বিশ্বব্যাপী গম এখন প্রোটিনের নিরামিষ উৎস হিসেবে জন্যে অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ যা মানুষের খাদ্যে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, গমে অধিক পরিমানে প্রোটিন থাকে, এছাড়াও ধান ও ভূট্টাতেও এই প্রোটিন পাওয়া যায়।
খাবার জন্যে ব্যবহৃত মোট উৎপাদিত শস্য অনুযায়ী, গম রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে যখন থেকে ভুট্টাকে পশু খাদ্যের জন্যে ব্যবহার শুরু হয় এবং ধান রয়েছে প্রথম অবস্থানে যেহেতু ধান মানুষ্য খাদ্যের প্রধান শস্য। তাই আমাদের গমের জাত সমূহ উন্নত করা ও গমের নতুন জাত চাষের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা অতিব প্রয়োজন।
গম মানবসভ্যতার শুরুতে নগরভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভবের প্রধান হেতু ছিল কারণ গম ছিল আদি শস্য উপাদানের মধ্যে একটি যে শস্য বৃহৎ পরিমানে চাষ করা যায় এবং অতিরিক্ত ফসল অনেক দিন পর্যন্ত গুদামজাত করে রাখা যায়। গম দানা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার উপাদান যা গুড়ো করে তৈরি আটা নানারকম রুটি, বিস্কুট, কুকিজ, কেক, পিঠা, পাস্তা, নুডলস, তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। গমের খড় গৃহপালিত পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং খড়ের ছাউনির জন্য নির্মাণ সামগ্রী হিসেব ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, নেপাল ও ভূটানসহ বেশ কিছু দেশ গম উৎপাদন করে থাকে। তবে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি (FAO) এর ২০১২ রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি গম উৎপাদনে শীর্ষ ১০টি দেশ হলো- চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পাকিস্থান, জার্মানি ও তুরস্ক।
নিম্নে বারোটি গমের জাত সমূহে এবং দু্ইটি ট্রিটিক্যালি গমের নতুন জাত এর পরিচয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
(১) গমের জাত: কাঞ্চন
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ইউপি-৩০১ এবং সি-৩০৬ এর মধ্যে সংকরায়ণ করে কাঞ্চন জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ জাত ১৯৮৩ সালে অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ১০-১০০ সেমি।
- কুশির সংখ্যা ৬-৭টি।
- গাছের নিশান পাতা খাড়া।
- শীষ বের হতে ৬০-৬৮ দিন সময় লাগে।
- প্রতি শীষে ৩৫-৪০টি দানা থাকে।
- দানা সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪৮-৫২ গ্রাম।
- অন্যান্য জাতের তুলনায় নানা আকারে বড়।
- চারা অবস্থায় প্রাথমিক কুশি মাটির উপরে অবস্থান করে।
- বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৬-১১২ দিন সময় লাগে।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.৬ টন ফলন হয়।
- এ জাতটি দীর্ঘ সময় ধরে কৃষকের মাঠে চাষাবাদ হচ্ছিল। পাতার মরিচা ও দাগ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় জাতটির ফলন হ্রাস পায় এবং এটি আর চাষের জন্য অনুমোদন করা হয় না।
(২) গমের জাত: আকবর
আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র (CIMMYT) মেক্সিকোতে রবিন ও টোবারী নামক ২টি জাতের মধ্যে সংকরায়ণের পর একটি কৌলিক সারি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। পরবর্তীকালে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতটি ‘আকবর’ নামে ১৯৮৩ সালে অনুমোদিত হয়।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা ৮৫-৯০ সেমি।
- কুশির সংখ্যা ৬-৭টি। পাতা কিছুটা হেলানো।
- নিশান পাতা খুবই চওড়া ও লম্বা।
- শীষ বের হতে ৫০-৫৫ দিন সময় লাগে।
- প্রতি শীষে ৫০-৫৫ টি দানা থাকে।
- দানা সাদা, আকারে মাঝারী এবং হাজার দানার ওজন ৩৭-৪২ গ্রাম।
- পাতার গোড়ায় সাদা অরিকল থাকে।
- ফসল বোনা থেকে কাটা পর্যন্ত ১০৩-১০৮ দিন সময় লাগে।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.৫ টন হয়।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলায় এ জাতের ফলন বেশি হয়। তবে ‘আকবর’ জাতের গম দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও চাষের জন্য উপযোগী।
(৩) গমের জাত: অঘ্রাণী
আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র, মেক্সিকো হতে সনোরা/পি ৪১৬০ ই/ইনিয়া কৌলিক সারিটি ১৯৮২ সালে বাছাই করণ নার্সারীর মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয় এবং ১৯৮৭ সালে অগ্রাণী নামে তা অনুমোদন লাভ করে।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা ৮৫-৯০ সেমি, কুশির সংখ্যা ৫-৬টি।
- পাতা কিছুটা হেলানো, নিশান পাতা বড়।
- গাছের পাতা ও কান্তে পাতলা মোমের আবরণের মত বস্তু লক্ষ্য করা যায়।
- শীষ বের হতে ৫৫-৬০ দিন সময় লাগে।
- প্রতি শীষে ৫০-৫৫টি দানা থাকে, দানার রং সাদা, আকারে মাঝারী এবং হাজার দানার ওজন ৩৮-৪২ গ্রাম।
- পাতার গোড়ায় বেগুনি অরিকল থাকে।
- বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৩-১১০ দিন সময় লাগে।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.০ টন হয়।
- জাতটি পাতার দাগ (রাইট) রোগ সহনশীল। দেরিতে বপনের জন্য অগ্রাণী জাতের গম বিশেষভাবে উপযোগী।
(৫) গমের জাত: প্রতিভা
থাইল্যান্ড হতে ১৯৮২ সালে প্রেরিত বাছাইকরণ নার্সারীতে কে-ইউ-১২ নামক একটি কৌলিক সারি বাংলাদেশে বাছাই করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে তা ‘প্রতিভা’ নামে অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ৮৫-৯৫ সেমি।
- কুশির সংখ্যা ৬-৭টি।
- গাছের নিশান পাতা খাড়া।
- শীষ বের হতে ৬০-৭০ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা ও প্রতি শীষে ৩৫-৪৫টি দানা থাকে।
- দানা সাদা, আকারে বড় হাজার দানার ওজন ৪২-৪৮ গ্রাম।
- ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৫-১১০ দিন সময় লাগে।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩.৮-৪.৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
- গমের ‘প্রতিভা’ জাত পাতার মরিচা ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল। প্রতিভা জাতের গম দেশের সকল অঞ্চলে চাষ করা যায়।
(৬) গমের জাত: সৌরভ
আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রে নেকোজারী ও ভেরী জাতের মধ্যে সংকরায়ণকৃত একটি কৌলিক সারি ১৯৮৯ সালে এদেশে এনে বাছাই করা হয় যা ১৯৯৮ সালে বারি গম-১৯ (সৌরভ) নামে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি।
- কুশির সংখ্যা ৫-৬টি।
- পাতা চওড়া, হেলানো ও গাঢ় সবুজ।
- নিশান পাতা চওড়া ও হেলানো।
- নিশান পাতার নিচের তলে মোমের মত পাতলা আবরণ থাকে।
- কাণ্ড মোটা ও শক্ত, ঝড় বৃষ্টিতে হেলে পড়ে না।
- নিচের ঠোঁট বড়, প্রায় ৫ মিমি।
- শীষ বের হতে ৬০-৬৭ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা, প্রতিটি শীষে দানার সংখ্যা ৪২- ৪৮টি, দানার রং সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম।
- বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০২-১১০ দিন সময় লাগে।
- উন্নত পদ্ধতিতে আবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৫-৪.৫ টন পাওয়া যায়।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী। সৌরভ গম দেশের প্রায় সকল অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী।
(৭) গমের জাত: গৌরব
আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রে টুরাকো ও চিলেরো জাতের মধ্যে সংকরায়ণকৃত একটি কৌলিক সারি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। খুব উৎপাদনশীল জাত হিসেবে সারিটি বাছাই করা হয় যা ১৯৯৮ সালে বারি গম-২০ (গৌরব) নামে সারা দেশে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন লাভ করে।
- গাছের উচ্চতা ৯০-১০২ সেমি।
- কুশি ৫-৬টি।
- পাতা গাঢ় সবুজ।
- নিশান পাতা খাড়া, সরু ও ঈষৎ মোড়ানো।
- নিচের ঘুমের ঠোঁট ছোট, প্রায় ২ মিমি।
- শীষ বের হতে ৬০-৬৫ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা, অগ্রভাগ সরু।
- প্রতি শীষে ৪৫-৫০টি দানা থাকে।
- দানার রং সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪০-৪৮ গ্রাম।
- জীবন কাল ১০০-১০৮ দিন।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩.৬-৪.৮ টন ফলন পাওয়া যায়।
- জাতটি পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং পাতার দাগ রোগ সহনশীল। এ জাতটি তাপ সহিষ্ণু তাই দেরিতে বপন করলেও ভাল ফলন দেয়।
(৮) গমের জাত: বারি গম-২১ (শতাব্দী)
বারি গম-২১ (শতাব্দী), গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রে মরিংগা, বাকবাক ব্রো, পাতন ও পাঞ্জাব-৮১ জাতের মধ্যে সংকরায়ণকৃত এফ-২ সংকর বীজ ১৯৮৮ সাল হতে বাছাই প্রক্রিয়ায় একটি কৌলিক সারি নির্বাচন করা হয়। এ কৌলিক সারিটি ২০০০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি গম-২১ (শতাব্দী) নামে অনুমোদন লাভ করে।
- গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি।
- কুশির সংখ্যা ৪-৬টি।
- পাতা চওড়া ও হালকা সবুজ।
- নিশান পাতা আধা হেলানো।
- স্পাইকলেটের নিচের ঘুমের ঠোঁট লম্বা (প্রায় ৮-১০ মিমি) এবং নিচের ঘুমের ঘাড় উঁচু।
- শীর্ষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪০-৪৫টি।
- শীষ বের হতে ৬৫-৬৯ দিন সময় লাগে।
- দানার রং সাদা ও আকারে বড়।
- হাজার দানার ওজন ৪৮-৪৮ গ্রাম।
- পাকার সময় শীঘ্র হলুদ হলেও নিশান পাতা ও শীষের নিচের নও সবুজ থাকে।
- ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৫-১১২ দিন সময় লাগে।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৩০-৫.০০ টন।
- উপযুক্ত সময়ে বা দেরিতে বপনে কাঞ্চনের চেয়ে শতকরা ১০-১২ ভাগ বেশি ফলন দেয়।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- জাতটি তাপ সহনশীল।
- উপযুক্ত সময়ে বপনের পাশাপাশি নাবিতে বপনে অন্যান্য জাতের চেয়ে বেশি ফলন দেয়।
- আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্যও জাতটি উপযুক্ত।
(৯) গমের জাত: বারি গম-২২ (সুফী)
গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম- ২২ (সুফী) একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। এ জাতটি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে দুটি কৌলিক সারি COQ/F61.70/CNDR/3/OLN/4/PHOS ও MRNG/ALDAN/CNO এর মধ্যে গম গবেষণা কেন্দ্রে সংকরায়ণ ঘটানো হয়। পরের বছর প্রাপ্ত F1 এর সাথে কাঞ্চন জাতের টপ ক্রস করা হয়। অতঃপর F2 বীজ হতে বিভিন্ন প্রজন্মে বাছাই করার পর BAW 1006 নামের কৌলিক সারিকে নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে ফলন পরীক্ষায় জাতটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়। এ কৌলিক সারিটি ২০০৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক গম- ২২ (সুফী) নামে অনুমোদন লাভ করে।
- চার পাঁচটি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ৯০-১০২ সেমি।
- পাতা চওড়া ও গাঢ় সবুজ।
- শীষ বের হতে ৫৮-৬২ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০০-১১০ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৫০-৫৫টি।
- দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে ছোট।
- জাতটি ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বপন করা চলে এবং দেরিতে বপন করলেও দানার আকার প্রায় স্বাভাবিক থাকে।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৫-৪.৮ টন এবং দেরিতে বপনেও ভাল ফলন দেয়।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- জাতটি তাপ সহনশীল ও চিটা প্রতিরোধী।
- আটায় শক্তিশালী প্লুটেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থাকায় জাতটি পাউরুটি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী।
(১০) গমের জাত: বিজয় বা বারি গম-২৩
গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম- ২৩ (বিজয়) একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। নেপালে সংকরায়ণকৃত এ কৌলিক সারিটি আঞ্চলিক নার্সারীর মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে এদেশে পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা হয়। এ কৌলিক সারিটি বিভিন্ন নার্সারীতেও ফলন পরীক্ষায় উচ্চ ফলনশীল প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে ফলন পরীক্ষায় ভাল প্রমাণিত হওয়ায় এ কৌলিক সারিটি ২০০৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি গম-২৩ (বিজয়) নামে অনুমোদন লাভ করে।
- চার পাঁচটি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ৯৫-১০৫ সেমি।
- পাতা চওড়া ও হালকা সবুজ।
- শীষ বের হতে ৬০-৬৫ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৩-১১২ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৩৫-৪০টি।
- দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে ছোট।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৩-৫.০ টন এবং দেরিতে বপনে জাতটি ভাল ফলন দিতে সক্ষম।
- জাতটি তাপ সহনশীল।
- আমন ধান কাটার পর দেরিতে (ডিসেম্বর মাসের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত) বপনের জন্যও এ জাতটি উপযোগী।
(১১) গমের জাত: প্রদীপ বা বারি গম-২৪
গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম- ২৪ (প্রদীপ) একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। নেপালে ১৯৯১ সালে G 162 এবং BL 1316 লাইন দুটির মধ্যে সংকরায়ণের পর ১৯৯২ সালে F1 এর সহিত NL 29 কে Male parent হিসেবে Top cross করা হয়। পরবর্তীকালে এবং F3 জেনারেশন F4 Modified bulk পদ্ধতির মাধ্যমে কৌলিক সারিটি আঞ্চলিক নার্সারীর (EGPSN) মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে এদেশে বারি গম-২৪ (প্রদীপ) এর ফসল এবং ইনসেটে দানা পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা হয়। এ কৌলিক সারিটি বিভিন্ন নার্সারীতেও ফলন পরীক্ষায় উচ্চ ফলনশীল প্রমাণিত হওয়ায় BAW 1008 নামে নির্বাচন করা হয়। এ কৌলিক সারিটি ২০০৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি গম-২৪ (প্রদীপ) নামে অনুমোদন লাভ করে।
- চার পাঁচটি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ৯৫-১০০ সেমি।
- পাতা চওড়া ও গাঢ় সবুজ।
- শীষ বের হতে ৬৪-৬৬ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০২-১১০ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪৫-৫৫টি।
- দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে বেশ বড়।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল, মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং তাপ সহনশীল।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৫-৫.১ টন এবং দেরিতে বপনেও জাতটি ভাল ফলন দেয়।
- আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্য এ জাতটি খুবই উপযোগী।
- আটায় শক্তিশালী গ্লুটেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থাকার জাতটি পাউরুটি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী।
- জাতটি ডিসেম্বর মাসের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত বপন করা চলে এবং দেরিতে বপন করলেও দানার আকার প্রায় স্বাভাবিক থাকে।
(১২) গমের জাত: বারি গম-২৫
গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম- ২৫ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। নেপালে সংকরায়ণকৃত এ কৌলিক সারিটি আঞ্চলিক নার্সারীর মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে এদেশে পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা হয়। এ কৌলিক সারিটি বিভিন্ন নার্সারীতে ও ফলন পরীক্ষা উচ্চ ফলনশীল প্রমাণিত হওয়ায় BAW 1059 নামে নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে ফলন পরীক্ষায়ও এ জাতটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়। জাতটি তাপ সহনশীল, দানা খুবই বড় ও সাদা। আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্যও এ জাতটি উপযোগী।
- চার পাঁচটি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ১৫-১০০ সেমি।
- পাতা চওড়া ও গাঢ় সবুজ।
- শীষ বের হতে ৫৭-৬১ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০২-১১০ দিন সময় লাগে।
- শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪৫-৫০টি দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে বেশ বড় (হাজার দানার ওজন ৫৪-৫৮ গ্রাম)।
- চারা অবস্থায় কুশিগুলো হালকাভাবে হেলানো (Semi erect) থাকে।
- গাছের রং গাঢ় সবুজ।
- উপরের কাজের গিড়ায় খুবই কম সংখ্যক রোম (Hair) থাকে।
- নিশান পাতা চওড়া ও হেলানো। শীষে, কাণ্ডে ও নিশান পাতার খোলে মোমের মত মাঝারী আবরণ থাকে।
- স্পাইকলেটে নিচের ঘুমের ঘাড় সরু ও হেলানো (Sloppy), ঠাঁট ছোট (<৫.০ মিমি) এবং ঠোঁটে অনেক কাঁটা থাকে।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং তাপ সহিষ্ণু।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৬০০-৪৬০০ কেজি এবং দেরিতে বপনে জাতটি শতাব্দীর চেয়ে শতকরা ৬-১০ ভাগ ফলন বেশি দেয়।
- জাতটি লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যম মাত্রার লবণাক্ত (৬-৮ মিলিমস/সেমি) এলাকায় চাষের উপযোগী।
(১৩) গমের জাত: বারি গম-২৬
গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম- ২৬’ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। বাংলাদেশে ৩টি বিদেশী গম জাতের মধ্যে সংকরায়ণ এবং বিভিন্ন প্রজন্যে বাছাই করে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। এ কৌলিক সারিটি বিভিন্ন নার্সারীতে ও ফলন পরীক্ষায় উচ্চ ফলনশীল প্রমাণিত হওয়ায় BAW 1064 নামে নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষায়ও এ জাতটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়।
- বারি গম-২৬ জাতটি তাপ সহনশীল এবং নানা বড় ও সাদা।
- আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্য এ জাতটি খুবই উপযোগী।
- পাঁচ ছয়টি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ৯২-৯৬ সেমি।
- পাতা চওড়া ও গাঢ় সবুজ।
- শীষ বের হতে ৬০-৬৩ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৪-১১০ দিন সময় লাগে।
- শীষ মাঝারী এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪৫-৫০টি।
- দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে বড় হাজার দানার ওজন ৪৮-৫২ গ্রাম।
- চারা অবস্থায় কুপিগুলো হেলানো (Intermediate ) থাকে।
- গাছের রং গাঢ় সবুজ।
- উপরের কাজের গিড়ায় প্রচুর রোম (Hair) থাকে।
- নিশান পাতা চওড়া ও হেলানো।
- শীর্ষে, কাণ্ডে ও নিশান পাতার খোলে মোমের মত মাঝারী ঘন আবরণ থাকে।
- স্পাইকলেটে নিচের ঘুমের ঘাড় মাঝারী চওড়া ও খাঁজ কাটা, ঠোঁট লম্বা (> ১৫.০ মিমি) এবং ঠোঁটে অনেক কাঁটা থাকে।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫০০-৪৫০০ কেজি এবং দেরিতে বপনে জাতটি শতাব্দীর চেয়ে শতকরা ১০-১২ ভাগ ফলন বেশি দেয়।
(১৪) গমের নতুন জাত: ট্রিটিক্যালি
ডুরাম পম (Triticum turgidum L.) ও ঘাস জাতীয় রাই (Secale cereale L.) এর কৃত্রিম সংকরায়ণ ও নানাবিধ বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি নতুন ফসলের নাম ট্রিটিক্যালি। একে মনুষ্য সৃষ্ট ফসল (Manmade crop ) বলা হয়।
ট্রিটিক্যালি দুটি ভিন্ন জেনাস (Genus) এর সংমিশ্রণে সৃষ্ট হওয়ার কারণে অধিক ফলনশীল, খরা সহিষ্ণু ও প্রতিকূল আবহাওয়া সহনশীল।
অনেক ক্ষেত্রেই সাধরণ গমের তুলনায় ট্রিটিক্যালি জাতের গম চাষ করা বেশি লাভ জনক।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গম গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক বাছাইকৃত দ্বৈত ট্রিটিক্যালির লাইন ২০০৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ‘বারি টিটিক্যালি-১’ ও ‘বারি ট্রিটিক্যালি-২’ নামে অনুমোদিত হয়েছে।
ক) বারি ট্রিটিক্যালি-১
বারি ট্রিটিক্যালি-১ একটি উচ্চ ফলনশীল দ্বৈত ট্রিটিক্যালির জাত।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা মাঝারী (১০০-১১০ সেমি) এবং গাছের রং গাঢ় সবুজ।
- জাতটি খুবই আগাম, ঘাস না কাটলে ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৬- ১১২ দিন সময় লাগে। তবে বোনার ৪০ দিন পর একবার ঘাস কাটলে থাকার জন্য ৯-১২ দিন সময় বেশি লাগে।
- দানার রং সাদা, চকচকে ও আকার বড়, হাজার দানার ওজন ৪৫-৫০ গ্রাম।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- উপযুক্ত পরিবেশে বপন করে বোনার ৪০ দিন পর একবার ঘাস কেটে হেক্টরপ্রতি ১০-১১ টন কাঁচা ঘাস এবং হেক্টরপ্রতি ৪২০০-৪৫০০ কেজি দানা পাওয়া যায়।
খ) বারি ট্রিটিক্যালি-২
- বারি ট্রিটিক্যালি-২ একটি উচ্চ ফলনশীল দ্বৈত ট্রিটিক্যালির জাত।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা মাঝারী (১০০-১১০ সেমি) এবং গাছের রং হালকা সবুজ।
- জাতটি খুবই আগাম, ঘাস না কাটলে ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১১০-১১৫ দিন সময় লাগে। তবে বোনার ৪০ দিন পর একবার ঘাস কাটলে পাকার সময় ১০-১২ দিন বেশি লাগে।
- দানার রং লাল, চকচকে ও আকার মাঝারী এবং হাজার দানার ওজন ৩৮-৪২ গ্রাম।
- জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
- উপযুক্ত পরিবেশে বপন করে বোনার ৪০ দিন পর একবার ঘাস কেটে হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন কাঁচা ঘাস এবং হেক্টরপ্রতি ৪৩০০-৪০০ কেজি নানা পাওয়া যায়।
এই ছিল গমের জাত সমূহ এবং ট্রিটিক্যালি গমের নতুন জাত বিষয় আলোচনা। আশা করি পোষ্টটি থেকে প্রিয় খামারি ভায়েরা বিভিন্ন গমের বিভিন্ন জাতের পরিচিতি, গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি সাজানো গোছনো ধারণা পেয়েছেন।
আজকের এই পোষ্টটি এখানেই সমাপ্ত হচ্ছে, আবার দেখো হবে কৃষি বিষয়ক অন্য কোন আলোচনায়। ততদিন ভারৈা থকবেন, সুস্থ থাকবেন। শেষ অবধি সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
[সূত্র: বিএআরআই ও বিডব্লিউএমআরআই]