নিম্নে (৬ ধরণের) পেয়ারা গাছের পরিচর্যা, যেমন- ডাল-পালা ছাঁটাই, ব্যাগিং পদ্ধতির প্রয়োগ, সেচ প্রদান, সার ব্যবস্থাপনা, শাখা ছাঁটাই ও ফল ছাঁটাই ইত্যাদি বিষয় সুন্দর ও সহজভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি আলোচনাটি শেষ অবধি মনযোগের সাথে অধ্যয়ন করলে এটি দ্বারা আমাের অনেক প্রকৃতি ও গাছ প্রেমী ভাই/বোনেরা উপকৃত হবেন।
চলুন শুরু থেকে শুরু করি-
(১) পেয়ারার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
- পেয়ারা একটি দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মকালীন ফল। এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় ফল।
- পেয়ারাকে দেশি আপেল বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Psidium guajava ফল মিষ্টত্থান ও বীজপূর্ণ (উন্নত জাতের পেয়ারায় বীজের পরিমাণ কম থাকে।
- পেয়ারা অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু উদ্ভিদ। এটি অন্য ফসলের চেয়ে অনেক বেশি খরা সহ্য করতে পারে।
- সহজলভ্য এ ফল দেশের প্রায় সব জেলাতেই হয়। তবে বৃহত্তর বরিশালসহ ঢাকার অদূরে নরসিংদী ও গাজীপুরে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, পিরোজপুর, স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বি বাড়িয়া, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় চাষ হয়ে থাকে।
(২) পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা
পেয়ারাতে কোন ভিটামিন থাকে?
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু একটি ফল পেয়ারা। দেশি ফলের মধ্যে আমলকীর পরে পেয়ারাতেই সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এটি ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ এবং ক্যালসিয়াম প্রভৃতিতে সমৃদ্ধ।
- পেয়ারার খোসায় কমলায় চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে।
- পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল আছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধক।
(৩) পেয়ারার জাত
- বাংলাদেশের চাষ উপযোগী অনেকগুলো পেয়ারার জাত আছে। সব জাতের পেয়ারাই ছাদে চাষ করা সম্ভব। এর মধ্যে BARI VAR, বাউ পেয়ারা-১ (মিষ্টি), বাউ পেয়ারা-৪, এফটিআইপি বাউ পেয়ারা-৫, বাউ পেয়ারা-৬ এবং থাই পেয়ারা উল্লেযোগ্য। এছাড়াও ইপসা-১ এবং ইপসা-২ পেয়ারাও ভালো জাতের পেয়ারা।
- বীজ অথবা গুটিকলমের চারা বর্ষার শুরুতে বসানো যায়। গুটিকলম সবচেয়ে উপযোগী এবং বাংলাদেশে এর বিপুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
- ১x১x১ হাত গর্তে ১৫ হাত অন্তর রোপণ করতে হয়।
- পেয়ারা গাছের বৈশিষ্ট্য হলো: দুই তিন বছরেই পেয়ারা গাছে ফুল ধরে, বছরে দুই/তিনবার ফুল ধরে। বসন্তের পেয়ারা ফুলের ফল পাকে বর্ষায় আর বর্ষার ফুলের পেয়ারা ফল পাকে শীতে।
- শীতের পেয়ারা ফলই গুণমানে উৎকৃষ্ট আর বাজারদর ভালো থাকায় চাষিদের কাছে তা বেশ লাভজনক। তাই অনেক সময় চাষিরা বসন্তের পেয়ারা ফুলে সেচবন্ধ করে ঝরিয়ে নিয়ে থাকেন। এবং কেবল শীতেই পেয়ারা ফলপাকতে দেন।
- তবে পেয়ারা চাষের প্রধান অন্তরায় এর ডগা শুকানো রোগ। এই রোগ একবার জমিতে এলে একে একে গাছগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। আক্রান্ত গাছগুলো সম্পূর্ণরূপে তুলে পুড়িয়ে ফেললে তবে পার্শ্ববর্তী গাছগুলোতে এর সংক্রমণ প্রবণতা কমে।
(৪) পেয়ারা চাষের উপযুক্ত পরিবেশ
- সাধারণত উষ্ণ ও অবউষ্ণ মণ্ডলের জলবায়ু পেয়ারা উৎপাদনের জন্য উপযোগী। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোঁআশ মাটি থেকে ভারী এঁটেল মাটি যেখানে পানি নিষ্কাশনের বিশেষ সুবিধা আছে সেখানে পেয়ারা ভালো জন্মে।
- বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার করা খুব সহজ। কিন্তু বীজের গাছে মাতৃ গুণাগুণসম্পন্ন পেয়ারা নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই বীজ দিয়ে বংশ বিস্তার না করে কলমের দ্বারা বংশ বিস্তার করাই উত্তম। প্রধানত গুটি কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হয়।
- কিন্তু আজকাল দেখা যায় গুটি কলমে উৎপাদিত চারা উইন্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক হারে বাগান বিলীন হচ্ছে। তাই গুটি কলমের পরিবর্তে উইন্ট প্রতিরোধী জাত যেমন- পলি পেয়ারার রুটস্টকের উপর সংযুক্ত জোড় বা ফাটল জোড় কলমের মাধ্যমে এ পদ্ধতির বংশ বিস্তার করা হয়।
- মে-জুলাই মাস পেয়ারার কলম করার উপযুক্ত সময়।
(৫) ছাদে/টবে পেয়ারা চাষ পদ্ধতি
ছাদে বাগান করার জন্য পেয়ারা খুবই উপযোগী, যে কারণে এখানে বিশেষভাবে আলোচনা করা হলো:
- ছাদে বাগানের জন্য ২০ ইঞ্চি কালার ড্রাম বা টব সংগ্রহ করতে হবে।
- ড্রামের তলায় ৩-৫টি ছিদ্র করে ছিদ্রগুলো ইটের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।
- এবার ২ভাগ বেলে দোআঁশ মাটি, ১ ভাগ গোবর, ৪০-৫০ গ্রাম টিএসপি ও এমওপি সার দিয়ে ড্রাম বা টব ভরে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। ১০-১২ দিন এভাবেই রেখে দিতে হবে। যখন ঝুরঝুরে হবে তখন একটি সবল সুস্থ চারা টবে রোপন করতে হবে।
- চারা রোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়া যেন মাটি থেকে আলাদা না হয়ে যায়।
- চারা গাছটিকে সোজা করা লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উঁচু করে দিতে হবে এবং মাটি হাত দিয়ে চেপে চেপে দিতে হবে। যাতে গাছের গোড়া দিয়ে বেশি পানি না ঢুকতে পারে।
- একটি সোজা কাঠি দিয়ে গাছটিকে বেঁধে দিতে হবে।
- চারা লাগানোর পর লক্ষ রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে। শুকিয়ে গেলে অল্পপরিমাণে পানি দিতে হবে। কখনই বেশি পরিমাণে পানি দিয়ে স্যাঁত স্যাঁতে অবস্থায় রাখা যাবে না।
- গ্রীষ্মকালে গাছ যাতে বেশি শুকিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে সে সময় সকাল বিকাল দুই বেলা করে পানি দিতে হবে। বর্ষার ভাব থাকলে অতিরিক্ত পানি না দিলেও চলবে।
- গাছ লাগানোর ৪/৫ মাস পর থেকে নিয়মিত ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর সরিষার খৈল পচা পানি প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজের উপরই ছাদের গাছের ফলন অনেকাংশে নির্ভর করছে।
- সরিষার খৈল ১০ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর সেই পচা খৈলের পানি পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।
- এক বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ৮ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর টব বা ড্রামের মাটি কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।
(৬) জমিতে পেয়ারা চাষ পদ্ধতি
- বন্যামুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি পেয়ারা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। জমি কয়েক বার চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হয়।
- পেয়ারার চারা বা কলম ৪-৫মি. x ৪-৫ মি. দূরত্বে রোপণ করা হয়। ৬০ x ৬০ x ৬০সে.মি. আকারের মাদা তৈরি করতে হবে।
- প্রতি গর্তে ১০-১৫ কেজি পঁচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে ১৫-২০ দিন পর গর্তের মাঝখানে একটি সুস্থ ও সবল চারা বা কলম রোপণ করতে হবে।
- চারা রোপণের পর পরই চারার গোড়ায় সেচ দিতে হবে এবং একটি খুঁটি পুঁতে চারাটিকে বেধে দিতে হবে যেন চারাটি হেলে না পড়ে বা বাতাস উপড়ে ফেলতে না পারে।
(৭) পেয়ারা গাছের পরিচর্যা
ক) ডাল-পালা ছাঁটাই
গাছ লাগানোর ২ বছর পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পেয়ারার ডাল কেটে দিতে হবে। ছাদের গাছকে যতটা সম্ভব ছোট রাখতে হবে। ডাল-পালা বড় হলে ফলন কম হবে। গাছকে ছোট রাখলেই ছাদের গাছে অধিক ফলন আশা করা যায়।
খ) ব্যাগিং পদ্ধতির প্রয়োগ
পেয়ারা ব্যাগিং করা বা পলি করা বলতে বুঝায় পলিব্যাগ দিয়ে পেয়ারা মুড়ে দেওয়া, যেন-
- মাছি ও পোকা আক্রমণ করতে না পারে
- বাগানে প্রয়োগকৃত বালাইনাশক পেয়ারায় না পড়ে
- অমৌসুমি পেয়ারা উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে দ্রুত বড় হয়
- পেয়ারার ত্বকে পাখি/বাদুড়/পোকার বিষ্ঠা/মুখ বা নখের আঁচড় না লাগে
গ) সেচ প্রদান
আশানুরূপ ফলন পেতে হলে শুষ্ক মৌসুমে ১৫ দিন পর পর গাছে সেচ দিতে হবে। তাছাড়া প্রতিবার গাছে সার প্রয়োগ করে গাছের গোড়ায় প্রয়োজনীয় রস সরবরাহের জন্য সেচ দিতে হবে। এ ছাড়াও বর্ষা কালে পানি নিষ্কাশন ও খরা মৌসুমে নিয়ামিত সেচ প্রদান করতে হবে।
ঘ) সার ব্যবস্থাপনা
i) চারা রোপণের পূর্বে: প্রতি গর্তে ১০-১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে ১৫-২০ দিন পর গর্তের মাঝখানে একটি সুস্থ ও সবল চারা / কলম রোপণ করতে হবে।
ii) চারা রোপণের বছর: বর্ষার আগে ও পরে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম করে পটাশ ও টিএসপি সার এবং ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
iii) প্রতি বছর: ফেব্রুয়ারি, মে ও সেপ্টেম্বর মাসে তিন কিস্তিতে গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। বয়স ভেদে গাছের গোড়া ২৫-৫০ সে.মি. বাদ দিয়ে দুপুর বেলায় গাছ যে পরিমাণ জায়গা জুড়ে ছায়া প্রদান করে সে পরিমাণ জায়গায় গাছের গোড়া চারদিকে সার প্রয়োগের পর সম্পূর্ণ জায়গা কুপিয়ে উপরোক্ত সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
নিচের ছকে বিভিন্ন বয়সের গাছের সারের পরিমাণ দেওয়া হলো-
সারের নাম | পচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | মিউরেট অব পটাশ (গ্রাম) |
১-২ বছর | ১০-১৫ | ১৫০-২০০ | ১৫০-২০০ | ১৫০-২০০ |
৩-৫ বছর | ২০-২৫ | ২৫০-৪০০ | ২৫০-৪০০ | ২৫০-৪০০ |
৬ বা তদূর্ধ্ব বছর | ৩০ | ৫০০-৭৫০ | ৫০০ | ৫০০ |
ঙ) শাখা ছাঁটাই
শাখা ছাঁটাই বলতে সাধারণত মরা, রোগাক্রান্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করা বুঝায়। বয়স্ক গাছে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল সংগ্রহের পর অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। অঙ্গ ছাঁটাইয়ের সময় পাছের গোড়াতে গজানো অফসুটসমূহ অবশ্যই ছাঁটাই করতে হবে। অঙ্গ ছাঁটাই করলে পাছে নতুন ডালপালা গজায় এবং তাতে প্রচুর ফল ধরে।
চ) ফল ছাঁটাই
পেয়ারা গাছে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ফল আসে। এমনকি একই বোটায় ২-৩ টি পর্যন্ত ফল দেখা যায়। গাছের পক্ষে সব ফল ধারণ করা সম্ভব হয় না। ফলের ভারে অনেক সময় গাছের ডালপালা ভেঙে যায় এব ফল আকারে ছোট ও নিম্নমানের হয়। এমতাবস্থায়, গাছকে দীর্ঘদিন ফলবান রাখতে ও মানসম্পন্ন ফল পেতে হলে ফলের আকার যখন মার্বেলের মতো হয়, তখন জাত ভেদে ৪০-৬০ ভাগ ফল ছাঁটাই করে দেয়া দরকার। চারা/কলমের গাছ প্রথম বছর থেকে ফল দিতে শুরু করে। তবে গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রথম বছর ফল হেঁটে ফেলাই ভালো, দ্বিতীয় বছর অল্প সংখ্যক ফল রেখে বাকি ফল ছেঁটে ফেলে নিতে হবে।
[সূত্র: এনসিটিবি]