গম বাংলাদেশে ধানের পরই দ্বিতীয় প্রধান দানা জাতীয় খাদ্যশস্য। গম একটি শীতকালীন যা রবি মৌসুমে চাষ করা হয়। গত ২০১৪-১৫ মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৪.৩৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে গমের চাষ হয়েছে এবং উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৩.৪৮ লক্ষ টন। বর্তমানে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় ৪৫ লক্ষ টন। তাই দেশের চাহিদা মেটাতে বছরে অন্তত ৩০ লক্ষ টন গম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।
গম চাষাবাদের জন্য ধানের তুলনায় পানি সেচ অনেক কম লাগে। উন্নত জাত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে গমের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব।
নিম্নে গম চাষ পদ্ধতি এবং গম চাষে সার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা সমূহ ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো-
(১) গম চাষে উন্নত জাত নির্বাচন
সম্প্রতি উদ্ভাবিত গমের জাতগুলোর জীবনকাল, ফলন ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো-
জাতের নাম | উদ্ভাবনের বছর | জীবনকাল | হেক্টরপ্রতি ফলন | বিশেষ বৈশিষ্ট্য |
বারি গম ২৫ | ২০১০ | ১০২-১১০ দিন | ৩.৬-৫.০ টন | তাপ ও লবণ সহনশীল |
বারি গম ২৭ | ২০১২ | ১০৫-১১০ দিন | ৪.০-৫.৪ | তাপসহিষ্ণু |
বারি গম ২৮ | ২০১২ | ১০২-১০৮ দিন | ৪.০-৫.৪ | স্বল্পমেয়াদি |
বারি গম ২৯ | ২০১৪ | ১০৫-১১০ দিন | 8.০-৫.৫ টন | কাও শক্ত ও গাছ খাটো |
বারি গম ৩০ | ২০১৪ | ১০০-১০৫ দিন | ৪.৫-৫.৫ টন | স্বল্পমেয়াদি |
(২) গম চাষ পদ্ধতি ধারাবাহিক বর্ণনা
ক) গম বপনের উপযুক্ত সময়
গম বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের শেষ ২ সপ্তাহ। যে সমস্ত এলাকায় আমন ধান কাটতে দেরি হয় বা জমি তৈরিতে দেরি হয় সেসব এলাকায় গমের তাপ সহনশীল জাত যেমন বারি গম ২৫, লবণ সহনশীল বারি গম ২৮ বা স্বল্পমেয়াদি জাত বারি গম ৩০ চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
খ) বীজের হার ও বীজ শোধন
শতকরা ৮০ ভাগ বা তার বেশি অঙ্কুরোদ্গাম ক্ষমতা আছে এরূপ বীজ প্রতি হেক্টর জমিতে শোধিত ১২০ কেজি হারে বপন করতে হবে।
গ) বপন পদ্ধতি
- জমিতে ‘জো’ এলে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
- সারিতে অথবা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়।
- সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরির পর ছোট লাগল বা বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে ২০ সে.মি. পর পর সারিতে এবং ৪-৫ সে.মি. গভীরে বীজ বুনতে হবে।
- পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে একসঙ্গে জমি চাষ, সারিতে বীজ বপন ও মইয়ের কাজ করা যাবে।
- সারিতে বপন করলে নিড়ানিসহ বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যার কাজে সুবিধা হয়।
- বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(বীজ ঢেকে দেয়ার পর জমির চাল অনুযায়ী বৃষ্টি সেচের অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০-২৫ ফুট অন্তর অন্তর নালা কেটে রাখা।)
ঘ) গম চাষে সার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা
মধ্যম উর্বর জমিতে উচ্চ ফলনের জন্য গম চাষে বিভিন্ন সারের পরিমাণ পাশের সারনিতে দেয়া হলো-
সারের নাম | সারের পরিমাণ (প্রতি হেক্টরে) | সারের পরিমাণ (প্রতি শতকে) |
টিএসপি | ২৪০ কেজি | ৯৭১ গ্রাম |
ইউরিয়া | ১২৫ কেজি | ৫০৫ গ্রাম |
এমপি | ১২৫ কেজি | ৫০৫ গ্রাম |
জিপসাম | ১২৫ কেজি | ৫০৫ গ্রাম |
বরিক এসিড | ৭ কেজি | ২৮ গ্রাম |
গোবর/কম্পোস্ট | ৬০০০ কেজি | ২৪ কেজি |
সার প্রয়োগের পদ্ধতি-
- গম চাষে পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়।
- জৈবসার প্রয়োগ করার পর শেষ চাষের পূর্বে দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং সম্পূর্ণ টিএসপি (ফসফেট), পটাশ, জিপসাম এবং বোরন সার দিতে হবে। বাকি এক ভাগ ইউরিয়া বপনের ১৭-২১ দিন পর বা চারার তিন পাতা অবস্থায় প্রথম সেচের পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত সার প্রয়োগ করতে হবে।
- জমিতে অম্লমান (pH) ৫.৫ এর কম হলে হেক্টরপ্রতি ১ টন হারে ডলোচুন গম বপনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) সেচ প্রয়োগ
- মাটির প্রকারভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়।
- প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর),
- দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং
- তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে।
চ) আগাছা দমন
- বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দিতে হবে।
- আগাছা দমনের জন্য এফিনিটি নামক আগাছানাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
- প্রথম সেচের পর ‘জো’ এলে বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩০ গ্রাম এফিনিটি পাউডার মিশিয়ে পাঁচ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- সময়মতো আগাছা দমন করলে ফলন ১৫% বৃদ্ধি পায়।
ছ) অন্য জাত বাছাইকরণ বা রোগিং
কোনো নির্দিষ্ট জাতের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণের জন্য বীজ গমের জমি থেকে অন্য জাতের মিশ্রণ, অন্য ফসল ও আগাছা বাছাই করাই হলো রোগিং (Roguing)। বীজ গমের ক্ষেতে শীষ বের হওয়ার পর থেকে শুরু করে গাছ পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত ২-৩ বার রোগিং করতে হবে।
জ) ফসল/বীজ সংগ্রহ
- গম গাছ সম্পূর্ণরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে কাটতে হবে। এ সময় হাতের তালুতে শীষ নিয়ে ঘষলে গমের দানা বের হয়ে আসবে।
- রোদের দিনে সকালের দিকে গম কেটে মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে মাড়াই করা উত্তম।
ঝ) বীজ সংরক্ষণ
- বীজ দানা পর পর ২-৩ দিন রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
- সংরক্ষণের সময় বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে থাকতে হবে।
- বীজ দাঁতে দিয়ে চিবানোর সময় ‘কট’ করে শব্দ করে ভেঙে গেলে বুঝতে হবে যে, উক্ত বীজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত।
- ধাতব বা প্লাস্টিক ড্রাম, পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক বস্তা বীজ সংরক্ষণের জন্য উত্তম।
- বীজ দ্বারা পরিপূর্ণ করে পাত্রের মুখ বায়ুরোধীভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে।
(৩) গম চাষে রোগ/বালাই দমন
ইঁদুর গমের প্রধান শত্রু। শীষ আসার পর গমে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হয়। ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ তবু হলে ফাঁদ পেতে বা হাতে তৈরি বা বাজার থেকে কেনা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানির্যাট) ব্যবহার করে দমন করতে হবে। এসব বিষটোপ সদ্য মাটি তোলা গর্তে বা চলাচলের রাস্তায় পেতে রাখতে হয়। নতুন গর্তে ফসটক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে ইঁদুর দমন করা যায়। তাছাড়া গর্তে পানি বা ধোঁয়া দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়।
গমে ছত্রাকজনিত কয়েকটি রোগ দেখা দিতে পারে। ছত্রাকজনিত রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো রোগ, পাতার মরিচা রোগ, শীষের ব্লাইট রোগ এবং বীজের কালো দাগ রোগ অন্যতম।
পাতা ঝলসানো রোগে প্রথমে নিচের পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকার বাদামি দাগ পড়ে। পরে দাগ আকারে বেড়ে পাতা ঝলসে যায়। পাতার মরিচা রোগে প্রথমে পাতার উপর ছোট ছোট গোলাকার ফোস্কার মতো লালচে বাদামি মরিচা দাগ পড়ে। আক্রান্ত গাছের পাতায় হাত ঘষলে মরিচার মতো গুড়া হাতে লাগে। শীষের রাইট রোগের ফলে আক্রান্ত শীর্ষে সাধারণত ১-২টি স্পাইকলেট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আক্রান্ত স্পাইকলেট ও বীজ কালো রঙ ধারণ করে।
গমের এসব ছত্রাকজনিত রোগ দমনের জন্য নিম্নরূপ পদ্ধতি অনুসরণীয়-
- গমের রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন- বারি গম ২৫, বারি গম ২৬, বারি গম ২৭, বারি গম ২৮, বারি গম ২৯ এবং বারি গম ৩০ ইত্যাদি চাষ করা।
- রোগমুক্ত বীজ বপন।
- উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন।
- অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ, সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা এবং আগাছা দমন।
- যথাযথ ছত্রাক নাশকের মাধমে বীজ শোধনপূর্বক বীজ বপন।
(৪) যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গম চাষ
ক) পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্র
পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে গম চাষ আমন ধান কাটার পর মাটির ‘জো’ অবস্থায়, জমিতে সার নিয়ে এ যন্ত্রের সাহায্যে একই সাথে চাষ, সারিতে বীজ বপন করা যায়।
- এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘণ্টায় এক বিঘা জমিতে গম বপন করা যায়।
- স্বল্প সময়ে বীজ ও কম খরচে গম বীজ বপনের জন্য এ যন্ত্রটির প্রসার হচ্ছে।
খ) পাওয়ারটিলার চালিত বেড প্লান্টার যন্ত্র
পাওয়ারটিলার চালিত বেড প্লান্টার যন্ত্রের সাহায্যে গম চাষ মাটিতে রস থাকা অবস্থায় এ মেশিনের সাহায্যে একই সাথে বেড তৈরি এবং বীজ বপন করা যায়।
- আমন ধান কাটার পর মাটির ‘জো’ অবস্থায় জমিতে সার দিতে হবে।
- তারপর এ মেশিনের সাহায্যে একই সাথে বেড তৈরি এবং প্রতি বেডে দু’টি লাইনে বীজ বপন করা যায়।
- এ পদ্ধতিতে বীজের পরিমাণ ১৫-২০% কম লাগে, ফলন ৫-২০% বেশি হয় এবং সেচের পানি সাশ্রয় হয়।
- এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘণ্টায় ৩০ শতক জমিতে বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে গম বীজ বপন করা সম্ভব।
প্রিয় পাঠক বন্ধু আজকের এই গম চাষ পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনাটি এখানেই সমাপ্ত হচ্ছে। পোষ্টটি কোন উপকারে আসলে আপনার মতামত আপনার যেকোন মূল্যায়ন প্রশ্ন, পরামর্শ বা মতামত কমেন্ট জানালে খুশি হব, এত আমরা উৎসাহ পাই। শেষ অবধি পড়ার জন্য/সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
[সূত্র: এনসিটিবি]