(১) চিচিঙ্গার জাত পরিচিতি
বারি চিচিঙ্গা-১:
- ‘বারি চিচিঙ্গা-১’ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং সারা দেশে চাষ উপযোগী।
- প্রতি গাছে ৬৫-৭০টি চিচিঙ্গা পাওয়া যায় এবং প্রতি চিচিঙ্গার গড় ওজন ১৩০-১৪০ গ্রাম হয়ে থাকে।
- ফল সাধারণত ১৬০-১৭০ দিন পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর।
(২) চিচিঙ্গা চাষের নিয়ম ও পদ্ধতি
ক) উৎপাদন মৌসুম
বাংলাদেশে চিচিঙ্গা প্রধানত খরিফ মৌসুমেই চাষ হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে।
খ) বীজের হার
চিচিঙ্গার জন্য হেক্টরপ্রতি ৪-৫ কেজি (১৬-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়।
গ) জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি
- খরিফ মৌসুমে চাষ হয় বলে চিচিঙ্গার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পানি জমার সম্ভাবনা নেই।
- বসতবাড়িতে চাষ করতে হলে দু-চারটি মাদায় বীজ বুনে গাছ বেয়ে উঠতে পারে এমন ব্যবস্থা করলেই হয়।
- বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয় যাতে শিকড় সহজেই ছড়াতে পারে।
- জমি বড় হলে নির্দিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বায় কয়েক ভাগে ভাগ কর নিতে হয়।
- বেডের প্রস্থ হবে ১.০ মিটার এবং দু-বেডের মাঝে ৩০ সেমি নালা থাকবে।
- চিচিঙ্গার বীজ সরাসরি মাদায় বোনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন করতে হবে।
- তাছাড়া পলিব্যাগে (১০×১২ সেমি) ১৫-২০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করে নেওয়া যেতে পারে।
- চিচিঙ্গার জন্য ১.৫ মিটার দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে।
- চারা গজানোর পর একের অধিক গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে।
- বীজের ত্বক শক্ত ও পুরু বিধায় বোনার পূর্বে বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে বীজ তাড়াতাড়ি অঙ্কুরিত হয়।
- মাদায় বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতে হলে অন্তত ১০ দিন আগে মাদায় নির্ধারিত সার প্রয়োগ করে তৈরি করে নিতে হবে।
- মাদার আয়তন হবে ৪০×৪০×৪০ সেমি।
ঘ) সারের প্রয়োগ পদ্ধতি ও পরিমাণ
সার প্রয়োগ পদ্ধতি: মাদায় চারা রোপণের পূর্বে, সার দেয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। অতঃপর মাটিতে ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।
সারের পরিমাণ: চিচিঙ্গার জমিতে নিম্ন বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে (প্রতি শতকে ২০টি মাদা হিসেবে)।
সারের নাম | মোট পরিমাণ (হেক্টরপ্রতি) | মোট পরিমাণ (শতাংশ প্রতি) | জমি তৈরির সময় (শতাংশ প্রতি) | মাদাপ্রতি: চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে | মাদাপ্রতি: চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর | মাদাপ্রতি: চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর | মাদাপ্রতি: চারা রোপণের ৫০-৫৫ দিন পর | মাদাপ্রতি: চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর |
পচা গোবর | ১০ টন | ৪০ কেজি | ২০ কেজি | ১ কেজি | – | – | – | – |
টিএসপি | ১৭৫ কেজি | ৭০০ গ্রাম | ৩৫০ গ্রাম | ১৮ গ্রাম | – | – | – | – |
ইউরিয়া | ১৭৫ কেজি | ৭০০ গ্রাম | – | – | ১০ গ্রাম | ১০ গ্রাম | ১০ গ্রাম | ৫ গ্রাম |
এমপি | ১৫০ কেজি | ৬০০ গ্রাম | ২০০ গ্রাম | ১০ গ্রাম | ১০ গ্রাম | – | – | – |
জিপসাম | ১০০ কেজি | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
দস্তা সার | ১২.৫ কেজি | ৫০ গ্রাম | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
বোরাক্স | ১০ কেজি | ৪০ গ্রাম | ৪০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট | ৬০ কেজি | ২৪০ গ্রাম | ২৪০ গ্রাম | ১২ গ্রাম | – | – | – | – |
ঙ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- সময়মতো নিড়ানি দিয়ে আগাছা সমসময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে।
- পানির অভাব হলে গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন অবস্থায় এর লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরবর্তীকালে ফুল ঝরে যাওয়া, ফলের বৃদ্ধি বন্ধ হওয়া ও ঝরে যাওয়া ইত্যাদি।
- চিচিঙ্গার বীজ উৎপাদনের সময় খেয়াল রাখতে হবে ফল পরিপক্ক হওয়া শুরু হলে সেচ দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
- বাউনি দেয়া চিচিঙ্গার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মিটার উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে এবং বাউনীর ব্যবস্থা করতে হবে। বাউনি দিলে ফলন বেশি ও ফলের গুণগত মান ভাল হয়।
- গাছের গোড়া থেকে ডালপালা বের হলে সেগুলো কেটে দিতে হয় এতে গোড়া পরিষ্কার থাকে, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উৎপাত কম হয়।
- জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না।
- জমির পানি নিকাশ নিশ্চিত করার জন্য বেড ও নিকাশ নালা সর্বদা পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
চ) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গার গাছ ফল দিতে থাকে।
- স্ত্রী ফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
- কচি ও খাওয়ার উপযোগী পুষ্ট অবস্থায় ২-৩ দিন পর পর ফল সংগ্রহ করতে হয়।
- ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন (১০০-১২০ কেজি/শতাংশ) পাওয়া যায়।
(৩) চিচিঙ্গা চাষে পোকামাকড় ও প্রতিকার
ক) ফলের মাছি পোকা
ক্ষতির ধরন:
স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাঁস খায়, ফল পচে যায় এবং অকালে ঝরে পড়ে।
প্রতিকার:
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ এবং আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার করে পোকা ভালোভাবে দমন করা যায়।
- বিষটোপের জন্য থেতলানো ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিষটোপ ৩-৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়।
খ) পামকিন বিটল
ক্ষতির ধরন:
পূর্ণাঙ্গ পোকা চারা গাছের পাতায় ছিদ্র করে খায়। কীড়া গাছের গোড়ায় মাটিতে বাস করে এবং গাছের শিকড়ের ক্ষতি করে, বড় গাছ মেরে ফেলতে পারে।
প্রতিকার:
- আক্রান্ত গাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ পোকা হাতে ধরে মেরে ফেলা।
- চারা অবস্থায় ২০-২৫ দিন চারা মশারির জাল দিয়ে ঢেকে রাখা।
- প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সেভিন/কার্বারিল-৮৫ ডব্লিউপি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- কীড়া দমনের জন্য প্রতি গাছের গোড়ায় ২-৫ গ্রাম বাসুডিন/ডায়াজিনন-১০ জি মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
গ) এপিল্যাকনা বিটল
ক্ষতির ধরন:
পাতায় সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত পাতাগুলো বিবর্ণের মত দেখায়, পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে এবং গাছ পাতাশূন্য হতে পারে।
প্রতিকার:
প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম কার্বারিল-৮৫/সেভিন ডব্লিউপি অথবা ২ মিলি সুমিথিয়ন/ফলিথিয়ন-৫০ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ঘ) জাব পোকা
ক্ষতির ধরন:
জাব পোকা দলবদ্ধভাবে পাতার রস চুষে খায়। ফলে বাড়ন্ত ডগা ও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পাতা বিকৃত হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং পাতা নিচের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়।
প্রতিকার:
- আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
- নিম বীজের দ্রবণ (কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান গুলা পানি (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুঁড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়।
- লেডীবার্ড বিটলের পূর্ণাঙ্গ পোকা ও কীড়া এবং সিরফিড্ ফ্লাই-এর কীড়া জাব পোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে দমন করে। সুতরাং উপরোক্ত বন্ধু পোকাসমূহ সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে অথবা পিরিমর ৫০ ডিপি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
(৪) চিচিঙ্গা চাষে রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা
ক) পাউডারী মিলডিউ বা গাদা গুঁড়া রোগ
লক্ষণ:
পাতার উভয় পাশে প্রথমে সাদা সাদা পাউডার বা গুঁড়া দেখা যায়। ধীরে ধীরে এ দাগগুলো বড় হয়। ফলে গাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া দাগগুলো বাদামী হয়ে শুকিয়ে যায়।
কোন একটি লতার পাতায় আক্রমণ বেশি হলে ধীরে ধীরে সেই লতা ও পরে পুরো গাছই মরে যেতে পারে। এমনিক ফল ঝরে যেতে পারে। যদি আগাম চাষ কার হয় তবে এ রোগের লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার:
- এ রোগের প্রতিকারের জন্য আক্রান্ত পাতা ও গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- তাছাড়া ২ গ্রাম থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউপি অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা সালফোলাক্স/কুমুলাস ০.৫ মিলি অথবা ১ গ্রাম ক্যালিক্সিন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
খ) অ্যানথ্রাকনোজ বা ফলপচা
লক্ষণ:
পাতায় গোলাকৃতি দাগ দেখা যায়। বৃষ্টিতে পাতার পচন লক্ষ করা যায়। প্রথমে ছোট কালো দাগ যার মধ্যাংশ ছত্রাকের জালি ও অণুজীব দ্বারা ঢাকা থাকে। আক্রান্ত ফলের বীজও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।
প্রতিকার:
- রোগমুক্ত ভাল বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- ঝরণা দিয়ে গাছে পানি বা সেচ দেওয়া যাবে না।
- অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অটোস্টিন/নোইন বা একোনাজল আক্রমণের শুরুতেই ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- চিচিঙ্গার বীজ-ফলে অব্যশই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে বীজ রোগমুক্ত রাখতে হবে।
গ) মোজাইক ভাইরাস
লক্ষণ:
পাতায় হলদে ছোপ ছোপ দেখা দেয় ও পাতা কুকড়ে যায়। ফলে ফলন বহুলাংশে কমে যায়।
প্রতিকার:
ভাইরাস দেখা মাত্র আক্রান্ত গাছ ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]