবেন, কৃষিপণ্যের বিপণনের সমস্যাবলী বুঝতে পারবেন এবং কৃষিপণ্যের বিপণনে সমবায়ের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) কৃষি পণ্য বিপণন কি?
কৃষি পণ্য বিপণন কি: কৃষিপণ্যের বিপনন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে ভোক্তার কাছে পৌছান হয়। কৃষকদের যাতে উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষি পণ্য বিভিন্ন পাইকার, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হাত ঘুরে ভোক্তার নিকট পৌছানোর প্রক্রিয়াই হলো কৃষি পণ্য বিপণন।
(২) কৃষি পণ্যের বিপণনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
নিম্নে কৃষি পণ্যের বিপণনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব আলোচনা হলো।
- কৃষক শুধু নিজের ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদন করে না। তাই কৃষি পণ্যের উন্নত বাজার কৃষি উন্নয়নের মূল উৎপাদিকা শক্তি। অন্যদিকে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করায় সমবায় ব্যবস্থাকে আয় বৃদ্ধির একটি অন্যতম উপায় বলা যায়।
- উন্নত বাজার ব্যবস্থা যেমন ভোক্তাদের উপযোগ বৃদ্ধিতে সাফল্য করে তেমনি উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের বাজারজাতকরণ বিশেষ ভূমিকা রাখে।
- বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে কৃষি পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায় ফলে কৃষকরা অধিক উৎপাদনের জন্য উৎসাহী হয় এবং তাদের আয় বৃদ্ধি ঘটে।
- উন্নত বাজার ব্যবস্থা বিরাজমান থাকলে পণ্যের অধিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পণ্যের গুনগতমান বৃদ্ধির তাগিদ সৃষ্টি হয়।
- উন্নত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
- উন্নত বাজার ব্যবস্থায় প্রতিটি পণ্যের চাহিদা মূল্য নির্দেশ করে। এরূপ মূল্যের স্থিতিশীলতা উৎপাদন পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের সুযোগ প্রদান করে।
- একটি উন্নত বাজার ব্যবস্থাই কৃষি উৎপাদনের পরিমান ও গুণগতমান নির্ধারন করে থাকে। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন বাজার ব্যবস্থার দক্ষতার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
(৩) বাংলাদেশে কৃষি পণ্য বিপণনের সমস্যাবলী
নিম্নে আমাদের বাংলাদেশে কৃষিপণ্য বিপণনের বেশ কিছু সমস্যাবলী আলোচনা হলো।
- পণ্যের নিম্নমান: নানান কারণে আমাদের কৃষি পণ্যের মান নিম্নমুখী হয়ে থাকে। যেমন- উন্নত বীজের অভাব, শস্য উৎপাদনকালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পোক-মাকড়ের আক্রমন, ফসল কর্ত নের উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ না করা, সংরক্ষনের ভালো ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি কারণে কৃষিপণ্যের গুনগুন নিম্ন হয়। ফলে কৃষক পণ্যের ভালো দাম পায় না।
- কৃষকের দারিদ্রতা: কৃষকরা দরিদ্র হওয়ার কারণে পণ্য গুদামজাত করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করে ভালো দাম পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না বিধায় ফসল উঠার পর পরই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
- মধ্যসত্বভোগীদের শোষণ: এদেশে কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে মধ্যসত্বভোগীদের অবস্থানের কারণে কৃষক সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। ফলে ভোক্তা বেশি দামে পণ্য কিনলেও কৃষক তার সুফল পায় না।
- অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা: সুষ্ঠ ও সহজ পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য দূরের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পায় না ফলে কৃষক তার দোরগেড়ায় কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
- স্থান ভেদে কৃষি পণ্যের বিভিন্ন দাম: বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের বাজারগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় একই পণ্যের দাম স্থান ভেদে ভিন্ন হয়। এত কম দামের বাজারে বিক্রয়কারী কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
(৪) কৃষি পণ্যের বিপণনে সমবায়ের ভূমিকা
নিম্নে কৃষি পণ্যের বিপণনে সমবায়ের ভূমিকাসমূহ তুলে ধরা হলো।
- সমবায় আত্মসচেনতা সৃষ্টি করে: সমবায় তার সদস্যদের মধ্যে কৃষি পণ্য বিপণনে ঐক্য ও সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করে। ফলে কৃষকের পণ্য বিক্রি করার সময় ঠকার আশংকা কমে যায়।
- উচ্চমূল্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে: কৃষকরা সমবায় সমিতি গঠনের ফলে বাজারে ক্রিয়াশীল মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম কমে যায়। ফলে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তাদের নিকট পণ্য বিক্রির সুযোগ পেয়ে পণ্যের উচ্চমূল্য পেয়ে থাকে।
- বাজারজাতকরণ খরচ কমে: সমবায়ের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাতকরণের ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্য পরিবহন, প্যাকেজিং, গুদামজাতকরণ ইত্যাদির খরচ হ্রাস পায়।
- ফড়িয়াদের দৌরাত্ম কমে: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা সংঘবদ্ধ হওয়ার কারণে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষকরা বাধ্য হয় না। ফলে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম সমবায় বাজারসমূহে হ্রাস পায়।
- সহজে ঋণ প্রাপ্তি: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা খুব সহজে ঋণ পেতে পারে। ফলে ফসল মৌসুমে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ঝুকি কমে যায়।
- বাজারের হালনাগাদ তথ্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষক বাজারের চাহিদা, বাজার দর, ভবিষ্যৎ চাহিদা সংক্রান্ত তথ্য খুব সহজে পেয়ে যায়। ফলে কৃষক তার পণ্য উৎপাদিত ও বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা মাফিক কররে পারে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয় না।
- কৃষি উপকরণ সরবরাহ: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি একত্রে সংগ্রহ করে বিতরণ করায় মূল্য কম পড়ে এবং উপকরণ প্রাপ্তি সহজসাধ্য হয়।
- সঞ্চয়ের উৎসাহ: সমবায় সমিতির সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সাপ্তাহিক অথবা মাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় জমা করার নিয়ম থাকায় কৃষকরা সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ হয়।
- কৃষিপণ্যের মান উন্নয়ন হয়: সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত কৃষকরা মানসম্মত কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে বিধায় পণ্যের মান উন্নত হয়।
- বাজার নিয়ন্ত্রন সম্ভব হয়: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বিপণন সুবিধা সৃষ্টি হলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রয় করা হয় বলে বাজার কৃষকদের নিয়ন্ত্রনে থাকে।
- পরিবহন ও গুদামজাতকরণে সুবিধা হয়: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সমিতির নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ও গুদামজাতকরণের সুবিধা থাকে বলে পণ্য নষ্ট ও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
কৃষিপণ্য উৎপাদন পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পণ্যের বিপনন। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা কৃষি পণ্য বিপণন কি, কৃষি পণ্যের বিপণনের উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও সমস্যাবলী এবং কৃষি পণ্যের বিপণনে সমবায়ের ভূমিকা সম্পর্কে জানলাম ও বুঝলাম।
সঠিকভাবে পণ্যের বিপনন/বাজারজাতকরণ করে নায্যমূল্য নিশ্চিত করাই কৃষি সমবায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারণেই পণ্যের নায্যমূল্য প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। কৃষি সমবায় এ প্রতিবন্ধকতা দূর করে কৃষকদের সৃষ্টি সুরক্ষা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]