Skip to content

তেজপাতা চাষ পদ্ধতি, তেজপাতা গাছের বৈশিষ্ট্য, কলম, চারা তৈরি, রোগ ও পরিচর্যা

তেজপাতা চাষ পদ্ধতি, তেজপাতা গাছের বৈশিষ্ট্য, কলম, চারা তৈরি, রোগ ও পরিচর্যা


তেজপাতা Lauraceae পরিবারভুক্ত একটি বহুবর্ষজীবী চিরহরিৎ মসলা জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশে চাষকৃত অধিকাংশ তেজপাতা ইন্ডিয়ান বেলিফ (Indian Bay leaf) হিসেবে পরিচিত, যার বৈজ্ঞানিক নাম Cinnamomum tamala Nees যার আদি নিবাস হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ ও ভারতের উত্তর পূর্ব পাহাড় হতে বার্মা পর্যন্ত বিস্তৃত। তেজপাতা বাংলাদেশসহ ভূমধ্যসাগর, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ, আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চায়না ও বার্মায় উৎপাদিত হয়।

ইহা বাংলাদেশের সর্বত্রই জন্মে। বৃহত্তর সিলেট এলাকায় উৎপাদিত তেজপাতা লন্ডনে বেশ সমাদৃত।

মসলা হিসেবে অতি পরিচিত তেজপাতায় রয়েছে অনেক ভেষজ গুণাগুণ। ঔষধ হিসেবে পাতা ও ছাল ব্যবহার হয়। গাছের বাকল হতে তেল পাওয়া যায়, যা সাবান প্রস্তুতে ব্যবহার হয়। এছাড়াও বাকল ও পাতা ট্যানিন হিসেবে ব্যবহার হয়। পাতায় প্রধান উপাদান হলো এক প্রকার উদ্বায়ী তেল ইউজিনল (প্রায় ৭৮%) নামে পরিচিত। তাছাড়াও পাতা আইসো ইউজিনল ডি-আলকান্ডফেলা-নাড্রিনি এবং সিনানামিক অ্যালডিহাইড সমৃদ্ধ।

তেজপাতা বিরেচক, উদ্দীপক, মূত্রবর্ধক, তলপেটে সংকোচনজনিত ব্যাথা, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, গলায় সংক্রমক এবং সর্দি-কাশিতে ব্যবহার হয়। পাতা ব্যাকটেরিয়া বিধ্বংসী, জরায়ুর বিভিন্ন রোগনাশক এবং গর্ভফুল নিষ্কাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

(১) তেজপাতা গাছের বৈশিষ্ট্য

বারি তেজপাতা-১:

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে সংগ্রহীত স্থানীয় জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তেজপাতার উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়। জাতটি ২০১৭-১৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্ত হয় যা ‘বারি তেজপাতা-১’ নামে পরিচিত।

বারি তেজপাতা-১ এর রোগমুক্ত শাখা
বারি তেজপাতা-১ এর রোগমুক্ত শাখা
  • ইহা মাঝারী উচ্চতার (২.৫-৩.০ মিটার) সুগন্ধিযুক্ত চিরসবুজ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ।
  • বাকল গাঢ় ধূসর অথবা কালো, সামান্য অমসৃণ।
  • পাতাগুলো বিপরীতভাবে বিন্যস্ত, কচি অবস্থায় লাল এবং পরে সবুজ হয়ে যায়, সূহ্ম লোমযুক্ত ও তিন শিরা বিশিষ্ট।
  • পাতাগুলো লম্বায় বেশ বড় ও সবুজ বর্ণের।
  • “বারি তেজপাতা-১” সারাবছর বাংলাদেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
  • চারা লাগানোর ১৬-১৮ মাসের মধ্যে তেজপাতা সংগ্রহ করা যায়।
  • এ জাতের তেজপাতার গাছের ০.৫ ঘনমিটারে গড়ে ১৫৮১.২৫-১৭০৬.০০টি এবং এক মিটার লম্বা ডালে ৯৭.০০-১০১.৮০টি পাতা পাওয়া যায়।
  • একটি পাতায় গড় দৈর্ঘ্য ১৪.৮০-১৫.০৫ সেমি ও প্রস্থ ৩.৮৩-৩.৯৩ সেমি।
  • পাতার পুরুত্ব গড়ে ০.৫৯-০.৬৯ মিমি।
  • পাতার বোটার দৈর্ঘ্য গড়ে ১.০৫-১.৪৭ সেমি।
  • পাতায় শুষ্ক পদার্থের পরমাণ গড়ে ৫৯.২৮-৬২.০% হয়।
  • জাতটিতে লিফস্পট/পাতা পোড়া রোগ অন্যান্য স্থানীয় জাতের তুলনায় অনেক কম হয়।
  • জাতটির ৭-৮ বছর বয়সের একটি গাছ হতে বছরে গড়ে ৩০.০০-৩৪.২৩ কেজি কাঁচা পাতা উৎপাদন হয়।

(২) তেজপাতা চাষ পদ্ধতি, তেজপাতা গাছের কলম, চারা তৈরি ও পরিচর্যা

ক) জলবায়ু ও মাটি

উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু তেজপাতা চাষের জন্য সর্বোত্তম। তবে তেজপাতার পরিবেশ উপযোগিতা ব্যাপক বিধায় আর্দ্র ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় সফলভাবে এর চাষ করা সম্ভব।

বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৮০০-৩০০০ মিমি ও গড় তাপমাত্রা ২৮-৩৫০প হলে পাতার ফলন ও গুণগতমান উভয়ই ভাল হয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে রোগের আক্রমণ ও ডাল (মাইট দ্বারা আক্রান্ত) রোগের প্রকোপ কম হয়।

উঁচু সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ অথবা দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ মাটি তেজপাতা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে বাংলাদেশের সর্বত্রই সব ধরনের মাটিতেই বারি তেজপাতা-১ চাষ করা যায়।

খ) বংশ বিস্তার

দু’ভাবে বংশ বিস্তার করা যায়। বীজ থেকে এবং কলম থেকে চারা তৈরি করে। কলমের চারা উত্তম কারণ এতে বংশগত গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে।

গ) বীজ হতে চারা উৎপাদন

  1. তেজপাতা বীজ থেকে চারা তৈরী করা অপেক্ষাকৃত কঠিন। বীজের ডরমেনসি খুবই কম হওয়ায় বীজ সংগ্রহের ১-২ দিনের মধ্যে বীজ চারা তৈরী করার জন্য ব্যবহার করতে হবে।
  2. বীজ পেকে যখন কালো বর্ণ ধারণ করবে, তখন বুঝতে হবে বীজ সংগ্রহের সঠিক সময়। এই সময়ে বীজ সংগ্রহ করে পূর্বের প্রস্তুতকৃত মাটি ভর্তি প্রতিটি পলিব্যাগে ২-৩ বীজ দিতে হবে।
  3. বীজ বপনের পর পলিব্যাগে সেভিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে। এতে করে পিঁপড়া বীজের ক্ষতি করতে পারবে না।
  4. উপযুক্ত পরিবেশে বীজ থেকে চারা হতে ১২-১৪ দিন সময় লাগে।
  5. এর পর হতে নিময়তিভাবে ঝরনা দ্বারা পানি দিতে হবে, যা মাটিতে সমসময় আর্দ্রতা বজায় থাকে।

ঘ) কলমের মাধ্যমে চারা তৈরিকরণ

  1. সাধারণত পার্শ্বীয় জোড় কলম (Side grafting) ব্যবহার করে চারা তৈরি করা হয়। সাধারণত কাবাব চিনির চারাকে রুটস্টক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
  2. পলিব্যাগে/মাটির ছোট টবে কাবাব চিনির চারা তৈরি করে নেয়া হয়। চারা ১.৫-২.০০ ফুট উঁচু হবে তখন কলমের জন্য উপযুক্ত হয়।
  3. মধ্য চৈত্র-বৈশাখ হতে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত (এপ্রিল-মে) কলম করার উপযুক্ত সময়।
  4. নির্বাচিত তেজপাতার শাখাকে (পেনসিলের মতো মোটা) সায়ন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এরপর কলম করা হয়।

ঙ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ

  1. বাগান আকারে গাছ লাগাতে হলে গভীরভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করা উচিত। এতে দীর্ঘজীবী আগাছা দমন হবে।
  2. বাড়ির আশে পাশে পুকুর পাড়ে কিংবা রাস্তার ধারে গাছ লাগালে চাষ না দিয়ে সরাসরি গর্ত করে তেজপাতার চারা লাগানো যায়।
  3. চারা লাগানোর জন্য ৪-৬ মিটার দূরত্বে ০.৮০ ⨉ ০.৮০ ⨉ ০.৮০ মিটার আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে।
  4. চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে প্রতি গর্তে ২৫ কেজি পচা গোবর ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি ও ৫০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রাখতে হবে।
  5. জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
  6. চারা রোপণের পূর্বে গর্তের মাটি কোদাল দিয়ে উলট-পালট করে নিতে হবে।
  7. রোপণের পর চারাটিকে একটি শক্তখুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে এবং গোড়ায় পানি দিতে হবে।

চ) সার প্রয়োগ

গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ অপরিহার্য।

সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স ও মাটির ঊর্বরতার উপর। বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা নিচের টিবিলে তুলে ধরা হলো।

গাছের বয়সগোবর
(গাছ প্রতি)
ইউরিয়া (গাছ প্রতি)টিএসপি (গাছ প্রতি)এমওপি (গাছ প্রতি)জিপসাম (গাছ প্রতি)
১-২ বছর১২২৫০২০০২০০৫০
৩-৪ বছর১৭৪০০৩৫০৩৫০৮০
৫-৬ বছর২২৬৫০৬০০৬০০১২০
৭ -৮ বছর২৭৮৫০৭৫০৭৫০১৬০
৯ বা তদুর্ধ্ব৩২১০৫০৯৫০৯৫০২০০

এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক যেসব সারের অধিক ঘাটতি রয়েছে সেসব সারও প্রয়োগ করতে হবে।

উল্লিখিত সার সমান দুই কিস্তিতে পাতা সংগ্রহের পর পর প্রয়োগ করতে হবে। সার মাটির সাথে ভালভাবে মেশাতে হবে এবং প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।

ছ) পানি সেচ ও পরিচর্যা

  • শুষ্ক মৌসুমে বিশেষতঃ চারা গাছে এবং বয়স্ক গাছে পাতার বাড়ন্ত অবস্থায় সেচ দিলে ফলন ও পাতার গুণগতমান বৃদ্ধি পায়।
  • মাটির আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করে খরিফ-১ এ ২-৩ টি এবং রবি মৌসুমে ৪-৫ টি সেচ দিতে হয়।
  • চাষ দিয়ে বা কোঁদাল দিয়ে কুপিয়ে তেজপাতার বাগানের আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

জ) পাতা সংগ্রহ

সাধারণতঃ বছরে ২ (দুই) বার পাতা সংগ্রহ করা হয়। গাছ হতে তেজপাতা সংগ্রহের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের ছোট ছোট ডাল না ভেঙ্গে যায়।

আবহাওয়া অনুকূল ও পরিমিত পরিচর্যা করলে ৭-৮ বছরের একটি গাছ হতে বছরে প্রায় ৩০.০০- ৩৪.২৩ কেজি উৎপাদন হবে।

(২) তেজপাতা গাছের রোগ ও প্রতিকার

তেজপাতায় রোগ ও পোকান্ডমাকড়ের আক্রমণ তেমন একটা লক্ষণীয় নয়। তেজপাতার রোগের মধ্যে গ্রে লিফ স্পট (Grey Leaf spot)/পাতা পোড়া (Leaf blight) রোগ প্রধান।

ক) গ্রে লিফ স্পট (Grey leaf spot)/পাতা পোড়া (Leaf blight) রোগ

এই রোগ হলে তেজপাতার ফলন অনেকাংশে কমে যায়। তেজপাতার ব্যবহারের প্রধান অংশ পাতা হওয়ায় রোগের কারণে তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে ফলন ৯০% পর্যন্ত কম হতে পারে (Karunakaran et al., 1993)।

তেজপাতার এই রোগ ছত্রাকের কারণে হয়। Colletotrichium gloeosporioides (Rov et al, 1976), Glomerella cingulata (Khan and Hossain, 1985) I Pestalotia cinnamomi (Anonymous, 1996) যে কোন একটি ছত্রাকের আক্রমণে তেজপাতার এই রোগ হয়।

পাতায় প্রথমে ছোট ছোট গোলাকার দাগ বা স্পট পড়ে। পরে দাগগুলো বড় হতে থাকে ও অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে মনে হয় পাতাটি আগুনে পুড়ে গেছে। পাতাটি তখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

প্রতিকার:

  1. রোগাক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. আবহাওয়া যখন শুষ্ক থাকে, তখন নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। মাটিতে আর্দ্রতা থাকলে এই রোগ কম হয়।
  3. রোগের লক্ষণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি প্রোপিকোনাজল (টিল্ট ২৫০ ইসি) অথবা কার্বেনডাজিম (অটোস্টিন) ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার সমস্ত গাছে বিকেলে স্প্রে করতে হবে।

খ) তেজপাতার গল

তেজপাতার গল বর্তমানে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরিওফাইড মাইট (Eriophyid mite) এর আক্রমণে তেজপাতার গল হয়। এই রোগ হলে আক্রান্ত গাছের পাতা ফুলে উঠে ও পরবর্তীতে পাতা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

প্রতিকার:

  1. রোগাক্রান্ত পাতা ও শাখা-প্রশাখাগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. শুষ্ক আবহাওয়ায় এই রোগ বেশি হওয়ায় বাগানে নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। আর্দ্র আবহাওয়ায় মাইট এর আক্রমণ কম হয়।
  3. রোগের লক্ষণ দেখা দিলে রোগাক্রান্ত পাতা ও শাখা-প্রশাখাগুলো ধারালো কাচি দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হবে ও এর পর প্রতি লিটার পানির সাথে ১.২ মিলি ভার্টিমেক/ ওমাইট/লিকাড়/ পেগাসাস হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার সমস্ত গাছে বিকেলে স্প্রে করতে হবে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts