(১) কৃষি বনায়ন কী, কাকে বলে?
কৃষি বনায়ন হলো কৃষিজ ও বনজ বৃক্ষের সম্মিলিত চাষাবাদ পদ্ধতি, যাতে একজন কৃষক ভূমির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অধিকতর উৎপাদন ও মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
অথবা,
একই ভূমিতে সুবিবেচিতভাবে বৃক্ষ, ফসল ও পশুখাদ্য উৎপাদন পদ্ধতিই হলো কৃষি বনায়ন। এতে একে অন্যের উৎপাদনকে ব্যাহত করে না। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়।
কৃষি বনায়ন একটি অতি প্রাচীন ও সনাতন পদ্ধতি। সাম্প্রতিক কালে বনায়নের এ পদ্ধতি কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এ বনায়ন পদ্ধতি পরিবেশবান্ধবও বটে। সারাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে বনজ সম্পদ বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। এ জন্য কৃষি ও সামাজিক বনায়ন সম্পর্কে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে। এ বনায়নের গুরুত্ত্বও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। সরাসরি এসব বনায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে দেশের বনজ সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবেশ বাস উপযোগী রাখতে হবে।
বাংলাদেশে সম্ভাব্য কৃষি বনায়নের যথেষ্ট উপযুক্ত স্থান রয়েছে। এগুলো হলো- বসত বাড়ির আঙিনা, কৃষিখামার, বসতবাড়ি সংলগ্ন জমি, পতিত ও প্রান্তিক জমি, ক্ষয়প্রাপ্ত ও নতুন করে সৃষ্ট বনাঞ্চল, সড়ক, রেলপথ ও বাঁধসংলগ্ন এলাকা, পুকুর ও জলাশয়ের পাড় এবং উপকূলীয় অঞ্চল প্রভৃতি।
(২) কৃষি বনায়নের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
ক) কৃষি বনায়নের বৈশিষ্ট্য
কৃষি বনায়ন হলো এক ধরনের ভূমি উৎপাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সুপরিকল্পিতভাবে বনায়ন করা হয়।
এর ফলে-
- এ ধরনের বনায়নে একই জমিতে বৃক্ষ, ফসল, পশুখাদ্য ও মৎস্যখাদ্য উৎপাদন করা হয়।
- এ বনায়নে কোনো উপাদান অন্য উপাদানকে ব্যাহত করে না।
- সব উপাদান সমন্বিতভাবে পরিবেশ সমৃদ্ধ করে। অর্থনৈতিকভাবে এ বনায়ন লাভজনক হয়।
- এ বনায়নের ফলে ভূমির বহুমুখী ব্যবহার করা যায়।
- একই জমিতে বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদের সাথে পশু পাখির সমন্বিত চাষ হয়।
- লতা জাতীয় ফসলকে একত্র করে মিশ্র চাষ করা হয়।
- কৃষি অথবা বনভিত্তিক একক ভূমি ব্যবহারের চেয়ে অধিকতর উৎপাদন ও উপকারিতা পাওয়া যায়।
সাধারণত সামাজিক কোনো নির্দিষ্ট এলাকার উপযুক্ত কৃষি বনায়ন মডেল বা নকশা তৈরিতে যেসব বিষয় বিবেচনা করতে হয়, তা হলো-
- ভূমির অবস্থান
- সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা
- মাটির বৈশিষ্ট্য
- কৃষকের চাহিদা
সম্ভাবনাময় কয়েকটি কৃষি বনায়ন মডেল-
কৃষিভূমিতে ফসল ও বৃক্ষ চাষ: এ ধরনের নকশায় একই জমিতে কৃষি ফসলের সাথে যৌথভাবে বৃক্ষের চাষ করা হয় তুলনামূলকভাবে নিচু জমিতে নির্ধারিত দূরত্বে সারি করে গাছ লাগানো হয়।
গাছের সারির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কৃষি ফসলের চাষ করা হয়। কৃষি ফসলের প্রান্তসীমায় আইলের কাছে চারপাশে সারি করে গাছ লাগানো হয়।
এ ধরনের মডেল বা নকশায় কৃষকগণ স্বতঃক্ফুর্তভাবে কৃষিজমিতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ বিক্ষিপ্তভাবে চাষ করে থাকেন।
আ্যালি পদ্ধতি: কৃষি বনায়নের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এটি একটি সফল পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সাধারণত লিগিউম জাতীয় গুল্ম বা বৃক্ষ নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘন সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়। দুই সারির মাঝে কৃষিজ ফসলের চাষ করা হয়।
ফসল, বৃক্ষ ও পশুপালন: এ পদ্ধতিতে ফলদ বা বনজ বৃক্ষের নিচে একবর্ষজীবী বা বহুবর্ষজীবী কৃষি ফসল ও পশুপালন করা হয়।
মৎস্য, বৃক্ষ ও ফসল: এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের সাথে সাথে পুকুরের ঢালু পাড়ে মাচার মাধ্যমে লতাজাতীয় শীকসবজি লাগানো হয়। পানির প্রান্তসীমায় বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ এবং উঁচু পাড়ে ফলদ বৃক্ষ চাষ করা হয়।
বসতবাড়িতে কৃষি বনায়ন: এ পদ্ধতিতে শাকসবজি, খাদ্য, ফসল, গবাদিপশু, হাস মুরগি এবং বিভিন্ন ধরনের বনজ
খ) কৃষি বনায়নের গুরুত্ব
আমাদের বাংলাদেশের ভূমি সীমিত। বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এতটুকু ভূমি সক্ষম নয়। সুতরাং বৃক্ষায়ন শুধু বনভূমিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কৃষি বনায়নকে আধুনিক প্রযুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। তাই সাধারণ কৃষি খামার, রাস্তা ও বাঁধের ধার, বাড়ির আঙিনা, প্রতিষ্ঠানের চারপাশ সর্বত্র কৃষি বনায়ন জরুরি। এ জন্য সারাদেশে নিবিড় ও ব্যাপক কৃষি বনায়ন বিপ্লব ঘটানো প্রয়োজন।
- খাদ্য চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।
- গৃহনির্মাণ ও আসবাবসামগ্রী তৈরিতে সাহায্য করে
- জ্বালানি সমস্যা মেটায়।
- একই জমিতে বিভিন্ন রকম ফসল ও বৃক্ষ রোপণ করা যায়।
- অর্থ আয়ের ব্যবস্থা হয়, কর্মসংস্থান বাড়ে, ফলে দারিদ্র্য বিমোচন হয়
- স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা যায়।
- মাটিক্ষয় রোধ হয় ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
- পরিবেশ জীবের বসবাস উপযোগী হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় পশু পাখির খাদ্য ও আবাসস্থল সৃষ্টি হয়।
- বৃষ্টিপাত বেশি হয়।
- মরুকরণ, বন্যা ও ভূমিধ্বস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মোট কথা, কৃষি বনায়ন গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
(৩) কৃষি বনায়নের সমস্যা ও সমাধান
ক) কৃষি বনায়নের সমস্যা
কৃষি বনায়ন সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী একটি লাভজনক প্রযুক্তি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু কৃষি বনায়নে যথেষ্ট সমস্যাও রয়েছে।
- কৃষি বনায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ কমছে।
- রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
- পোকামাকড় ও ক্ষতিকর জীবজল্লুর আক্রমণে উৎপাদন কমছে।
- ভালো বীজ ও সারের অভাব।
- কৃষিবন রক্ষনাবেক্ষণের সমস্যা।
- শুকনো মৌসুমে পানি সেচের অভাব।
- উৎপাদিত দ্রব্য সংরক্ষণের অভাব।
- যাতায়াতে সুব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করা যায় না। ফলে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। অল্প মূল্যে কৃষককে পণ্য বিক্রয় করতে হয়।
- কৃষি যন সম্পর্কে কৃষকের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব।
- কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা না থাকা।
- এলাকাভিত্তিক কৃষিপণ্য সংরক্ষণের অভাব।
খ) কৃষি বনায়নের সমস্যাসমূহের সমাধান
- কৃষি আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য যেসব জায়গায় সামাজিক বনায়ন করা হয় সেসব জায়গা কৃষি বনায়নের আওতায় আনা দরকার।
- শস্য পর্যায় অনুসরণ করে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে যাতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
- আলোর ফাঁদ, ফাঁদ যন্ত্র, নিম ও বিষ কাটালির নির্যাস ব্যবহার করে ক্ষতিকর জীব-জন্তু ও পোকামাকড় দমন করতে হবে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পুষিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
- কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- কৃষি বনায়ন সম্পর্কে কৃষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে ভালো বীজ ও সার সরকারিভাবে সরবরাহ করতে হবে।
- কৃষিবন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনগণের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে।
- যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে যাতে কৃষক সহজে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে সঠিক মূল্য পেতে পারে। .
- এলাকাভিত্তিক কৃষি শিল্পকারখানা তৈরি করতে হবে যাতে করে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয় তাছাড়া কৃষিপণ্য তাৎক্ষণিকভাবে সংরক্ষণের জন্য যথেষ্টসংখ্যক হিমাগারের ব্যবস্থাও সরকারি এবং বেসরকারিভাবে করা প্রয়োজন।
[সূত্র: এনসিটিবি]