নিম্নে সহজ ও সংক্ষিপ্তাকারে পাট শাক ও পাট চাষ পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-
ভূমিকা
পাট কি: পাট একটি প্রাকৃতিক তন্তু যা পাটগাছ থেকে পাওয়া যায়। পাটগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Corchorus capsularis এবং Corchorus olitorius। প্রধানত বাংলাদেশ এবং ভারত পাট উৎপাদনের জন্য পরিচিত। পাটের তন্তু বিভিন্ন দড়ি, বস্তা, ব্যাগ, কার্পেট এবং অন্যান্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পাট পরিবেশ বান্ধব, পুনঃব্যবহারযোগ্য, এবং পচনশীল, যা এটিকে একটি জনপ্রিয় প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
পাট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফসল যা বহু দেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, পাটের সঠিক ব্যবহার কৃষি এবং পরিবেশ উভয়ের জন্যই উপকারী।
জমি নির্বাচন
- উর্বর দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে বেলে ও এঁটেল মাটি ছাড়া সব জমিতেই পাট চাষ করা যায়।
- যে জমিতে বর্ষার শেষের দিকে পলি পড়ে সে জমি পাট চাষের জন্য উত্তম।
- তোষা পাট উঁচু জমিতে এবং দেশী পাট উঁচু ও নিচু দু’ধরনের জমিতেই চাষ করা যায়।
পাটের জাত, বপণ সময় ও বীজহার
নিচে দেশী ও তোষা পাটের জাত, বপন সময় ও বীজহার ছকাকারে উল্লেখ করা হলো-
জাত | বপন সময় | বীজহার (কেজি/হেক্টর) |
দেশী পাট: সি.সি-৪৫, সি.ভি.ই-৩, সি.ভি.এল-১, ডি-১৫৪,এটম পাট-৩৮ | ১৫ মার্চ-১৫ এপ্রিল | সারিতে ৫-৬ কেজি ছিটিয়ে ৭-৯ কেজি |
তোষা পাট: ৩-৮, ৩-৯৮৯৭ (ফাল্গুনী তোষা, সি. জি. (চিনসূরা গ্রিন) | ১৫ই এপ্রিল-১৫ই মে | সারিতে ৩.৭৫-৫.০ কেজি ছিটিয়ে ৬-৮ কেজি |
সঠিক সময়ের আগে বা পরে বীজ বুনলে আলোক সংবেদনশীলতার কারণে পাট গাছ সুষ্ঠুভাবে বাড়তে পারে না, অসময়ে ফুল দেখা দেয় এবং পাটের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
জমি তৈরি
জমির জো অবস্থায় ৫-৬ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয় এবং জমি থেকে আগাছা, পূর্ববর্তী ফসলের গোড়া, শিকড় ইত্যাদি বেছে পরিষ্কার করতে হয়।
সার প্রয়োগ
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুপারিশ অনুযায়ী সার ব্যবস্থা মাত্রা নিম্নরূপ-
সারের নাম | গোবর সার দিলে সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) | গোবর সার না দিলে সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) |
গোবর | ৩৭২০ | ০ |
ইউরিয়া | ১২ + ১০০ | ১০০ + ১০০ |
টিএসপি | ১৭ | ৫০ |
এমপি | ২২ | ৯০ |
জিপসাম | ০ | ৪৫ |
জিঙ্ক সালফেট | ০ | ১০ |
উপরি প্রয়োগে ব্যবহৃতব্য
- গোবর সার প্রয়োগ করতে চাইলে বীজ বপনের ১৪-২১ দিন আগে গোবর জমিতে ছিটিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- শেষ চাষের সময় ইউরিয়া সারের প্রথম অংশসহ অন্যান্য সব সার ছিটিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বীজ বপন করার ৬-৭ সপ্তাহ পর প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হবে। ছিটানোর সময় ইউরিয়া দানা যেন কচি পাতায় লেগে না থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে পাটের পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- রৌদ্রজ্জ্বল দিনে উপরি প্রয়োগ করা কাম্য।
বীজ শোধন
বীজ বপন করার আগে শোধন করে নেয়া উত্তম। প্রতি কেজি পাট বীজের সাথে ২০ গ্রাম সেরিসান বা এগ্রোসান জি এন অথবা ২০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ৫০% বা ক্যাপটান ৭৫% ওষুধ মিশিয়ে বীজ শোধন করে নেয়া উচিত। বীজ শোধনকারীর রাসায়নিক দ্রব্যের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
বপন পদ্ধতি
- সারিতে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়।
- সারিতে বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সে.মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৭-১০সে.মি।
- বীজ বেশি পরিমাণে বোনা হলে বীজ খরচ বেশি ছাড়াও জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলতে খরচ বেশি পড়ে। বেশি পাতলা হলে গাছে শাখা-প্রশাখা গজায়, ঘন হলে জীর্ণ শীর্ণ হয়, উত্তম আঁশ প্রাপ্তির জন্য কোনটাই কাম্য নয়।
চারা পাতলাকরণ ও আগাছা দমন
চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর একবার ঘন জায়গায় দূর্বল চারাগুলো তুলে ফেলা ও জমির আগাছা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এর ১৫ দিন পর আরও একবার চারা পাতলাকরণ ও আগাছা তুলে ফেলা আবশ্যক। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪,৪০,০০০ টি চারা থাকলে কাঙ্খিত ফলন আশা করা যায়।
পোকামাকড় দমন
পাট ক্ষেতে বিছা পোকা, পাটের এপিওন, ঘোড়া পোকা, উড়চুঙ্গা, মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হয়ে থাকে। কৃষি কর্মকর্তা, ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ অনুযায়ী এগুলো দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোগ দমন
পাটগাছ ঢলে পড়া, কান্ড পচা, কালো পট্রি, শুকনো ক্ষেত, গোড়া পচা ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এগুলো দমনের জন্য থানা কৃষি কর্মকর্তা বা ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ নিন।
পাট কাটা ও আঁটি বাঁধা
- উন্নতমানের আঁশের জন্য গাছে ফুল ধরার সময় পাট কাটতে হয়। তবে এক্ষেত্রে ফলন কম হয়।
- ভালো ফলন ও আঁশ পাওয়ার জন্য ফুল থেকে ফল ধরার সময় পাট কাটার উত্তম সময়।
- বেশি মোটা করে আটি বাঁধলে পচতে বেশি সময় লাগে। এ জন্য ১৫-২০ সে.মি. ব্যাসের আঁটি বাঁধতে হয়।
পাতা ঝরানো ও গোড়া ডুবানো
- পাট জাগ দেয়ার আগে পাতা ঝরিয়ে নেয়া উচিত। কারণ পচনকারী অণুজীব পাটের শক্ত কান্ডের চেয়ে নরম পাতা বেশি পছন্দ করে। এজন্য পাতা থাকলে পাট পচতে অসুবিধা হয়।
- আঁটি বাঁধার পর আটির অগ্রভাগকে অপর আঁটির গোড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হয় এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে সাজাতে হয়। ৪-৫ দিন পর আঁটিগুলো তুলে একটু ঝাঁকুনি দিলেই পাতা ঝরে পড়বে।
- পাট গাছের গোড়া মোটা ও শক্ত বিধায় মধ্য ও অগ্রভাগের তুলনায় দেরিতে পচে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য গোড়ার দিকটা ৩-৪ দিন পানির ভিতর রেখে আঁটিগুলো খাড়াভাবে স্তূপ করে রাখা হয়। এরপর জাগ দিলে পাটের আগা- গোড়ার একসাথে পচনক্রিয়া শুরু হয়।
জাগ দেওয়া
পাটকে পচানোর জন্য পাটের আঁটিগুলো সাজিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখাকে জাগ দেওয়া বলা হয়।
- কম স্রোতবিশিষ্ট পরিষ্কার পানিতে পাট জাগ দিতে হয়। বদ্ধ পানিতেও জাগ দেওয়া যায় তবে সেক্ষেত্রে প্রতি ১০০ আটির জন্য ১ কেজি ইউরিয়া সার জাগের উপর ছিটিয়ে দিতে হয়। এতে পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং আঁশের মান ভালো হয়।
- বেশি পরিমাণ লৌহযুক্ত পানিতে পাট জাগ দেওয়া উচিত নয়। এতে পাটের ট্যানিনের সাথে লৌহযুক্ত হয়ে পাটের আঁশের রং কালো করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে আঁশের গুণগতমান কমে যায়।
- জাগের আকার বিভিন্ন রকম হতে পার। যেমন- পাটের আঁটির পোড়া মাথা একসাথে সাজিয়ে বেঁধে দিতে হয়। পরে দ্বিতীয় স্তরও একই নিয়মে সাজাতে ও বেঁধে দিতে হয়।
- জাগের উপর মাটি কলাগাছ, ঝিগাগাছ প্রভৃতি ব্যবহার করে জাগ ডুবানো বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে পাটের আঁশের রং কালো হয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায় হলো জাগের দুই পার্শ্বে শক্ত খুঁটি পুতে জাগ ডুবানো। তবে কচুরিপানা, পাথর বা কংক্রীটের চাকতিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
- জাগ দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে জাগের উপরে কমপক্ষে ৩০ সে.মি. এবং নিচে কমপক্ষে ৬০ সে.মি. পানি থাকে।
পাট পচনের সমাপ্তি নির্ণয়
- পাট পচনের মাত্রা এমন হওয়া উচিত যাতে আঁশগুলো একটির সাথে অন্যটি লেগে না থাকে। জাগ দেবার ১০-১১ দিন পর থেকেই পাটের পচন পরীক্ষা করে যেতে হবে।
- কৃষকরা সাধারণত জাগ থেকে ৪-৫ টি পাট গাছ টেনে বের করে ছাল ছাড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখে। তবে বিজ্ঞানসম্মত উপায় হলো ২-৩ টি পাট গাছ জাগ থেকে বের করে তার মাঝখান থেকে ২.৫ সে. মি. পরিমাণ ছাল কেটে তা একটি পানি ভর্তি শিশির ভিতর নিয়ে ঝাঁকাতে হবে। পরে এই ছালগুলো পুনরায় পরিষ্কার পানি ভর্তি শিশির ভিতর নিয়ে ঝাঁকানোর পর যদি দেখা যায় যে আঁশগুলো ভালোভাবে পৃথক হয়ে গেছে তবে বুঝতে হবে পাটের পচন শেষ হয়েছে।
- সাধারণত পাট পচতে ১৫-২৫ দিন সময় লাগে।
আঁশ ছাড়ানো ও পরিষ্কারকরণ
পচার পর পাট গাছ থেকে দু’ভাবে আঁশ ছাড়ানো যায়, যথা-
১। শুকনো জায়গায় বসে প্রতিটি পাট গাছ থেকে আলাদা আলাদাভাবে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর কায়েকটি পাট গাছের আঁশ একত্রে করে ধুয়ে নেওয়া হয় এবং আঁটি বেঁধে রাখা হয়। এক্ষেত্রে পাটের কাঠি ভাঙ্গা হয় না বিধায় আস্ত থাকে।
২। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে পাটের আঁটির গোড়ায় কাঠ বা বাঁশের মুগুর দ্বারা পিটানো হয়। এরপর গোড়া থেকে ৪০-৪৬ সে.মি. দূরে ভেঙ্গে পানির মধ্যে লম্বভাবে কয়েকটি ঝাঁকি দিলেই গোড়ার পাটকাঠি বের হয়ে যায়। পরে গোড়ার আঁশ হাতে পেচিয়ে নিয়ে পানির উপর সমান্তরালভাবে সামনে পিছনে ঠেলা দিলেই অগ্রভাগের পাটকাঠি বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে আঁশগুলো ভালোভাবে ধূয়ে নিয়ে আঁটি বেঁধে রাখা হয়।
পাট পঁচানোর রিবন রেটিং পদ্ধতি
- পাট পঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া গেলে এই রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানো যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনিস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এই রিবন রেটিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন সেখানে কাঁচা অবস্থাতেই পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে পরে অল্প পানিতে তা পঁচানো হয়।
- এই রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট থেকে পাতা ঝরে যাওয়ার পর হাতুড়ির সাহায্যে পাট গাছের গোড়া থেতলে দেওয়া হয়। এরপর একটি বাঁশের খুটির মাথা ইংরেজি U অথবা V অক্ষরের মত তৈরি করে খুটিটি পুতে নিতে হয়। এরপর ছালসহ পাটগাছ U অথবা V এর মাঝখানে রেখে ছাল দুই দিকে টান দিলে কাঠি থেকে পাটের ছাল পৃথক হয়ে যায়।
- এভাবে কয়েকটি গাছ থেকে ছাল ছাড়িয়ে সেগুলো একত্রে আঁটি বাঁধা হয়। এই আটিগুলো পরবর্তীতে একটি বড় চাড়ি বা অন্য কোন পাত্রে পানির মধ্যে রেখে পচানো হয়।
আঁশ শুকানো ও সংরক্ষণ
- প্রখর সূর্যালোকে বাঁশের আড় তৈরি করে তাতে পাটের আঁশ শুকানো হয়।
- আঁশ বেশি শুকালে তা ভঙ্গুর হয় এবং কম শুকালে ভিজা থাকে বিধায় পচনক্রিয়া শুরু হয়। এতে আঁশের গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সঠিকভাবে পাটের আঁশ শুকিয়ে নেয়ার পর সুন্দর করে বেঁধে গুদামে সংরক্ষণ করতে হয়।
ফলন
- জাতভেদে ফলনের তারতম্য হয়। তোষা পাটের তুলনায় দেশী পাটের ফলন সামান্য বেশি হয়।
- দেশী পাটের ফলন প্রতি হেক্টরে ৪.৫-৫.৫ টন এবং তোষা পাটের ফলন ৪-৫ টন পর্যন্ত হয়।
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাট অন্যতম। এদেশের মাটি, জলবায়ু ও পরিবেশ পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। উর্বর দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য উত্তম। জো অবস্থায় ৫-৬ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে পাটের জমি তৈরি করতে হয়। জমি তৈরির শেষচাষের সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়াসহ সকল সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। ফুল থেকে ফল ধরার সময় পাট কাটলে ভালো আঁশ ও ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া পাতা ঝরানো, জাগ দেওয়া আঁশ ছাড়ানো ও শুকানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]