(১) ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতি কী ও কেন?
সারা বিশ্বে ড্রিপ ফার্টিগেশন বহুল ব্যবহৃত একটি আধুনিক সেচ প্রযুক্তি হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি তুলনামূলক নতুন সেচ প্রযুক্তি। এতে পানির সাথে রাসায়নিক সার মিশিয়ে ফসলে প্রয়োগ করা হয়।
কেবলমাত্র পানিতে দ্রবণীয় সার যেমন- ইউরিয়া, পটাশ ইত্যাদি ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়। ফলে ফসলের জমিতে সেচ এবং সার একই সঙ্গে প্রয়োগ করা যায়।
প্রতি ১৪০ লিটার পানিতে ১ কেজি সার মেশাতে হয়। সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিজ্ঞনীগণ উদ্যানতত্ত্ব ফসলের উপর এ পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভাল ফল পেয়েছেন।
ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে সার মিশ্রিত সেচ পানির ব্যবহার:
আমাদের বাংলাদেশে শস্য উৎপাদনে সার এবং পানি আলাদাভাবে জমিতে প্রয়োগ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পানি প্রচলিত সেচের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় বলে চোয়ানো পানির সঙ্গে জমি থেকে সারও বের হয়ে যায়। ফলে সার ও পানি উভয়েরই অপচয় হয়। সার মিশ্রিত সেচের পানি ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচের মাধ্যমে প্রয়োগ করে এই অপচয় কমানো সম্ভব।
- সেচের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা হয় বলে সমস্ত জমি ভেজানোর প্রয়োজন হয় না এবং সেচের পানিও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হয়।
- স্বল্প পরিমাণ পানি বারবার প্রয়োগ করতে হয় বলে এই পদ্ধতিতে পানির চোঁয়ানো তেমন হয় না ঢলে সারের অপচয় হয় না।
- এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ৬০% ইউরিয়া এবং ৩০% এমওপি সার কম লাগে।
- প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এই পদ্ধতিতে প্রায় ৪৮% পানি সাশ্রয় হয়।
- টমেটোর জমিতে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচের মাধ্যমে সার মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করে একজন কৃষক যথেষ্ট লাভবান হতে পারেন।
- ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে ২ থেকে ৩ দিন অন্তর অল্প অল্প পানি সেচ দিতে হবে।
- উন্নতমানের এই সেচ পদ্ধতিতে টমেটো চাষে সাধারণভাবে আয়-ব্যয়ের অনুপাত ২.৭৫ : ১.০০।
- ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতি ৩ শতাংশ জমির জন্য বার্ষিক সেচ খরচ প্রায় ৩৫০ টাকা।
ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:
- ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে ৭০-৭৫ টন বেগুন এবং ৯০-৯৫ টন টমেটো উৎপাদন করা সম্ভব।
- প্রচলিত পদ্ধতি অপেক্ষা এ পদ্ধতিতে ২৮-৩১% ফলন বেশি পাওয়া যায়।
- এ পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ৪৫-৫৫% সার কম লাগে।
- প্রচলিত ফারো এবং প্লাবন সেচ পদ্ধতি অপেক্ষা এ পদ্ধতিতে প্রায় ৪৫-৪৮% পানি কম লাগে।
- প্লাবন বা ফারো সেচ পদ্ধতি অপেক্ষা এ পদ্ধতিতে ‘ব্যাকটেরিয়াজনিত নুয়ে পড়া’ রোগের বিস্তার কম হয়।
- প্রচলিত ফারো পদ্ধতিতে টমেটো এবং বেগুন চাষ করলে হেক্টরপ্রতি নীট মুনাফা ৭০,০০০-৭৫,০০০ এবং ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করলে নীট মুনাফা শীতকালীন টমেটোর চেয়ে ২.০-২.৫ গুণ বেশি পাওয়া যায়।
- শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আম ও কাঁঠালসহ যাবতীয় ফলবাগানে এ প্রযুক্তি অধিকতর কার্যকর।
- খরাপীড়িত ও সেচ সংকট এলাকা, লবণাক্ত অঞ্চল এবং পাহাড়ী অঞ্চল যেখানে সেচের পানির অভাব, সেখানে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতি খুবই উপযোগী।
- বর্তমানে এ উন্নত পদ্ধতির যাবতীয় উপকরণ স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়।
- প্রতি ৫ শতক জমির ফসলের জন্য এই পদ্ধতি স্থাপনের প্রাথমিক খরচ ১০,০০০-১২,০০০ টাকা। তবে এই পদ্ধতির জীবনকাল ৩-৫ বছর হওয়ায় বছরওয়ারী গড় খরচ হবে ২,০০০-২,৫০০ টাকা মাত্র।
(২) গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে সার এবং পানি ব্যবস্থাপনা
ফার্টিগেশন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সেচ প্রযুক্তি যার চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পানিতে দ্রবণীয় সার যেমন ইউরিয়া, পটাশ ইত্যাদি পানির সাথে মিশিয়ে ফসলে প্রয়োগ করা হয়।
এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চাইতে ৩৫-৪০ ভাগ পটাশ, ৫০-৫৫ ভাগ ইউরিয়া ও প্রায় ৫০ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হয়।
সার এবং পানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও ফার্টিগেশন পদ্ধতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে কম সময়ে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব। উন্নত সার এবং পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশে ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে চাষ করলে আশানুরূপ ফলন এবং অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব।
ক) রোপণের সময় এবং পদ্ধতি
- সাধারণত মধ্য জুন গ্রীষ্মকালীন টমেটো রোপণের উপযুক্ত সময়।
- ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা পলিথিন টানেলের বেডে রোপণ করতে হবে। .
- বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য টমেটোর চারা পলি টানেলে রোপণ করতে হয়।
- লাইনে চারা রোপণের জন্য বেডের সাইজ ২.২ মিটার প্রস্থ এবং ৪ মিটার লম্বা হওয়া বা নীয়।
- প্রতি সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫৫ সেমি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০ সেমি হওয়া উচিত।
খ) সারের মাত্রা ও ব্যবহার
- ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ইউরিয়া এবং পটাশ কম লাগে এবং সারের অপচয় হয় না।
- এই পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ২০০ কেজি ইউরিয়া, ২৬৫ কেজি টিএসপি, ২৫০ কেজি পটাশ, ১ কেজি বোরন, ৪ কেজি জিঙ্ক এবং ৪ কেজি ম্যাগনেশিয়াম ব্যবহার করতে হয়।
- ইউরিয়া এবং পটাশ ছাড়া বাকি সারগুলোর সবটুকু জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া এবং পটাশ চারা রোপণের ১৫ দিন, ৩০ দিন, ৪৫ দিন এবং ৬০ দিন পর সমান ৪ (চার) ভাগে সেচের পানির সঙ্গে মিশিয়ে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচের মাধ্যমে ফসলে প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রধান প্রধান রাসায়নিক সারের সাথে গোবর সার (Micro-nutrient) ব্যবহার করলে গুণগতভাবে ফলের আকার ও রং আকর্ষণীয় হয়।
গ) সেচ প্রয়োগ/পদ্ধতি
- ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পানি প্রতি ২ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হয়।
- ভূ-উপরিস্থ পানির বাষ্পায়ন রোধে ধানের খড় মাল্চ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
- সাধারণত প্রতি ১৪০ লিটার পানিতে ১ কেজি সার মিশিয়ে ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সার নিয়মিত সেচের সাথে প্রয়োগ করতে হয়।
ঘ) ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ
- পানির ট্যাংক: প্লাস্টিক বা টিনের তৈরি অথবা মবিলের ড্রাম পানির ট্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতি ৩ (তিন) শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ১৭৫-২০০ লিটার ধারণক্ষমতা সম্পূর্ণ ২ টি ট্যাংকের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি পানির ট্যাংক মাটি হতে ন্যূনতম ৩ ফুট উচ্চতায় স্থাপন করতে বাঁশের চারটি খুঁটি এবং আড়াআড়ি বাশেঁর সাপোর্ট প্রয়োজন হয়।
- পানির ট্যাপ: পানির ট্যাংক থেকে মেইন লাইনে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ছাঁকনি: প্লাস্টিকের তৈরি। পানিতে ময়লা থাকলে তা ছাঁকার কাজে ব্যবহৃত হয়।
টি: পিভিসির তৈরি। - মেইন লাইন: ৩/৪ ইি ব্যাস বিশিষ্ট পিভিসি পাইপ। সাব মেইন: ১/২ ইি ব্যাস বিশিষ্ট পিভিসি পাইপ।
- জয়েন্টার: মেইন লাইন ও সাব মেইন লাইনের মধ্যে সংযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। পিভিসির তৈরি।
- মাইক্রোটিউব: ০.২৫ সেমি ব্যাসের প্লাস্টিক পাইপ।
- কানেক্টর: মাইক্রোটিউব ও সাব মেইনের সংযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ড্রিপার: গাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। পিভিসির তৈরি।
ঙ) এই সেচ পদ্ধতিতে টমেটো চাষের সুবিধা
- ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০-৪০ টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদন করা সম্ভব, যা প্রচলিত পদ্ধতির চাইতে প্রায় ৩০-৩২ ভাগ বেশি।
- এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে শতকরা ৪৫-৫৫ ভাগ সার কম লাগে এবং ৪০-৪৫ ভাগ সেচের পানি কম লাগে।
- এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল গুণগতমান ভাল হওয়ার কারণে বাজার মূল্য বেশি পাওয়া যায়।
- ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করলে হেক্টর প্রতি নীট মুনাফা শীতকালীন টমেটো চাইতে ২.০-২.৫ গুণ বেশি পাওয়া যায়।
- খড়াপীড়িত ও সেচ সংকট এলাকা, লবণাক্ত অঞ্চলে এবং পাহাড়ী অঞ্চলে যেখানে সেচের পানির অভাব, সেখানে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ খুবই উপযোগী সেচ পদ্ধতি।
- বর্তমানে এ উন্নত পদ্ধতির যাবতীয় উপকরণ স্থানীয়ভাবে তৈরি করা যায়।
(৩) স্বল্প মূল্যের ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতি তৈরি
বাড়ির আশেপাশের ফল বা সবজি বাগানে ছোটখাটো জমিতে সেচ প্রদানের জন্য স্বল্প মূল্যে এ ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এই সেচ পদ্ধতি গরিব চাষীদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
- পদ্ধতিটি ১.২৭ সেমি ব্যাসের পিভিসি পাইপ দিয়ে তৈরি যার মাধ্যমে জমিতে পানি পরিবহন ও প্রয়োগ করা হয়।
- পাইপের গায়ে ৪০ সেমি পরপর ১ মিমি ব্যাসের ছিদ্র করা হয় যেগুলো পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচানো থাকে।
- ছিদ্রগুলোর মধ্যকার দূরত্ব ফসলভেদে ভিন্নতর হতে পারে।
- পাইপ পদ্ধতিটি ৯০-১২০ সেমি উঁচুতে স্থাপিত পানির ট্যাংকের সাথে যুক্ত থাকে।
- ট্যাংক থেকে পাইপের মাধ্যমে সেচ প্রদানের সময় একটি নিয়ন্ত্রক ভাল্বের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- এ ধরনের সেচ পদ্ধতিতে প্রচলিত নালা পদ্ধতির চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ পানি কম লাগে।
- স্বল্পমূল্যের এ ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে কম সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
- জমির পরিমাণের উপর নির্ভর করে সেচ পদ্ধতির দামেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে ০.১০ হেক্টর জমির জন্য প্রায় ৩,০০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ) মূল্যের ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতির প্রয়োজন।
- এই সেচ পদ্ধতির আয়ুষ্কাল প্রাথমিকভাবে ৫ বছর। তবে ভালভাবে মেরামত বা কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে তা বাড়ানো সম্ভব।
[সূত্র: বিএআরআই]