চীনাবাদাম একটি অর্থকরী ও উৎকৃষ্ট গুণাগুণ সম্পন্ন তৈল জাতীয় ফসল। চরাঞ্চলে সাধারণত বাদামের চাষ করা হয়। আমাদের বাংলাদেশে বাদাম সাধারণত কনফেকশনারী আইটেম ও ভাজা বাদাম হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
চীনাবাদাম বীজে শতকরা ৪৮-৫২ ভাগ তেল এবং ২৪-২৬ ভাগ আমিষ থাকে।
(১) চীনাবাদামের জাত
ক) মাইজচর বাদাম (ঢাকান্ড১)
‘মাইজচর বাদাম’ (ঢাকান্ড১) জাত ১৯৭৬ সালে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন করা হয়।
- গাছের উচ্চতা ৩০-৪০ সেমি। গাছ খাড়া এবং প্রতি গাছে ৬-৭টি শাখা থাকে। পাতার রং হালকা সবুজ।
- প্রতি বাদামে দানার সংখ্যা ১-২টি। দানার আকার মধ্যম, গোলাকর এবং রং হালকা বাদামী।
- বীজের সুপ্তিকাল নগণ্য।
- জাতটি আবাদ করতে রবি মৌসুমে ১৪০-১৫০ দিনএবং খরিফ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন সময় লাগে।
- ফলন রবি মৌসুমে প্রতি হেক্টরে ১.৮-২.০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ১.৬-১.৮ টন।
- দেশের অধিকাংশ এলাকাতে মাইজচর বাদামের চাষ হয়ে থাকে।
- বর্তমানে জাতটি রোগবালাই ও পোকামাকড় দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। ফলে চাষাবাদে জাতটি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
খ) বাসন্তী বাদাম (ডিজি-২)
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বাসন্তী বাদাম’ বা ডিজি-২ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়।
- গাছের উচ্চতা ৩০-৩৫ সেমি এবং আকৃতি অল্প ছড়ানো। প্রতি গাছে ৮-১০টি শাখা থাকে। পাতার রং গাঢ় সবুজ।
- প্রতিটি বাদামে বীজের সংখ্যা ১-২টি। বীজের আকার বড়, লম্বা এবং রং লালচে বাদামী।
- ফসল পাকার পর ৩০-৪৫ দিন পর্যন্ত এ জাতের বীজের সুপ্ততা থাকে। তাই ফসল কাটার পূর্বে আগাম বন্যা বা বৃষ্টির পানি পেলেও বীজ জমিতে গজিয়ে যায় না।
- বাসন্তী বাদামের জীবনকাল ১৫০-১৬০ দিন।
- মাঘ-ফাল্গুন (মধ্য-জানুয়ারি থেকে মধ্য-মার্চ) মাসে এ জাতটি বপন করে প্রতি হেক্টরে ২.০-২.২ টন ফলন পাওয়া যায়।
- এ জাত গোড়া ও কান্ড পচা রোগ এবং পাতার দাগ রোগ সহনশীল ও প্রতিরোধী।
- বাংলাদেশে নদীর চরাঞ্চলে ও মাঝারি উঁচু জমিতে এর ফলন ভাল হয়।
গ) ঝিঙ্গা বাদাম (এসিসি-১২)
‘ঝিঙ্গা বাদাম’ বা এসিসি-১২ জাতটি ১৯৮৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- গাছের উচ্চতা ৩৫-৫০ সেমি। গাছ খাড়া। প্রতি গাছে ৫-৮টি শাখা থাকে। পাতার রং হালকা সবুজ।
- প্রতিটি বাদামে বীজের সংখ্যা ২-৪ টি। বীজের আকার মধ্যম, চ্যাপ্টা এবং রং হালকা বাদামী। ১০০ বীজের ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম।
- ফসলের জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫৫ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১৩০-১৪০ দিন।
- কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-ডিসেম্বর) বীজ বপন করলে ফলন হেক্টরপ্রতি ২.৪-২.৬ টন পাওয়া যায়।
- জাতটি বেশ খরা সহনশীল।
ঘ) ত্রিদানা বাদাম (ডিএম-১)
‘ত্রিদানা বাদাম’ (ডিএম-১) জাতটি মিউটেশনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৮৭ সালে অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ১০-১২ সেমি। প্রতি গাছে ৬-৭টি শাখা থাকে। পাতার রং গাঢ় সবুজ।
- প্রতিটি বাদামে বীজের সংখ্যা ১-৪টি। বীজের আকার মধ্যম, লম্বা এবং গাঢ় লাল। ১০০ বীজের ওজন ২৬-২৮ গ্রাম।
- বীজের সুপ্তিকাল নাই।
- ফসলের জীবনকাল ১০৫-১১৫ দিন।
- জাতটি ফাল্গুন (মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য-মার্চ) মাসে বপন করে ফলন হেক্টরপ্রতি ২.২-২.৪ টন পাওয়া যায়।
- ত্রিদানা বাদামের গাছ খাটো হওয়ায় ভুট্টা ও ইক্ষুর সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদের জন্য সুবিধাজনক।
ঙ) বারি চীনাবাদাম-৫
‘ঢাকান্ড১’ জাত থেকে মিউটেশন করে ‘চীনাবাদাম-৫’ উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৯৯ সালে অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি। গাছ খাড়া ও গুচ্ছাকার। পাতার রং হালকা সবুজ3
- শাখা প্রশাখায় ফুল হয়। প্রতি বাদামে বীজের সংখ্যা ১-২টি। বাদামের শিরা উপশিরা খুব স্পষ্ট, বীজের আকার বড়। ১০০ বীজের ওজন ৪৮-৫০ গ্রাম।
- বীজের সুপ্তিকাল ১০-১৫ দিন। বীজে তেলের পরিমাণ ৫১-৫২%। আমিষের পরিমাণ ২৫-২৭%।
- ফসলের জীবন কাল রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪৫ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১১৫-১২৫ দিন।
- হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ২.৭০-৩.১০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২.০-২.৫ টন।
চ) বারি চীনাবাদাম-৬
বিভিন্ন বিদেশি প্রজাতি হতে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি চীনাবাদাম-৬’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৯৯ সালে অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি। গাছ খাড়া ও গুচ্ছাকৃতির হয়। পাতার রং গাঢ় সবুজ।
- চীনাবাদামের খোসার উপরিভাগ মসৃণ, পাতলা। শিরা, উপশিরা অস্পষ্ট।
- বীজের রং হালকা বাদামী। ১০০ বীজের ওজন ৫০-৫৫ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০-৫২%। আমিষের পরিমাণ ২৫-২৬%।
- ফসলের জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০-১৫০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন।
- হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ২.৫-২.৮ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২-২.৪ টন।
চ) বারি চীনাবাদাম-৭
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাছাই প্রক্রিয়ায় ‘বারি চীনাবাদাম-৭’ জাতটি বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য ২০০৪ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫৫ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১৩০-১৪০ দিন।
- ফলন রবি মৌসুমে প্রতি হেক্টরে ২.৮-৩.০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ১.৮-২.০ টন।
- বাদামের খোসা মসৃণ ও কিছুটা সাদাটে ও নরম। বীজের সুপ্ততা নেই। পাতায় দাগ পড়া ও মরিচা রোগ তুলনামূলকভাবে কম হয়।
জ) বারি চীনাবাদাম-৮
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ‘বারি চীনাবাদাম-৮’ জাতটি ২০০৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০-১৫০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১২৫-১৪০ দিন।
- গাছের উচ্চতা ৩৫-৪২ সেমি। প্রতি গাছে বাদামের সংখ্যা ২০-২৫টি। বাদামগুলো ‘ঢাকান্ড১’ জাতের মতো থোকায় থোকায় জন্মে।
- বীজের আকার মাঝারি, বীজের রং লালচে। ১০০ বাদামের (খোসা ছাড়ানো) ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। শতকরা সেলিং হার ৬৫-৭০।
- ফলন প্রতি হেক্টরে ২.৫ টন।
ঝ) বারি চীনাবাদাম-৯
‘বারি চীনাবাদাম-৯’ জাতটি ওঈজওঝঅঞ, ভারত থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০১০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। জাতটি স্প্যানিশ শ্রেণিভুক্ত।
- বাংলাদেশের সর্বত্র রবি ও খরিফ মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী। রবি মৌসুমে মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর বপনের উপযুক্ত সময়। খরিফ-২ মৌসুমে জুলাই থেকে আগস্ট মাসে চাষ করা যায়।
- বপন সময় থেকে পরিপক্ক পর্যন্ত রবি মৌসুমে ১৪০-১৫০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন সময় লাগে।
- ‘বারি চীনাবাদাম-৯’ জাতটি ‘বারি চীনাবাদাম-৬’ ও ‘বারি চীনাবাদাম-৭’ অপেক্ষা ৫-৭ দিন আগে পরিপক্ক হয়।
- গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের (৪০-৪৫ সেমি)। প্রতিটি গাছ থেকে ২০-২২টি পুষ্ট বাদাম পাওয়া যায়।
- বাদামের খোসা কিছুটা অমসৃণ ও শিরা উপশিরাগুলো স্পষ্ট।
- বীজের আকার মাঝারি এবং রং হালকা বাদামী। ১০০ বীজের ওজন ৪৫-৪৭ গ্রাম।
- জাতটির প্রতি হেক্টরে ফলন ২.৫-২.৮ টন।
ঞ) বারি চীনাবাদাম-১০ (উফশী)
‘বারি চীনাবাদাম-১০’ জাতটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ICRISAT (International Crop Research Inistitute for the Semi Arid Tropic) থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে ভাল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু লাইন প্রাথমিকভাবে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। এ লাইনগুলোর মধ্যে ICGV-96346 লাইনটি উচ্চ ফলন বিশিষ্ট এবং মাঝারি রোগ সহনশীল বলে প্রতীয়মান হয়।
লাইনটি স্প্যানিস গোত্রের এবং প্রাথমিক ফলন পরীক্ষায় উক্ত গোত্রের অন্যান্য জাতের সাথে উন্নততর বিবেচিত হয় এবং আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষায়ও সর্বোচ্চ ফলন প্রদান করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে কৃষকের মাঠে লাইনটি জাত হিসেবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন লাভ করে।
- গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের (৪০-৪৫ সেমি) প্রতিটি গাছ থেকে ২০-২২টি পুষ্ট বাদাম পাওয়া যায়।
- জাতটি বাংলাদেশের চরাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদের জন্য খুবই উপযুক্ত।
- বপন থেকে ফসল উঠানো পর্যন্ত রবি মৌসমে ১৪০-১৫০ এবং খরিফ মৌসমে ১২০-১৩০ দিন সময় লাগে।
- জাতটি স্বল্পমাত্রায় খরা ও রোগ সহনশীল।
- লাইনটির দানার আকার ঢাকান্ড১ এর দানা থেকে বড়।
- জাতটির গড় উৎপাদনশীলতা ২০০০-২২০০ কেজি/হেক্টর।
(২) চীনাবাদাম চাষ পদ্ধতি ধারাবাহিক বর্ণনা
ক) মাটি
- বেলে দো-আঁশ মাটি, ক্যালসিয়াম ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি চীনাবাদাম উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত।
- চীনা বাদাম জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা বাঞ্চনীয়।
- বেলে দো-আঁশ মাটিতে সহজে শিকড় ও পেগ প্রবেশ করতে পারে বিধায় চীনাবাদাম অধিক ফলন দেয়। এ ফসল পিএইচ ৬.০-৬.৫ এ ভাল হয়।
খ) জমি তৈরি
জমিতে ৩-৪ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করে নিতে হবে। শেষ চাষের সময় মই দিয়ে সমান করে জমির চার পাশে নালার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পরবর্তীতে সেচ ও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পানি নিষ্কাশনে সুবিধা হয়।
গ) চীনাবাদাম চাষের সময়
- চীনাবাদাম রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে আবাদ করা যায়।
- রবি মৌসুমে কার্তিক অগ্রহায়ণ, খরিফ-১ মৌসুমে ফাল্গুন-চৈত্র ও খরিফ-২ মৌসুমে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বপন করতে হয়। তবে দেবীগঞ্জ, লক্ষীপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ফসল জানুয়ারিতে বপন করা হয়।
- রবি মৌসুমে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহে বপন করলে ফলন ভাল পাওয়া যায় এবং জীবনকাল প্রায় ১৫-২০ দিন কমে আসে।
ঘ) বীজের হার
বারি চীনাবাদাম-৮ চাষে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি বা একর প্রতি ৪০ কেজি খোসাসহ বীজের প্রয়োজন হয়। প্রতি হেক্টরে গাছের সংখ্যা ১,১০,০০০-১,২০,০০০ থাকা দরকার।
ঙ) বপন পদ্ধতি
- বীজ বপনের আগে খোসা হতে বীজ আলাদা করে নিতে হবে। বীজ ও খোসার অনুপাত ৭ঃ৩ অর্থাৎ ১০ কেজি খোসাসহ বাদামের ৭ কেজি বীজ পাওয়া যায়।
- বীজ সারিতে বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দুরত্ব ৩০ সেমি এবং গাছ হতে গাছের দুরত্ব ১৫ সেমি।
- বীজ ২.৫ থেকে ৩.০ সেমি মাটির গভীরে বপন করতে হয়। প্রতি গর্তে একটি করে পুষ্ট বীজ বপন করতে হয়।
চ) সারের পরিমাণ
চীনাবাদামের জমিতে নিচে উল্লিখিত হারে সার ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
সারের নাম | হেক্টরপ্রতি (কেজি) | একরপ্রতি (কেজি) | বিঘাপ্রতি (কেজি) |
ইউরিয়া | ২৫ | ১০ | ৩.৫ |
টিএসপি | ১৬০ | ৬৪ | ১২ |
এমওপি | ৮৫ | ৬৪ | ১৬ |
জিপসাম | ৩০০ | ১২০ | ৪০ |
বরিক এসিড(প্রয়োজনে) | ১০ | ৪ | ১.৪ |
ছ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্যান্য সারের সবটুকু শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয় এবং বাকি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ হিসাবে চারা গজানোর ৪০-৫০ দিন পর গাছে ফুল আসার সময় প্রয়োগ করতে হয়।
- তবে প্রতি কেজি বীজে ৭০ গ্রাম অণুজীব সার ব্যবহার করা যেতে পারে। অণুজীব সার ব্যবহার করলে সাধারণত ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয় না।
(৩) চীনাবাদাম চাষে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যাসমূহ
ক) আগাছা দমন
- চীনাবাদামের ফলন ভাল পাওয়ার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে গাছ বৃদ্ধির সময় জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
- চারা গজানোর পর প্রয়োজনবোধে দুই বার (১ম বার ১৪-২০ দিন পর এবং ২য় বার ৩৫-৪০ দিন পর) জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
- ফুল আসার পর গাছে বাদাম ধরার সময় গোড়ায় হালাকাভাবে মাটি তুলে দিলে বাদামের ফলন ভাল হয়।
খ) সেচ
বপন করার ১৮-২০ দিন পর ১ বার এবং শুঁটি হওয়ার ৫০-৫৫ দিন পর ২য় বার সেচ দিতে হবে।
গ) ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ
- চীনাবাদাম গাছের শতকরা ৭৫-৮০ ভাগ বাদাম যখন পরিপক্ক হয় তখন উঠানোর সঠিক সময়। এ সময় গাছের নিচের পাতাগুলো হলুদ রং ধারণ করে এবং ঝরে পড়তে শুরু করে। বাদামের খোসার শিরা উপশিরাগুলো সুস্পষ্ট দেখা যায়। বাদামের খোসা ভাঙ্গার পর খোসার ভেতরে কালচে বর্ণের দাগ দেখা যায় এবং বীজের উপরের আবরণ বাদামী রং ধারণ করে।
- খোসা সহ পরিপক্ক পুষ্ট বাদাম উজ্জ্বল রোদে ১ম ও ২য় দিন দৈনিক ৪ ঘণ্টা, তৃতীয় দিন থেকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা উজ্জ্বল রোদে মোট ৭-৮ দিন শুকাতে হয়। এভাবে বীজের আর্দ্রতা ৮-৯ শতাংশে নেমে আসবে। বাদাম শুকানোর সময় সরাসরি সিমেন্টের মেঝেতে না রেখে চট বা ত্রিপল এর উপর রোদে শুকাতে হয়।
- রোদে শুকানোর পরে বাদাম ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হয়।
- বাদাম বীজ সংরক্ষণের জন্য পলিথিন আচ্ছাদিত বা সিনথেটিক ব্যাগ, চটের বস্তা, কেরোসিন টিন বা ড্রাম, পিলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
- বাদাম বীজসহ চটের বস্তা কাঠের বা বাঁশের মাচায় রেখে দিতে হয়।
- পলিথিন ব্যাগ, টিনের ড্রাম, কেরোসিন টিন প্রভৃতিতে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের মান বা গুণাগুণ এক বৎসরের অধিক সময় অক্ষুন্ন থাকে।
(৪) চীনাবাদাম গাছের বিভিন্ন রোগ ও প্রতিকার
ক) পাতার দাগ রোগ
সারকম্পোরা এরাচিডিকোলা ও ফেরোওপসিস পারসোনেটা নামক দুইটি ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়।
এ ছত্রাকের আক্রমণে সবুজ পাতার উপরিভাগে প্রথম থেকেই হলুদ বর্ণের বৃত্তাকার রেখা দ্বারা ঘেরা গাঢ় বাদামী রঙের দাগের আবির্ভাব হয়। দাগগুলো নানা আকারের হয় এবং পাতার উপর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে।
এ রোগের আক্রমণের ফলে গাছের পাতা শুকিয়ে তাড়াতাড়ি ঝরে যায়। ফলে গাছের পাতায় খাদ্য তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে এবং গাছের গোড়ায় বাদাম পুষ্ট হতে পারে না। বাদাম অপরিপক্ক অবস্থায় থাকে। ফলে বাদামের ফলন ১০-১৫% কম হয়।
রোগের উৎপত্তি ও বিস্তার:
- রোগটি মাটি বাহিত। গাছের অবশিষ্টাংশ যা মাটিতে পড়ে থাকে তা থেকে কনিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে গাছকে আক্রান্ত করে।
- কনিডিয়া বাতাস ও বৃষ্টির পানির মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্য স্থানে ছড়িয়ে থাকে।
- অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং প্রবল বায়ু প্রবাহ এ রোগ বৃদ্ধির সহায়ক।
প্রতিকার:
- রোগ প্রতিরোধী জাত: ঝিঙ্গাবাদাম ও বারি চীনাবাদাম-৭ জাত দুইটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল। এ দুইটি জাতের চাষাবাদের মাধ্যমে রোগের আক্রমণ এড়ানো যায় এবং অধিক ফলন পাওয়া যায়।
- ছত্রাকনাশক প্রয়োগ: এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে গাছে অটোস্টিন (১ গ্রাম হারে)/ কন্টাফ (০.৫ মিলি হারে বা ১মিলি হারে) প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ৩ বার ছিটালে এ রোগের অনিষ্ট থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।
- জমি পরিষ্কারকরণ: যেহেতু জমিতে আক্রান্ত গাছে পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় সেহেতু মৌসুমের শেষে আক্রান্ত গাছসমূহ এবং আগাছা পুড়ে ফেলে বা নষ্ট করে রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
- শস্য পর্যায়ক্রম: একই জমিতে প্রতি বছর চীনাবাদামের চাষ না করে অন্য ফসল দিয়ে শস্য পর্যায়ক্রম গ্রহণ করলে উপর্যুক্ত পোষকের অভাবে অনেক জীবাণু মারা যায় ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়।
খ) রাস্ট বা মরিচা রোগ
পাকসিনিয়া এরাচিডিস নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত বয়স্ক গাছে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
প্রাথমিক অবস্থায় পাতার নিন্ম পৃষ্ঠে লাল, লোহার মরিচা পড়ার ন্যায় সামান্য স্ফীত ছোট বিন্দুর মত অসংখ্য দাগ দেখা যায়। দাগগুলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
এ রোগের কারণে চীনাবাদামের ফলন প্রায় ৫০% পর্যন্ত কম হতে পারে।
রোগের উৎপত্তি ও বিস্তার:
- ফসল কাটার পর এ রোগের ছত্রাক আগাছা, আর্বজনা এবং ফসলের পরিত্যক্ত অংশে আশ্রয় নেয়।
- বিকল্প পোষক হতে বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ সুস্থ্য গাছে ছড়ায় এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার:
- রোগ প্রতিরোধী জাত: ঝিঙ্গা বাদাম জাতটি রাস্ট বা মরিচা রোগ প্রতিরোধী। এ জাতের চাষ করে রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- ছত্রাকনাশক প্রয়োগ: এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে টিল্ট/ কন্টাফ/ক্রীজল শতকরা ০.০৫ ভাগ হারে (প্রতি লিটার পানির সাথে ০.৫ মিলি ছত্রাকনাশক) মিশিয়ে ১২-১৫ দিন অন্তর ৩ বার ছিটালে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়।
- জমি পরিষ্কারকরণ: পূর্ববর্তী ফসল থেকে স্বেচ্ছায় গজানো গাছ. আগাছা এবং আবর্জনা পুড়ে ফেলে এ রোগের উৎস নষ্ট করা যায়।
গ) গোড়া পচা/কান্ড পচা রোগ
স্কেলেরোশিয়াম রলফসি নামক মাটিতে বসবাসকারী এক প্রকার ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়।
ইহা সরিষা দানার মতো স্কেলেরোশিয়া উৎপন্ন করে। মাইসেলিয়াম একত্রীভুত হয়ে মাইসেলিয়াম গুচ্ছ তৈরি করে যা শক্ত হয়ে স্কেলেরোশিয়াম উৎপন্ন হয়। গাছের গোড়ায় বা মাটির ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়াম এবং সরিষার দানার মতো ছত্রাক গুটিকা (স্কেলেরোশিয়া) লক্ষ্য করা যায়।
এ রোগের কারণে গাছের মূল শিকড় আক্রান্ত হলে গোড়া পচে যায় ও গাছ সম্পূর্ণ ঢলে পড়ে এবং পরবর্তীতে খাদ্য ও পানি চলাচলের প্রতিবন্ধকতার কারণে গাছ মরে যায়। এ রোগের কারণে ২৫-৩০% এর উপর ফলনের ক্ষতি হতে পারে।
রোগের প্রতিকার:
- গভীর চাষ: জমি তৈরির সময় গভীর চাষের মাধ্যমে মাটি আলগা করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে রোগের উৎস নষ্ট করে আক্রমণ কমানো যায়।
- বীজ বপন: বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পূর্বে মুরগির বিষ্ঠা ৫ টন/হেক্টর বা সরিষার খৈল ১ টন/হেক্টর প্রয়োগ এবং প্রোভেক্স-২০০ ডাব্লিউপি ছত্রাক নাশক (২.৫ গ্রাম ছত্রাক নাশক /কোজি বীজ) দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করে বাদামের গোড়া পচা রোগ দমন করা যায়।
- জমি পরিষ্কারকরণ: পূর্ববর্তী ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা এবং আবর্জনা পুড়িয়ে নষ্ট করে রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
- শস্য পর্যায়: জমিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে শস্য চাষ করলে উপযুক্ত পোষকের অভাবে রোগ জীবাণু মরে যায়। ফলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
(৫) চীনাবাদামের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তাদের দমন ব্যবস্থা
ক) জ্যাসিড বা পাতা শোষক পোকা দমন
বাচ্চা ও পরিণত অবস্থায় এরা প্রচুর সংখ্যায় গাছের কচি পাতা ও নরম কান্ড থেকে রস চুষে খায় এবং খাওয়ার সময় এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করে ফলে পাতার অগ্রভাগ বাদামী বর্ণ ধারণ করে।
এটি দ্বারা আক্রান্ত পাতা কুঁচকে যায় ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল ও ফল ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়।
আক্রমণের সময় ও ফসলের আক্রান্ত ধাপ:
- শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত গাছের চারা থেকে পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত এদের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে।
- তবে অঙ্গজবৃদ্ধি ও ফুল ধারণের সময় আক্রমণের মাত্রা বেশি হয়।
- শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় (৩০-৩৮০ সে.) এদের আক্রমণ বেশি হয়।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা:
- ৫০ গ্রাম নিম বীজ ভেঙ্গে ১ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে ২-৩ গ্রাম ডিটারজেন্ট বা গুঁড়া সাবান মিশিয়ে ছেকে ১৫ দিন অন্তর ৩ বার ছিটিয়ে পোকা দমন করা যায়। হাত জাল দিয়ে পোকা ধরে মেরে পোকার সংখ্যা কমানো যায়।
- চীনাবাদামের সাথে রসুন, পিঁয়াজ বা ধনিয়া আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করে পোকার আক্রমণ শতকরা ২০-২৫ ভাগ কমানো যায়।
- নিম পাতার নির্যাস (১০%) আক্রান্ত ক্ষেতে ১৫ দিন অন্তর ২ বার স্প্রে করলে আক্রমণ কমে যায়।
- আক্রমণ বেশি হলে রিপকর্ড ১০ ইসি ১ মিলি বা এডমায়ার ০.৫ মিলি./প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ৩ বার (বপনের ৬৫, ৭৫, ৮৫ দিন পর) স্প্রে করা যেতে পারে।
খ) উইপোকা ও পিঁপড়া দমন
উঁইপোকা দলবদ্ধভাবে বাদাম গাছের শিকড় কেটে দেয়। শিকড়ের ভিতর গর্ত করে খায়। ফলে অচিরেই গাছ শুকিয়ে মারা যেতে থাকে।
তাছাড়া এরা মাটির নিচের বাদাম ছিদ্র করে বীজ খায়। ফলে বাদাম পচে যায়।
তাছাড়া পিঁপড়া বাদাম বপন করার পর বীজ খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। এদের আক্রমণে শতকরা ১০-১২ ভাগ ফসলের ক্ষতি হয়।
আক্রমণের সময় ও ফসলের আক্রান্ত ধাপ:
জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বীজ বপন করার পর থেকে পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত এদের আক্রমণ হয়ে থাকে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা:
- প্রতি কেজি বীজের সাথে ১ চা চামচ বা ৫ মিলি কেরোসিন বা নিম তেল ভালভাবে মিশিয়ে বপন করলে পিঁপড়া, উইপোকা ও মাটিতে বসবাসকারী অন্যান্য পোকার আক্রমণ কমানো যায়।
- সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি ২-৩ গ্রাম ১ কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে বপন করলে উইপোকা, পিঁপড়া ও মাটিতে বসবাসকারী অন্যান্য পোকার আক্রমণ শতকরা ৮০ ভাগ কমে যায়।
- আক্রান্ত জমিতে পানির সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে বা ডারসবান ২০ ইসি বা পাইরিফস ৫০ ইসি ২ মি.লি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
(৭) কৃষক পর্যায়ে চীনাবাদাম বীজ সংরক্ষণের নিয়ম
- আমাদের বাংলাদেশের কৃষকেরা বাদামের বীজ শুকানোর পর সাধারণত পাটের বস্তা, মাটির পাত্র, বাঁশের ডোলে সংরক্ষণ করে থাকে। ফলে বাদামের বীজ অতি সহজে বাতাস থেকে আর্দ্রতা সংগ্রহ করতে পারে। বীজে আদ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং বীজের অংকুরোদ্গম ক্ষমতা কমে যায়। এ ধরনের বীজ কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে।
- মানসম্মত বাদাম বীজের গুণাগুণ বজায় রেখে পরবর্তী মৌসুমে চাষ করতে হলে বাদামের বীজকে রৌদ্রে শুকিয়ে ৮-৯% আর্দ্রতায় নামিয়ে আনতে হবে। শুকনো বাদাম হাতে নিয়ে নাড়া দিলে ঝনঝন শব্দ হবে এবং বাদামের বীজ আঙুল দিয়ে জোড়ে চাপ দিলে বীজ থেকে তেল বেড়িয়ে আসবে। এতে বুঝা যাবে বীজের আদ্রতা ৮-৯%।
- তারপর শুকনো বীজকে ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে এবং ঠান্ডা বীজ টিনের পাত্র/প্লাস্টিকের পাত্র/পলিথিন ব্যাগে বায়ুরোধক অবস্থায় শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
- লক্ষ্য রাখতে হবে পাত্রগুলো যেন বীজ দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে যাতে করে পাত্রের ভিতরে বাতাসযুক্ত ফাঁকা জায়গা না থাকে। এই পদ্ধতিতে কৃষক পর্যায়ে বাদামের বীজ ৭-৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]