চন্দ্রমল্লিকা সর্বত্র চাষ উপযোগী শীতকালীন মৌসুমী ফুল। পট প্লান্ট হিসেবে ব্যবহার সর্বাধিক তবে কাট-ফ্লাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
(১) চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বৈশিষ্ট্য ও জাত পরিচিতি
ক) বারি চন্দ্রমল্লিকান্ড-১
- বারি চন্দ্রমল্লিকান্ড-১ একটি শীতকালীন মৌসুমী ফুলের জাত।
- গাছ মাঝারী আকৃতির এবং উচ্চতা ৩০-৩৫ সেমি।
- পাতা হালকা সবুজ এবং সব অঞ্চলে জাতটি চাষের উপযোগী। তবে উঁচু, সুনিষ্কাশিত বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভাল জন্মে।
- সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
- ২০-২৫ দিনের চারা মাঠে বা পটে লাগানো হয়।
- ডিসেম্বরে ফুল আসতে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকে।
- ফুলের রং হলুদ এবং ‘এনিমোন’ প্রকৃতির।
- প্রতি গাছে ৩০-৩৫টি ফুল উৎপাদিত হয়।
- ফুলের সজীবতা ৯-১০ দিন থাকে।
- রোগবালাই সহিষ্ণু তবে প্রয়োজনে পরিমিত মাত্রায় নির্দিষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
খ) বারি চন্দ্রমল্লিকা-২
- দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী শীতকালীন মৌসুমী ফুলের জাত।
- গাছের গড় উচ্চতা ৪০ সেমি।
- পাতার রঙ হালকা সবুজ।
- সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
- ২০-২৫ দিনের চারা মাঠে বা পটে লাগানো হয়।
- ডিসেম্বরে ফুল আসতে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকে।
- গাছপ্রতি গড়ে ৩৫-৪০টি ফুল ধরে।
- ফুলের রং সাদা এবং ৭ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট।
- ফুলের সজীবতা ১২-১৪ দিন।
- রোগবালাই সহিষ্ণু তবে প্রয়োজনে পরিমিত মাত্রায় নির্দিষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ) বারি চন্দ্রমল্লিকা-৩
- গাছের গড় উচ্চতা ৩৫ সেন্টিমিটার।
- পাতার রং হালকা সবুজ। ফুলের রং মেজেন্টা।
- প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফুল উৎপাদিত হয়।
- পটে ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় ১০-১২ দিন থাকে।
ঘ) বারি চন্দ্রমল্লিকা-৪
- গাছের গড় উচ্চতা ৪০ সেন্টিমিটার।
- পাতার রং হালকা সবুজ। ফুলের রং টকটকে লাল।
- প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফুল উৎপাদিত হয়।
- পটে ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় ১০-১২ দিন থাকে।
(২) চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষ পদ্ধতি
ক) জলবায়ু ও মাটি
চন্দ্রমল্লিকা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রৌদ্রজ্জ্বল জায়গা পছন্দ করে। বাংলাদেশে শীতকালই এ ফুল চাষের উত্তম সময়।
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি এ ফুল চাষের জন্য উপযোগী।
মাটির pH মান ৬.০-৭.০ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
খ) চারা তৈরি
- বীজ, সাকার ও শাখা কলম থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়। বীজ থেকে চারা করলে তা থেকে ভাল মানের ফুল পাওয়া যায় না এবং ফুল পেতে অনেক দিন সময় লাগে। সেক্ষেত্রে শাখা কলম/সাকার থেকে চারা তৈরি করে জমিতে লাগালে এ সমস্যা থাকে না।
- সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে চন্দ্রমল্লিকার চাষ করতে হলে সাকার থেকে চারা তৈরি করা উত্তম।
- ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে ফুল দেয়া শেষ হলে গাছগুলোকে মাটির উপর থেকে ১৫-২০ সেমি রেখে কেটে দেয়া হয়। কিছুদিন পর গাছের গোড়া থেকে সাকার বের হতে থাকে।
- এ সাকারগুলি ৫-৭ সেমি লম্বা হলে মাতৃগাছ থেকে আলাদা করে টবে/বীজতলায় লাগাতে হবে।
- টবে লাগানোর ক্ষেত্রে প্রথমে সাকারগুলি থেকে গোড়ার পাতা ছাটাই করে ১০ সেমি ব্যাসের ছোট টবে লাগাতে হবে।
- টবের মিশ্রণে থাকবে ১ ভাগ বালি, ১ ভাগ মাটি, ১ ভাগ পাতাপচা সার ও সামান্য কাঠের ছাই। এগুলো ভালভাবে মিশিয়ে টব ভর্তি করে সাকার লাগানো হলে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে শিকড় আসা শুরু হয়।
- এপ্রিল-মে মাসের শেষ দিকে শিকড়সহ চারা দ্বিতীয়বারের মতো ১৫ সেমি ব্যাসের টবে স্থানান্তর করতে হয়। এ পর্যায়ে টবের মিশ্রণে থাকবে ১ ভাগ বালি, ১ ভাগ মাটি, ২ ভাগ পাতাপচা সার, ১/৪ ভাগ কাঠের ছাই এবং ১ টেবিল চামচ হাড়ের গুঁড়া।
- তৃতীয় বা শেষ বারের মতো চারাগুলিকে ২৫-৩০ সেমি ব্যাসের বড় টবে স্থানান্তর করতে হয়। এ পর্যায়ে টবের মিশ্রণে থাকবে ১ ভাগ বালি, ১ ভাগ মাটি, ২ ভাগ পাতা পচা সার, ১/৪ ভাগ কাঠের ছাই এবং ২ টেবিল চামচ হাড়ের গুঁড়া।
- জুন-জুলাই মাসে ছোট ছোট চারাগুলিকে কড়া রৌদ্র ও অতিরিক্ত বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে হয় এবং টবগুলিকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন যথেষ্ট পরিমাণ আলো-বাতাস পায়।
গ) চারা রোপণ
জমি কিংবা টবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবর-নভেম্বর জমিতে ৩০ ⨉ ২০ সেমি অন্তর অন্তর চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করা উত্তম।
(৩) চন্দ্রমল্লিকা গাছের পরিচর্যা
ক) সার প্রয়োগ
মাঠে বা জমিতে:
জমি তৈরির পর হেক্টরপ্রতি ৮-১০ টন পচা গোবর, ৩৭৫ কেজি টিএসপি, ২৭০ কেজি এমওপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ৩২০ কেজি ইউরিয়া সারের অর্ধেক ১৬০ কেজি চারা রোপণের ১ মাস পর গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য এবং বাকি অর্ধেক ১৬০ কেজি ফুলের কুঁড়ি আসার সময় উপরি প্রয়োগ করা উচিত।
পটে বা টবে:
পটে জন্মানোর জন্য ২ ভাগ মাটি, ২ ভাগ গোবর সার, ১ ভাগ পাতা পচা সার ও ১ ভাগ হাড়ের গুঁড়ার সাথে ৩ গ্রাম টিএসপি, ৩ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ এর মিশ্রণ ব্যবহার করা উত্তম। ৮ গ্রাম ইউরিয়া সারের অর্ধেক সাকার/কাটিং রোপণের ২৫-৩০ দিন পর গাছের দৈহিক বৃদ্ধির সময় এবং বাকি অর্ধেক ফুলের কুড়ি আসার সময় উপরি প্রয়োগ করা উচিত।
খ) শাখা ভাঙ্গা ও কুঁড়ি অপসারণ
শাখা ভাঙ্গা:
কান্ডের আগার অংশ কেটে ফেলাকে শাখা ভাঙ্গা বা পিনচিং বলে। সাধারণত চারা লাগানোর ২৫-৩০ দিন পর পিনচিং করলে গাছটি ঝোপালো হয় এবং অধিক ফুল পাওয়া যায়।
কুঁড়ি অপসারণ:
অনাকাঙ্খিত অপরিপক্ক ফুলের কুঁড়ি অপসারণ কার্যক্রমকে কুঁড়ি অপসারণ বলা হয়। মুকুট কুঁড়িগুলিকে রেখে অবশিষ্ট কুঁড়িগুলি অপসারণ করলে বড় আকারের ফুল পাওয়া যায়।
গ) ঠেস দেয়া
চন্দ্রমল্লিকার ফুল সাধারণত ডালপালার তুলনায় ভারী ও বড় হয়। তাই গাছের গোড়া থেকে কুঁড়ি পর্যন্ত একটা শক্ত কাঠি পুঁতে দিতে হয়। এতে ফুল নুয়ে পড়বে না। চারা লাগানোর সময় কাঠি একবারই পুঁতে দেয়া ভাল। এজন্য জাত বুঝে চন্দ্রমল্লিকা গাছের উচ্চতা অনুযায়ী বাঁশের কাঠি চারার গোড়া থেকে একটু দূরে পুঁতে দিতে হবে। একবারে গোড়ায় পুঁতলে বা গাছ বড় হয়ে যাওয়ার পর পুঁতলে অনেক সময় শিকড়ের ক্ষতি হতে পারে, এমনকি শিকড়ে ক্ষত সৃষ্টি হলে রোগ জীবাণু ক্ষতের মাধ্যমে গাছে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
ঘ) সেচ
চন্দ্রমল্লিকার চারা লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হবে। চন্দ্রমল্লিকা গাছ কখনো বেশি পানি সইতে পারেনা। তাই পানি এমনভাবে দিতে হবে যেন গোড়ায় বেশিক্ষণ পানি জমে না থাকে। চারা রোপণের পূর্বে এবং পরে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পরিমাণমত পানি সেচ দেয়া জরুরি।
ঙ) ফুল সংগ্রহ ও ফলন
চন্দ্রমল্লিকা ফুল কুড়ি অবস্থায় তুললে ফুটে না। বাইরের পাঁপড়িগুলো স¤পূর্ণ খুলে গিয়েছে এবং মাঝের পাঁপড়িগুলো ফুটতে শুরু করেছে এমন অবস্থায় ধারালো ছুরি দিয়ে খুব সকালে অথবা বিকেলে দীর্ঘ বোঁটাসহ ফুল তোলা উচিৎ।
গাছ প্রতি গড়ে বছরে ২০-২৫ টি ফুল পাওয়া যায়।
(৪) চন্দ্রমল্লিকা চাষে রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত পাউডারী মিলডিউ ও পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা যায়।
ক) পাউডারী মিলডিউ
এ রোগ হলে গাছের পাতার উপর সাদা থেকে ধূসর গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে এবং আস্তে আস্তে পাতা কুকড়িয়ে বিকৃতাকার হয়ে যায়। বেশি আক্রমণে পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
দমন ব্যবস্থা:
- এ রোগ দমনে মাঠে যথাযথ রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
- তাছাড়া এ রোগ দমনে আক্রমণের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে অটোস্টিন (০.২%) বা সালটাফ (০.২%) ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
খ) রাস্ট
এ রোগের আক্রমণে পাতার নিচের দিকে বাদামী ফুসকুড়ি সৃষ্টি হয় এবং পাতার উপরের দিকে হলদে সবুজ দাগ দেখা দেয়। মারাত্মক আক্রমণে পাতার অধিকাংশ এলাকা নষ্ট হয়ে পাতা ঝরে পড়তে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ফুল উৎপাদন ব্যাপকহারে হ্রাস পায়।
দমন ব্যবস্থা:
- এ রোগ দমনে আক্রান্ত পাতা আপসারণ করতে হবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
- তাছাড়া ফলিকিউর (০.১%) স্প্রে করা যেতে পারে।
গ) পাতায় দাগ পড়া
এ রোগের আক্রমণে প্রথমে নিচের পাতায় হলদে দাগ পড়ে এবং আক্রমণের মাত্রার উপর নির্ভর করে বাদামী থেকে কালো দাগে পরিণত হয়।
দমন ব্যবস্থা:
এ রোগ দমনে অটোস্টিন বা বেনলেট (০.১%) স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
ঘ) গ্রে মোল্ড
এ রোগের আক্রমণে ফুলের পাঁপড়ি, পাতা এমনকি কান্ডেও বাদামী পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছে ধূসর থেকে বাদামী পাউডারের মত আস্তরণ পড়ে। দীর্ঘকালীন আর্দ্র ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে খুবই সহায়ক।
দমন ব্যবস্থা:
এ রোগ দমনে যথাযথ রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছকে পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সে সাথে রোভরাল (০.২%) স্প্রে করা যেতে পারে।
ঘ) জাবপোকা
চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত জাব পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
এ পোকা খুব ছোট আকৃতির, নরম ও কালো-সবুজ বর্ণের। শীতকালে এর প্রকোপ খুব বেড়ে যায়। এ পোকা গাছের পাতা, ডগা এবং ফুল থেকে রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। আক্রান্ত নতুন কুঁড়ি ও পাতা কুঁকড়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা:
- এ পোকা দমনে প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত পাতা বা ফুল ছিঁড়ে ফেলে পোকাসহ ধ্বংস করা উচিত।
- হলুদ রঙের আঁঠালো ফাঁদ ব্যবহার করেও ভাল ফল পাওয়া যায়।
- সাবান গুঁড়া ৫ গ্রাম/লিটার হারে পনিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যেতে পারে।
- আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেথয়েট জাতীয় কীটনাশক (পারফেকথিয়ন/সানগর/টাফগর ৪০ ইসি) ২.০ মিলি./লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
(৫) চন্দ্রমল্লিকা ফুলের হাইড্রোপনিক চাষ
এ পদ্ধতিতে সাধারণত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝী সময় চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। চারার বয়স যখন ৩-৪ সপ্তাহ কিংবা চারা যখন ২-৩ পাতা অবস্থায় আসে তখন একই পদ্ধতিতে চন্দ্রমল্লিকার চারা রোপণ করতে হয়।
চন্দ্রমল্লিকা অম্ল (এসিড) পছন্দকারী ফুল শস্য বিধায় এর pH মান ৫.৫-৬.৫ এর মাঝামাঝী রাখতে হয়।
গাছের দৈহিক বৃদ্ধির পর্যায়ে EC এর মান ১.০-১.৫ এবং ফুল আসার সময় তা বাড়িয়ে ১.৫-২.০ dS/m এর মধ্যে রাখতে হবে।
গাছে বেশি ফুল পেতে চাইলে পিনচিং পদ্ধতিতে গাছের ডগা কেটে দিতে হবে। এতে গাছে ডালপালা ও ফুল বেশি হয়।
গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে উপর থেকে সুতা বা শক্ত রশি ঝুলিয়ে গাছকে সোজা ও খাড়া রাখতে হয়।
সাধারণত চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। প্রতিটি গাছ থেকে ২০-২৫ টি ফুল পাওয়া যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]