বাংলাদেশের কৃষিতে সমাবায়ের ধারণা এখনও ব্যাপকভিত্তিক হয়নি। অথচ কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, বিপনন, বাজারজাতকরণ প্রভৃতি কর্মকান্ডে সমবায় ভিত্তিক ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
এ আলোচনাটি পাঠ করলে আপনি- কৃষি সমবায় কি, কৃষি সমবায় কাকে বলে, তা জানতে পারবেন। সমবায়ের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানতে পারবেন। কৃষি সমবায় কত প্রকার তা জানতে পারবেন।
(১) কৃষি সমবায় কি? কৃষি সমবায় কাকে বলে?
কৃষি সমবায় কি: কৃষি সমবায় এমন একটি সম্পর্কিত কার্যক্রম যা কৃষি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন এর সফল হিসাব রক্ষা করে এবং প্রত্যেক সদস্যের বিনিয়োগের পরিমান অনুযায়ী মুনাফা বন্টনের দায়িত্ব পালন করে।
সমবায়ের এই ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ প্রদানে বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানীরা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।
যেমন কালভার্ট এর মতে- “সমবায় হলো একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সমঅধিকারের ভিত্তিতে একে অন্যের সহযোগিতা করে।”
অন্যদিকে ড. কে.এল. কার্জুর মতে- “সমবায় হলো এমন একটি সাংগঠনিক তৎপরতা যা আর্থিকভাবে শোচনীয় ব্যত্তিদের দ্বারা গঠিত হয় এবং তারা ব্যক্তি লাভের আশায় কাজ না করে সাবির্ কভাবে সবার আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ কর”।
তাই সমবায়ের মূল মন্ত্র হচ্ছে- “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”।
কৃষি সমবায় কাকে বলে: সমবায় হচ্ছে পারিবারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একত্রে কাজ করার জন্য স্বাধীনভাবে গড়ে তোলা একটি সংঘ বা সমিতি। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে যে সমবায় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে কৃষি সমবায় বলে।
ব্যক্তি উদ্যোগের তুলনায় কিছু সংখ্যক সমমনা ব্যক্তির যৌথ উদ্যোগে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন সহজতর হয় বিধায় কৃষি সমবায়ের ধারণা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
(২) কৃষি সমবায়ের উদ্দেশ্য কি?
কৃষি সমবায়ের উদ্দেশ্য কি: কৃষি সমবায়ের মূল উদ্দেশ্য হলো-
- সমবায়ের মূলনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত কৃষকদেরকে আর্থ-সামাজিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা।
- কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন সমবায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত করে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কৃষিকাজে গতিশীলতা আনয়ন করা।
- কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের সর্বোচ্চ সুবিধা কৃষকদের জন্য নিশ্চিত করা।
(৩) কৃষি সমবায় কত প্রকার?
কৃষি সমবায় কত প্রকার: কৃষিজীবি মানুষদের নিয়ে যে ধরণের সমবায় সংগঠন তৈরী করা হয় তাদেরকে কৃষি সমবায় সমিতি বলে। কৃষি সমবায় তিন ধরণের-
- কৃষি উৎপাদন সমবায় সমিতি: কৃষির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বা নিয়োজিত কৃষক। ব্যক্তিবর্গ সমবায়ে গঠিত সমবায়কে কৃষি উৎপাদন সমবায় সমিতি বলে। সহজভাবে কৃষিউপকরণ সংগ্রহ, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, পশু সম্পদের উন্নয়ন প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কৃষি উৎপাদন সমবায় সমিতি গঠিত হয়।
- সেবামূলক সমবায় সমিতি: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপকরণ সংগ্রহ যেমন- ভূমি কর্ষন যন্ত্রপাতি (পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, কীটনাশক ছিটানোর যন্ত্র), সেচের যন্ত্রপাতি (শক্তিচালিত পানির পাম্প), এবং কৃষি ঋণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ ধরণের সমিতি গঠিত হয়।
- কৃষি বিপণন সমবায় সমিতি: কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের জন্য এই ধরণের সমবায় সমিতি গঠিত হয়। এ সমিতি কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকে।
সংঘবদ্ধভাবে কৃষি কাজ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই হলো সমবায়ের মূল ধারণা। সমবায়ের মূলনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত কৃষকদেরকে আর্থ-সামাজিকভাবে স্বনির্ভর করাই সমবায়ের প্রধান উদ্দেশ্য।
কৃষি ও সমাজের সঠিক উন্নতি বিবেচনায় বিভিন্ন ধরণের সমবায় পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে। যেমন কৃষি উৎপাদন সমাবায় সমিতি, কৃষি বিপণন সমবায় সমিতি, সেবামূলক সমবায় সমিতি ইত্যাদি।
(৪) পণ্যের বিপণনে কৃষি সমবায়ের সুবিধা
নিম্নে কৃষি পণ্যের বিপণনে সমবায়ের ভূমিকাসমূহ তুলে ধরা হলো।
- সমবায় আত্মসচেনতা সৃষ্টি করে: সমবায় তার সদস্যদের মধ্যে কৃষি পণ্য বিপণনে ঐক্য ও সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করে। ফলে কৃষকের পণ্য বিক্রি করার সময় ঠকার আশংকা কমে যায়।
- উচ্চমূল্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে: কৃষকরা সমবায় সমিতি গঠনের ফলে বাজারে ক্রিয়াশীল মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম কমে যায়। ফলে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তাদের নিকট পণ্য বিক্রির সুযোগ পেয়ে পণ্যের উচ্চমূল্য পেয়ে থাকে।
- বাজারজাতকরণ খরচ কমে: সমবায়ের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাতকরণের ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্য পরিবহন, প্যাকেজিং, গুদামজাতকরণ ইত্যাদির খরচ হ্রাস পায়।
- ফড়িয়াদের দৌরাত্ম কমে: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা সংঘবদ্ধ হওয়ার কারণে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষকরা বাধ্য হয় না। ফলে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম সমবায় বাজারসমূহে হ্রাস পায়।
- সহজে ঋণ প্রাপ্তি: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা খুব সহজে ঋণ পেতে পারে। ফলে ফসল মৌসুমে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ঝুকি কমে যায়।
- বাজারের হালনাগাদ তথ্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষক বাজারের চাহিদা, বাজার দর, ভবিষ্যৎ চাহিদা সংক্রান্ত তথ্য খুব সহজে পেয়ে যায়। ফলে কৃষক তার পণ্য উৎপাদিত ও বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা মাফিক কররে পারে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয় না।
- কৃষি উপকরণ সরবরাহ: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি একত্রে সংগ্রহ করে বিতরণ করায় মূল্য কম পড়ে এবং উপকরণ প্রাপ্তি সহজসাধ্য হয়।
- সঞ্চয়ের উৎসাহ: সমবায় সমিতির সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সাপ্তাহিক অথবা মাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় জমা করার নিয়ম থাকায় কৃষকরা সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ হয়।
- কৃষিপণ্যের মান উন্নয়ন হয়: সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত কৃষকরা মানসম্মত কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে বিধায় পণ্যের মান উন্নত হয়।
- বাজার নিয়ন্ত্রন সম্ভব হয়: সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বিপণন সুবিধা সৃষ্টি হলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রয় করা হয় বলে বাজার কৃষকদের নিয়ন্ত্রনে থাকে।
- পরিবহন ও গুদামজাতকরণে সুবিধা হয়: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সমিতির নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ও গুদামজাতকরণের সুবিধা থাকে বলে পণ্য নষ্ট ও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা কৃষি সমবায় কি, কৃষি সমবায় কাকে বলে, সমবায়ের উদ্দেশ্য, কৃষি সমবায় কত প্রকার তা জানতে পারলাম। কৃষি সমবায় আধুনিক কৃষি কাজের প্রয়োজনীয় সফল উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহারে কৃষকদেরকে অধিকহারে সক্ষম করে তোলার মাধ্যমে কৃষিকাজে সর্বোচ্চ সফলতা এনে দিতে পারে।
সঠিকভাবে পণ্যের বিপনন/বাজারজাতকরণ করে নায্যমূল্য নিশ্চিত করাই কৃষি সমবায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারণেই পণ্যের নায্যমূল্য প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। কৃষি সমবায় এ প্রতিবন্ধকতা দূর করে কৃষকদের সৃষ্টি সুরক্ষা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]