বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পুরণের জন্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। কেবল বর্ধিত জনসংখ্যা নয় দেশের আপামর জনসাধারণের মাছ গ্রহণের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের পুকুর-দিঘি ও বদ্ধ জলাশয়ে পাবদা মাছের চাষ করা যায়।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- পাবদা মাছের চাষ পদ্ধতি শিখতে পারবেন; পাবদা মাছের উপকারিতা বুঝতে পারবেন; পাবদা মাছের ইংরেজি নাম, পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবেন; এছাড়াও পাবদা মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কেত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
নিম্নে পাবদা মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
(১) পাবদা মাছের উপকারিতা
পাবদা মাছের প্রতি ১০০ গ্রামে আমিষ ১৯.২ গ্রাম, চর্বি ২.১০ গ্রাম, শর্করা ৪.৬ গ্রাম, লৌহ ১.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৩১ গ্রাম ও ফসফরাস ০.২১ গ্রাম পাওয়া যায়।
(২) পাবদা মাছের ইংরেজি নাম, পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
পাবদা মাছের ইংরেজি নাম: আমাদের বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির পাবদা মাছ পাওয়া যায় যা বোয়ালি পাবনা (Ompok bimaculatus), মধু পাবনা (Ompok pabda) ও ক্ষুদি পাবদা (Ompok Pabo) বর্তমানে বন্ধ জলাশয়ে মধু পাবদা মাছের চাষ প্রচলিত হয়েছে। মধু পাবদা বা পাবদার বৈজ্ঞানিক নাম হলো- Ompok pabda (Hamilton) এর ইংরেজি নাম হলো- Butter Catfish।
পাবদার মাছের দেহ আঁইশ বিহীন, চকচকে, উজ্জ্বল রূপালী বর্ণের, দেহের উপরিভাগে ধূসর রূপালী ও পেটের দিক রূপালী বর্ণের এবং দুই জোড়া গোঁফ আছে, পাবদা মাছ ক্যাটফিশ শ্রেণীভুক্ত।
পাবদা মাছের সাধারন বৈশিষ্ট্য হলো-
- এ মাছের দৈর্ঘ্য পরিণত অবস্থায় ১৫-২৫ সে.মি. হয়, শ্রী মাছ একই বয়সী পুরুষ মাছের তুলনায় আকারে বড় হয়ে থাকে;
- পাবদা মাছ ১ বছরে পরিপকতা লাভ করে, তবে দুই বছর বয়সী ব্রুড মাছ কৃত্রিম প্রজননে বেশী উপযোগী;
- প্রজনন মৌসুম বেশ দীর্ঘ (ফেব্রুয়ারি সেপ্টেম্বর) তবে এপ্রিল আগষ্টে মাসে এই মাছের সর্বোত্তম প্রজনন মৌসুম কার্প জাতীয় মাছের সাথে একরে চাষ করা যায়;
- ছোট কিংবা বড় জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়;
- কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সহজেই পোনা উৎপাদন করা যায়;
- বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী।
(৩) পাবদা মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস
কাইরোনমিড লার্ভা, টিউবিফের ওয়ার্ম, কুচো চিংড়ি, কেঁচো, জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলা ও পাতার নরম অংশ খায়। এ মাছ সর্বভূক, বটম ফিডার এবং সম্পূরক খাদ্য হিসাবে সরিষার খৈল, চালের কুড়া, ফিসমিল দিয়ে তৈরি খাবার খায়। শিয় কল কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার খেয়ে এ মাছ দ্রুত বড় হয়। পাবদা মাছ নিশাচর তাই রাতে খাদ্য গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
পাবদা মাছের পুকুরের ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী-
- pH: পানির pH ৭.০০-৮.০০ এর মধ্যে থাকলে পাবদা মাছচাষ করা যায়। তবে ৭.৫০-৬.00 মাত্রার pH পাবদা চাষের জন্য উত্তম;
- পানির স্বচ্ছতা: প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতির পরিমাণ ২৫-৩০ সে.মি. সেকি এর মধ্যে থাকলে ভালো হয়;
- খরতা: ৮০-২০০ মিগ্রা/লিটার খরতা পাবনা উৎপাদনের জন্য উপযোগী;
- তাপমাত্রা: ২৫-৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস উত্তম;
- অক্সিজেনের মাত্রা: ৫ পিপিএম এর উপরে থাকতে হবে।
এবার আমরা পাবদা মাছের চাষে মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করব। চলুন শুরু করা যাক-
(৪) পাবদা চাষের পুকুর প্রস্তুতি
পাবদা মাছ একক বা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা যায়। এ মাছ চাষের জন্য পানির গভীরতা ৪-৬ ফুট হলে ভাল হয়। পাবদা মাছচাষের পুকুর প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।
পুকুর প্রস্তুতির প্রধান ধাপগুলো হলো-
- পুকুর শুকাতে হবে;
- তলদেশের কানা ও জৈব অবশেষ অপসারণ করতে হবে;
- পুকুরের তলা মই দিয়ে সমান করে দেওয়া ভালো;
- পুকুরে পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকতে হবে;
- পুকুরের চারপাশে নাইলন নেটের বেড়া দিলে সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি শিকারী সরীসৃপসহ অন্যান্য প্রাণীর অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ হ্রাস করা যায়;
- বাজপাখি, বক, পানকৌড়ি ইত্যাদি শিকারী পাখির আক্রমণ থেকে মাছকে রক্ষা করার জন্য পুকুরের উপরে নেটের ঢাকনি বা আড়াআড়িভাবে ১ হাত পর পর প্লাস্টিক ফিতা স্থাপন করা যেতে পারে;
- পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার জন্য পুকুরের পানি কমিয়ে ২-৩ ফুটে এনে ৯.১%, শক্তিমাত্রায় রোটেনন ২৫ গ্রাম/শতাংশ/ফুট পানিতে অথবা ৭% শক্তিমাত্রায় রোটেনন ৩৫ গ্রাম/শতাংশ ফুট পানিতে প্রয়োগ করতে হয়। বিষক্রিয়ার মেয়াদ ৫-৭ দিন।
(৫) পুকুরে চুন প্রয়োগ
- পুকুরের তলদেশের মাটি ও বিদ্যমান পানির pH অনুসারে চুন (CaO) দিতে হবে;
- তবে দোঁ-আশ ও পলি দোঁ-আশ মাটির চেয়ে লালমাটি, এটেল মাটি, কালচে কাদামাটি ও অধিক অম্লধর্মী মাটিতে বেশী মাত্রায় চুল প্রয়োগের প্রয়োজন হয়;
- দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটির জন্য সাধারণত ১ কেজি/শতাংশে চুন প্রয়োগ করতে হবে। বেশি কাদাযুক্ত বা অধিক পুরাতন পুকুর হলে শতকে ২ কেজি চুন দেয়া যেতে পারে। চুন কাদার সাথে ভালেভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;
- পুকুর প্রস্তুতির সময় চুন বেলা ১১-১২ টার সময় প্রয়োগ করতে হবে।
(৬) পাবদা চাষে সার প্রয়োগ
পাবদা মাছ চাষে সাধারণত পুকুরে সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না, তবে যদি বেশি ছোট আকারের পোনা মজুদ করা হয় তখন ১-২ বার সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। চাষ চলাকালে আর কোন সময় সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়। নিম্নের সারগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি।
খৈল | ২০০-২৫০ গ্রাম/শতাংশ |
টিএসপি | ৫০-১০০ গ্রাম/শতাংশ |
ইউরিয়া | ৫০-১০০ গ্রাম/শতাংশ |
এমপি | ২০-২৫ গ্রাম/শতাংশ |
পাবদা যেহেতু জুপাটেন বেশি পছন্দ করে সে জন্য চাষ চলাকালে শতাংশে চাউলের মিহি কুড়া ২০০ গ্রাম, চিটাগুড় ২০০ গ্রাম, ইয় ৫ গ্রাম ৩ গুণ পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নির্যাসটুকু পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। ঐ ছাঁকনিতে থাকা অবশিষ্ট উপাদানগুলো ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পুনরায় প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে তিন দিন পর পর প্রয়োগ করলে পর্যান্ত প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়।
আবার প্রতি শতাংশে আটা/ময়দা ৫০ গ্রাম, হাল্কা সিদ্ধ করে আঠালো অবস্থায় এর সাথে চিটাগুড় ১০০ গ্রাম মিশিয়ে যদি পানিতে পর পর ৩ দিন প্রয়োগ করা হয় তাহলেও প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
(৭) পাবদা মাছের পোনা মজুদ
পাবদা মাছ একক চাষের জন্য ৩-৫ সে.মি. আকারের বা ১৫০০-২০০০টি/কেজি আকারের পোনা মজুদ করা উত্তম।
নিজস্ব নার্সারিতে পোনা প্রতিপালন করে চাষের পুকুরে বড় আকারের পোনা মজুদ করা ভালো। তবে চাষির মাছ চাষের অভিজ্ঞতা, আর্থিক সামর্থ এবং চাষ ববস্থাপনার উপর পোনা মজুদের হার নির্ভর করে।
পাবদা মাছ একক চাষের পাশাপাশি আন্যান্য মাছের সাথেও মিশ্রভাবে চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে নিম্নের টেবিলের উল্লেখিত হার অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রজাতি | মডেল-১ (সংখ্যা) | মডেল-২ (সংখ্যা) | মডেল-৩ (সংখ্যা) | মডেল-৪ (সংখ্যা) | মডেল-৫ (সংখ্যা) |
পাবদা | ১০০০ | ৭০০ | ৫০০ | ৫০০ | ৩০০-৪০০ |
কার্প | ৪-৬ | ৮-১০ | ৮-১০ | ৩০-৪০ | – |
গুলশা | – | ৩০০ | – | – | ৩০০-৪০০ |
শিং/মাগুর | – | – | ৫০০ | – | – |
রুই | – | – | – | – | ৮-১০ |
টেংরা | – | – | – | – | ৩০০-৪০০ |
- যে সকল পুকুরে এারেশন, পানি পরিবর্তন এবং তলানি অপসারণের ব্যবস্থা আছে সে সব পুকুরে শতকে ২০০০-২৫০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে;
- পুকুরের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনে আংশিক আহরণ করতে হবে;
- পাবদা মাছের সাথে অন্যান্য ছোট প্রজাতির (শিং, গুলশা, টেংরা) মাছ চাষ করলে পাবদা পরে ছাড়তে হবে বা অন্যদের চেয়ে ছোট আকারের পোনা ছাড়তে হবে।
(৮) সুস্থ-সবল পাবদা পোনার বৈশিষ্ট্য
- গারোবর্ণ উজ্জ্বল ও চকচকে, পিঠের দিকে কালচে বর্ণের;
- পোনার গা পিচ্ছিল গায়ে কোন প্রকার ক্ষতচিহ্ন থাকবে না;
- লেজ এবং অন্যান্য পাখনা অক্ষত থাকবে;
- স্রোতের বিপরীতে ঝাঁক বেঁধে দ্রুত চলাচলে সক্ষম।
(৯) পোনা মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা
- পাবদা মাছের ভাল উৎপাদনের জন্য সরাসরি মজুদ পুকুরে পোনা মজুদ না করে নার্সারি পুকুরে প্রতিপালন করে নেওয়া প্রয়োজন;
- এ মাছের পুরুষের তুলনায় স্ত্রী মাছের বর্ধন বেশী, সে জন্য পোনা ক্রয়ের সময় নার্সারার থেকে কাটাই করে বড় আকারের পোনা নিতে পারলে সব চেয়ে ভাল হয়;
- যেহেতু পাবনা স্বজাতীভোজী এদের বড়রা ছোটদের খেয়ে ফেলে, সে জন্য একই আকারের পোনা সংগ্রহের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
(১০) পোনা পরিবহণ
- পাবদা মাছের পোনা ড্রামে পরিবহণ করা যায়। ২৪ সে.মি. আকারের পোনা অক্সিজেনযুক্ত ব্যাগে (৩৬×২২ ×২৪) ব্যাগ প্রতি ১০০০টি হারে ৪-৬ ঘন্টার দূরত্বে পরিবহণ করা যায়;
- পোনার আকার ৪-৫ সে.মি. হলে একই সময়ের দূরত্বে ৫০০টি পোনা একই আকারের ব্যাগে পরিবহণ করা যায়;
- গোনা ভালো রাখার জন্য ৪-৫ লিটার পানির প্রতি ২০টি ব্যাগের জন্য ১০ গ্রাম অক্সিজেন পাউডার, ১ প্যাকেট ওরস্যালাইন ও ভিটামিন-সি ১০ গ্রাম হারে পৃথকভাবে গুলিয়ে ২০ ব্যাগে সমহারে ভাগ করে দিতে হবে;
- পাবদার পোনা সাধারণত রাতে পরিবহণ করা ভাল। তবে সরবরাহের পূর্বেই পোনা টেকসই করে নিতে হবে। সরবরাহের উদ্দেশ্যে পোনা ধরার আগের শেষ রাত থেকে খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখা দরকার। আহরণকৃত পোনাগুলো ট্যাংক ও সিস্টার্ণে ৮-১২ ঘন্টা ঝরণার পানির স্রোতে রেখে টেকসই করা যায়। এরপর পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুণাবলীর যেন তারতম্য না হয় সে জন্য পোনাকে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।
(১১) পাবদা মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- পোনা মজুদ করার পর দিন থেকে মাছের দেহ ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে খান্য প্রয়োগের মাত্রা শতকরা ৩০ ভাগ ক্রমান্বয়ে কমিয়ে শতকরা ৩ ভাগ হারে প্রয়োগ করতে হবে;
- পাবদা মাছচাষে বাজারে প্রাপ্ত ভাসমান খাবার প্রয়োগ করলে দ্রুত ভাল ফলন হয়। মাছের আকার বুঝে ০.৫ মিমি আকারের থেকে খাবার প্রদান শুরু করে মাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের আকার ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন করতে হবে;
- পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে;
- পাবদা মাছের আকার ১-১.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত ৩৫-৪০% আমিষ যুক্ত পাউডার খাবার খাওয়াতে হবে, পরবর্তীতে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে ৩০-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দেয়া যেতে পারে;
- যেহেতু পাবদা মাছ রাতে খেতে পছন্দ করে তাই শেষ রাতে ও সন্ধ্যা রাতে দৈনিক ২ বার খাবার দিতে হয়। মাছের খানা গ্রহণে অনীহা দেখা দিলে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৩ গ্রাম লেসিথিন সমৃদ্ধ খাদ্য (অত্যাবশকীয় এমাইনো এসিড) ৫-৭ দিন প্রয়োগ করতে হবে;
- পাবদা চাষের পুকুরে নিয়মিত পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মাছের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং পুকুরের পানির গুণাগুণ বজায় থাকে, উৎপাদন ভাল হয়;
- মেঘলা আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা কম থাকলে (শীত কালে) খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে;
- কোনভাবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার দেয়া যাবে না;
- রুই জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে ভিজা খাবার প্রয়োগ করলে খাবার ট্রেতে সরবরাহ করতে হবে।
কেজিতে পোনার সংখ্যা | খাদ্য প্রয়োগের হার (দেহের ওজন %) | খাদ্যের ধরন | ৩৩ শতাংশে ৪০০০০টি মাছের জন্য সম্ভাব্য দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ (কেজি) |
২০০০-৩০০০ | ২৫-৩০% | উন্নত নার্সারি ফিড (পাউডার) | ৪-৫ |
১২০০-১৯০০ | ১৫-২০% | উন্নত নার্সারি ফিড (পাউডার) | ৬-৭ |
৪৫০-৮০০ | ১০-১২% | উন্নত নার্সারি ফিড (পাউডার) নার্সারি-২ ফিড (০.৫ মিমি ভাসমান পিলেট) | ১২-১৪ |
৩০০-২০০ | ৫-৮% | স্টার্টার-১ (০.৮ মিমি ভাসমান পিলেট) | ১৭-১৮ |
১০০-৫০ | ৩-৪% | স্টার্টার-১ (১.৫ মিমি ভাসমান পিলেট) | ৪০-৪৮ |
(১২) অন্যান্য ব্যাবস্থাপনা
- পানিতে এ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রাদুর্ভাব (0.020 mg / L ) পরিলক্ষিত হলে বা অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাস (H2S, CH4, CO2 ইত্যাদি) বৃদ্ধি পেলে জিওলাইট ১০০-১৫০ গ্রাম/ শতাংশ। ৩-৪ ফুট গভীরতা প্রয়োগ করতে হবে;
- দ্রবীভূত অক্সিজেন ৩ ppm এর নীচে নেমে গেলে পাবদা মাছ মারা যায়। তাই দ্রবীভূত অক্সিজেন বৃদ্ধির জন্য প্রতি ৩৩ শতাংশে ০.৫০ কেজি অক্সিজেন পাউডার পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে;
- তলদেশের জৈব পচনের জন্য যদি অক্সিজেন ঘাটতি হয় বা পানি ঘোলা হয়ে যায় তাহলে জিওলাইট ২৫০ গ্রাম/শতাংশ হারে ব্যবহার করতে হবে;
- পুকুরের ভৌত ও রাসায়ানিক গুণাগুণ ভালো রাখার জন্য নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা দরকার;
- সফল ও নিরাপদ মাছচাষের জন্য পুকুরে এ্যারেটর স্থাপন করলে ভাল হয়;
- মাছচাষ চলাকালে মাছের বর্জ্য থেকে পুকুরের তলদেশে এ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে থাকে সেজন্য পুকুরের এক কোনায় কচুরিপানা রাখা যেতে পারে। কচুরিপানা পুকুরের পানি হতে এ্যামোনিয়া শোষণ করে নেয়;
(১৩) নমুনাকরণ
- মাছের বৃদ্ধির হার ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য নমুনাকরণ করতে হয়;
- কোনভাবেই জাল টেনে মাছ ধরে দেখা যাবে না কারণ পাবদা মাছের দেহে কোন আঁইশ থাকে না বিধায় অসাবধানতাবসত মাছের কাঁটার আঘাতে মাছের গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখান থেকে সংক্রমণ সকল মাছে ছড়িয়ে পড়তে পারে;
- সাধারণত খাবার দিলে পাবদা মাছ পানির উপরে চলে আসে তা দেখে আমাদের ধারণা করতে হবে মাছ কত বড় হয়েছে বা তাদের সাড়া দেখে বুঝতে হবে মাছ কেমন আছে;
- খুব প্রয়োজন হলে ঠেলা জাল দিয়ে কয়েকটি মাছ ধরে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে;
(১৪) অন্যান্য পরিচর্যা
মাছের চাষ নিরাপদ রাখার জন্য নিম্নলিখিত কাজ করা জরুরি-
- সপ্তাহে ১ বার বেলা ১১-১২ টার মধ্যে পুকুরে হররা টানতে হবে;
- পুকুরে পানি কমে গেলে বাহির থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে;
- পানির স্বচ্ছতা ২৪-২৬ সে.মি সেকি এর মধ্যে রাখতে হবে, প্রতি মাসে একবার শতকে ১৫০- ২০০ গ্রাম হারে চুন দিতে হবে;
- মাসে একবার শতকে ২০০-৩০০ গ্রাম লবণ দিতে হবে;
- পুকুরের তলদেশের গ্যাস দূর করার জন্য জিওলাইট দিতে হবে;
(১৫) মাছের বর্ধন
নিয়মিত মাছকে খাবার সরবরাহ করলে বা যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে পারলে পাবদা মাছ ৫-৬ মাস বয়সে বাজারজাত করার মত বড় হয়ে যায়। তবে যত বড় আকারের মাছ উৎপাদন করা যাবে তত বেশি দাম পাওয়া যায়।
(১৬) আহরণ ও বাজারজাতকরণ
- সাধারণত ৫-৬ মাসে ২০-৩০টি পাবদা মাছে ১ কেজি হয়। এ আকারের পাবদা বাজারে বিক্রয় করা হয়;
- বাজার মূল্য বেশী পাওয়ার জন্য জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করার লক্ষ্যে আহরণের পর মাছ হাউজ বা ট্যাংকে ৮-১২ ঘন্টা পানির ধারায় রাখতে হয়;
- অক্সিজেনযুক্ত পলিথিন ব্যাগে (৩৬” x ২৪” x ২২”) ১.০০ কেজি পর্যন্ত জীবন্ত মাছ ৩৬ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানের দূরত্বে পরিবহণ করা যায়।
সাধারণত পাবদা মাছ জাল টান দিলে বেশিরভাগ মাছ ধরা যায়। পুকুরের পানি কমিয়েও সমস্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। আধা নিবিড় পদ্ধতিতে পাবদা মাছ চাষ করে ৬-৭ মাসে হেক্টরে ৫০০০ থেকে ৬০০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়।
(১৭) সতর্কতা
- পাবদা চাষের ক্ষেত্রে চাষীদেরকে দ্রবিভূত অক্সিজেনের স্বল্পতা প্রতিরোধে সোডিয়াম পার কার্বোনেট বা গ্যাস নিবারক সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন;
- পানির pH ৮ এর উপর হলে তা কমানোর ব্যবস্থা হিসেবে পানি পরিবর্তন করা বা তেঁতুল ব্যবহার করা বা শতকে ১ কেজি হারে জিপসাম প্রয়োগ করা যেতে পারে;
- পানি যাতে বেশি সবুজ না হয়ে যায় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে;
- মাছে অসুখ দেখা দিলে পরিবেশগত চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে;
- অনেক সময় মাছের খাবার গ্রহণ হার কমে যেতে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে পুকুরে পানি দেয়া যেতে পারে, ১৫০-২০০ গ্রাম/শতক মাত্রায় চুন প্রয়োগ করলে সমস্যা সমাধান হতে পারে। মাছ থাকা অবস্থায় চুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে চুন ভালোভাবে গুলিয়ে সকাল ৮-৯ টার মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে;
- সবসময় একই আকারের পোনা ছাড়ার চেষ্টা করতে হবে;
- মাছ চাষে কোন প্রকার সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় মৎস অফিসের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা পাবদা মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় যেমন- পাবদা মাছের উপকারিতা; পাবদা মাছের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য; খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস; পুকুর প্রস্তুতি; চুন প্রয়োগ; সার প্রয়োগ; পোনা মজুদ; সুস্থ-সবল পোনার বৈশিষ্ট্য; পোনা মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা; পোনা পরিবহণ; খাদ্য ব্যবস্থাপনা; অন্যান্য ব্যাবস্থাপনা; নমুনাকরণ; অন্যান্য পরিচর্যা; মাছের বর্ধন; আহরণ ও বাজারজাতকরণ; সতর্কতা প্রভৃতি জানতে পারলাম।
প্রাকৃতিক জলাশয়ে আগে অনেক ধরনের সুস্বাদু ছোট মাছ পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক জলাশয়ে অন্যান্য ছোট প্রজাতির মাছের ন্যায় পাবদা মাছের প্রাচুর্যতা বিভিন্ন কারণে (বিল সেচে, পানি শুকিয়ে মাছ ধরা, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, পলি পড়ে খাল-বিল-নদী ভরাট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি) কমে যাচ্ছে। তাই দেশের প্রাণিজ আমিষের তথা পুষ্টির চাহিদা পূরণে এ ধরনের ছোট মাছের প্রাচুর্যতা ধরে রাখার জন্য লাগসই প্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে চাহিদা সম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের এই সুস্বাদু পাবদা মাছটির উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
[সূত্র: মৎস্য অধিদপ্তর (fisheries.gov.bd); ইন বাংলা নেট কৃষি (inbangla.net/krisi)]