Skip to content

পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি

পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপকভাবে চাষকৃত মাছের মধ্যে মেকং ডেলটার পাঙ্গাশ একটি উন্নত প্রজাতি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরে ৮ মে ১৯৯০ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সর্ব প্রথম থাই পাঙ্গাশের পোনা উৎপাদন ও পরবর্তীতে পুকুরে পাঙ্গাস মাছ চাষ শুরু হয়। এরপর মৎস্য অধিদপ্তরসহ বেসরকারি উদ্যোগে পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি/প্রযুক্তি সারাদেশে ব্যাপক প্রসার লাভ করে এবং তা দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশেদেশে পাঙ্গাশ মাছের উৎপাদন প্রায় ৬০ হাজার মে. টন বাংলাদেশে পাঙ্গাস মাছ ব্যাপকভাবে ভক্ষণ করা হয়ে থাকে ও তাই যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে এই মাছের। তাই এখানে আমরা পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হব।

(১) পাঙ্গাশ মাছের বৈশিষ্ট্য

চিত্র- পাঙ্গাস মাছের আর্ট

পাঙ্গাশ মাছের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি-

  • সুস্বাদু ও কম কাঁটাযুক্ত মাছ
  • অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং দৈহিক বৃদ্ধির হার রুই জাতীয় মাছের চেয়ে বেশি বলে এদের উৎপাদন অনেক বেশি যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
  • প্রতিকূল পরিবেশে (কম অক্সিজেন, পিএইচ, পানির ঘোলাত্বের তারতম্য ইত্যাদি) পাঙ্গাশ মাছ বাঁচতে পারে।
  • রাক্ষুসে মাছ নয় বিধায় রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যায় এবং সর্বভূক বিধার সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগে চাষ করা যায়।
  • স্বল্প থেকে মধ্যম লবণাক্ত পানি (২-১০ পিপিটি), ঘের ও খাঁচা এবং অন্যান্য মৌসুমে জলাশয়ে পাঙ্গাশ মাছ চাষ করা যায়।

(২) পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি

ক) পুকুর প্রস্তুতি

পুকুর প্রস্তুতির মূল উদ্দেশ্য হলো পুকুরে মাছের সহনীর বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা। ৫০-১০০ শতাংশ আয়তন বিশিষ্ট ও ২-৩ মিটার পানির গভীরতা সম্পন্ন পুকুর পাঙ্গাশ চাষের জন্য উত্তম। 

পুকুর প্রস্তুতির অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো নিম্নলিখিত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করা যায-

আগাছা দূরীকরণ: পুকুর পাড় মেরামত ও পুকুরের তলায় অধিক কাদা জমলে বা তলা ভরাট হয়ে থাকলে তলার অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে। পুকুর শুকানোর পর ভাঙ্গা পাড় ও অসমতল তলা মেরামত করতে হবে।

See also  পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি ও পাংগাস মাছের খাবার তালিকা

রাক্ষুসে মাছ ও আগাছা দূরীকরণ: পুকুরে রাক্ষুসে মাছ ও আগাছা থাকলে পাঙ্গাশ চাষে কাঙ্ক্ষিত সফলতা বিঘ্নিত হয়। তাই পুকুর সেচে বা বিষ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে মাছ ও আগাছা অপসারণ করতে হবে। রোটেনন প্রতি শতাংশে (৩০ সে.মি. পাানির গভীরতার) ২৫-৩০ গ্রাম প্রয়োগ করা যেতে পারে।

চুন প্রয়োগ: মাটি ও পানির অবস্থাভেদে চুন প্রয়োগের মাত্রার তারতম্য ঘটতে পারে। পানির পিএইচ ৮.৫ এর নিচে হলে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। 

সার প্রয়োগ: চুন প্রয়োগের ৭ অথবা ১৫ দিন পর প্ল্যাংকটন উৎপাদনের জন্য পুকুরে জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সার হিসেবে গোবর, কম্পোস্ট এবং অজৈব সার হিসেবে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, ব্যবহার করা যেতে পারে। পুকুর প্রস্তুকালীন সময়ে প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২৫-৩০ গ্রাম এম.পি মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। অজৈব সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পানির রং সবুজ বা বাদামি হলেই পুকুরে পোনা মজুদ করতে হবে।

খ) পোনা মজুদ ও চাষাবাদ পদ্ধতি

পাঙ্গাশ সাধারণত এককভাবে অথবা মিশ্রভাবে চাষ করা যেতে পারে। পুকুরের নিচের স্তরের খাবার খায় এমন প্রজাতির মাছ যেমন- মৃগেল, কালিবাউস মজুদ না করাই উত্তম বা সংখ্যায় খুবই কম পরিমাণে মজুদ করতে হবে।

পুকুরে পানির গভীরতা ২-৩ মিটার হলে একক চাষে প্রতি শতাংশে ৮-১০ সে.মি. আকারের ১৫০-২০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। মিশ্র চাষের বেলায় প্রতি শতাংশে ৬০-৭০টি পাঙ্গাশের পোনার সাথে ৮-১০টি রুই, ১২-১৫টি সিলভার কার্প ও ৩০-৩৫টি মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুদ করলে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়।

পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুণাবলি পরীক্ষা করা উচিত। পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুণাবলির সাথে কমপক্ষে ৩০ মিনিট খাপ খাইয়ে পোনাকে ধীরে ধীরে পুকুরে ছাড়তে হবে।

গ) সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ও মাত্রা

পাঙ্গাশ চাষে আশানুরূপ ফলন পেতে হলে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করা চলবে না। পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাশ চাষ করতে হলে মাছকে অবশ্যই চাহিদামতো সুষম দানাদার খাদ্য দিতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের উপরই পাঙ্গাসের বৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল।

See also  এককভাবে পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি

পাঙ্গাসের খাদ্যে ২৫-৩২% প্রাণিজ আমিষ থাকতে হবে। ফিশমিল বা শুঁটকি মাছের গুঁড়া, গবাদি পশুর রক্ত, ইত্যাদির মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ আমিষ আছে। মিশ্রিত খাদ্যকে পেস্ট বা মণ্ড বানিয়ে বল করে সরাসরি পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

বিভিন্ন মৎস্য খাদ্য উপাদানের পুষ্টিমানের আনুষাঙ্গিক বিশ্লেষণ-

খাদ্য উৎপাদনশতকরা হার (%)আমিষের পরিমাণ  (%) তৈরি খাদ্যে আমিষের পরিমাণ (%)
মৎস চূর্ণ২০৫৬১২.২
সরিষার খৈল১৫৩০৪.৫
গমের ভূমি২০১৫
চাউলের কুঁড়া২০১২২.৪
মিট এন্ড১০৫৫৫.৫
বোন মিল
সয়াবিন মিল১৫৩০৪.৫
মোট১০০৩১.১

পাঙ্গাশের পুকুরে প্রয়োগকৃত খাদ্যের পরিমাণ নির্ভর করে মাছের দেহের ওজনের উপর-

  • মাছের পড় ওজনকে হিসেবে এনে প্রতি ১৫ দিন অন্তর নমুনায়নের মাধ্যমে পুকরের মাছের গড় ওজন বের করে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
  • মোট মাছের ওজন বা জীবভরের (Biomass) ১৮-৩% হারে খাবার দিতে হবে।
  • প্রতিদিন দু’দফা সকাল ও বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ে খাবার দিতে হবে।
  • দৈনিক খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণকে ২ ভাগে ভাগ করে সকালে ৫০% এবং বিকালে ৫০% দিতে হবে।
  • দানাদার খাদ্য ছিটিয়ে এবং ভিজা খাদ্য বল বানিয়ে দিতে হবে।
  • খাদ্যগুলো পুকুরের আয়তন অনুসারে ৪-৬ স্থানে দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া পুকুর অত্যাধিক গভীর হলে ট্রে বা খাবারদানি তৈরি করে ভাতে খাদ্য দিলে খাদ্যের অপচয় কম হয়।

ঘ) আহরণ ও উৎপাদন

চিত্র- পাঙ্গাস আহরণ ও উৎপাদন

উল্লিখিত পদ্ধতিতে চাষ করলে পাঙ্গাশ মাছ ১ বছরে গড়ে ১.৫-২.০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। পাশাপাশি মজুদকৃত অন্যান্য মাছও বাজারজাত উপযোগী হয়। এতে বছরে ২৫-৩০ টন/হে. মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।

(৩) পাঙ্গাশ মাছ চাষে উদ্ভূত সমস্যা ও সমাধানের উপায়

পুকুরে পাঙ্গাস মাছ চাষের সমস্যা-

  1. মৎস্য খাদ্যের পুষ্টিমান হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদন হ্রাস। 
  2. খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি।
  3. অধিক ঘনত্বে মজুদ ও অতিরিক্ত খাদ্য ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হয়ে মাছে রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি।

পুকুরে পাঙ্গাশ মাছ চাষে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর কারণ-

  1. অধিক ঘনত্বে (শতাংশে ৩০০-৪০০টি) পোনা মজুদ ও অতিমাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ।
  2. পাঙ্গাশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক খাদ্যে প্রয়োজনীয় মাত্রার (২৫-৩২%) চেয়ে অনেক কম মাত্রার নিম্নমানের প্রোটিনযুক্ত (১৫-২০%) ভেজাল খাদ্য ব্যবহারের কারণে খাদ্যের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া।
  3. প্রানিজ খাদ্য উপাদান যথা ফিশমিল এবং গুণগতমানসম্পন্ন মিট ও বোন মিলের অভাব ও মূল্য বৃদ্ধি।
  4. অতিমাত্রায় খাদ্য প্রয়োগের ফলে পানির গুণাগুণ বিনষ্ট ও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া। অব্যবহৃত খাদ্য, মাছের জৈবিক বর্জ্য ও তলদেশে সঞ্চিত কানা ইত্যাদি পচনের ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি এবং অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের বিষাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া।
  5. অন্তঃপ্রজনন সমস্যাযুক্ত ও নিম্নমানের পোনা ব্যবহারের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস।
See also  এককভাবে পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি

পুকুরে পাঙ্গাশ মাছ চাষে সমস্যাগুলো সমধানের করণীয়-

  1. সুপারিশকৃত ঘনত্বের চেয়ে অধিক হারে পোনা মজুদ পরিহার করতে হবে। পাঙ্গাশের একক চাষে ১০-১৫ সে.মি. আকারের পাঙ্গাশের পোনা প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০টি মজুদ করতে হবে। পোনা মজুদের সময় যথাসম্ভব একই আকারের পোনা মজুদ করলে সামগ্রিক উৎপাদন ভালো হবে।
  2. রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশ ৬০-৭০টি পাঙ্গাশ, ৮-১০টি রুই, ১২-১৫টি সিলভার কার্প ও ৩০-৩৫টি মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যাবে।
  3. গুণগতমানসম্পন্ন খাদ্য উপাদান ব্যবহার করতে হবে এবং খাদ্যে প্রোটিনের পরিমাণ ২৫-৩২% বজায় রাখতে হবে। মজুদকৃত মাছের বয়স ও দৈহিক ওজনের অনুপাতে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। অতিমাত্রায় খাদ্য ব্যবহার অবশ্যই পরিহার করতে হবে। সরবরাহকৃত খাদ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে নতুবা অব্যবহৃত খাবার পুকুরের তলায় জমে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করবে এবং হঠাৎ করে মাছের মড়ক লাগতে পারে।
  4. পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রতি মাসে সঠিক মাত্রায় চুন/জিওলাইট ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনীয় সময়ে পানি সরবরাহ ও অতিরিক্ত পানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  5. রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সাধারণ নিয়মাবলি যথা- উন্নত চাষ ও খামার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
  6. খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব অথবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
  7. মাছের স্বাদ ও বাজার চাহিদা বৃদ্ধির জন্য বিক্রির ২ দিন পূর্বে বিক্রয়যোগ্য মাছ পরিষ্কার পুকুরে স্থানান্তর করে প্রবাহমান পানিতে রেখে বাজারজাত করতে হবে। ঐ সময় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে।
  8. পাঙ্গাশের বাজার চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধির জন্য পণ্য বহুমুখীকরণ যথা- ফিলেট, স্টিক/প্লাইস মৎস্যজাত পণ্য বাজারজাত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আলোচ্য পোষ্টটিতে আমরা সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে পাঙ্গাশ মাছের বৈশিষ্ট্য, পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি ও পাঙ্গাশ মাছ চাষে উদ্ভূত সমস্যা ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে জানলাম। পরবর্তী আলোচনায় পুকুরে পাঙ্গাশ মাছ চাষ পদ্ধতির আরও বিভিন্ন উন্নত কলাকৌশল তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইংশাআল্লাহ। কৃষি বিষয় যেকোন তথ্য পেতে আমারদের ওয়েবসাইট নিয়মিট ভিজিট করুন, আপনার যেকোন প্রশ্ন ও মতামত কমেন্টে জানান। ধন্যবাদ।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts