Skip to content

ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

(১) বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস উপযোগী হয়ে উঠে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা অত্যন্ত ধীর গতিতে অব্যাহত ছিল। কিন্তু বিগত এক শতকে পৃথিবীর অনেক দেশে জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব।

নগরায়ন, যান্ত্রিক সভ্যতা, কলকারখানার প্রসার, জ্বালানি তেল ও কয়লার যথেচ্ছ ব্যবহার, বৃক্ষনিধন ইত্যাদির কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে।

ভৌগলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ আগে থেকেই পৃথিবীর একটি অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দুর্যোগের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে-

  1. বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
  2. বাংলাদেশের জমিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে।
  3. বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অর্থাৎ ভয়াবহ বন্যার সংখ্যা বেড়েছে।
  4. বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে।
  5. গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনা পানি নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে।

দেশের পরিবেশ ও উৎপাদন প্রেক্ষাপটসমূহ বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি খাত।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে বিভিন্ন রকম বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে; যেমন-

  1. গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা।
  2. অনিয়মিত ও অসময়ে বৃষ্টিপাত।
  3. অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টি এবং তার ফলে জলাবদ্ধতা ও ভূমিধস।
  4. শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত।
  5. বন্যার ভয়াবহতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি।
  6. আকস্মিক বন্যা ও খরার ফলে ফসলহানি।
  7. অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম।
  8. উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি।
  9. ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও সংখ্যা।
  10. কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি।

ক) ফসল উৎপাদনে তাপমাত্রার প্রভাব

আমরা আগেই জেনেছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি গ্রীষ্ম ও শীতকালে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। কখনো কখনো গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতকালে অত্যাধিক শীত পড়তে দেখা যাচ্ছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গমে রোগের আক্রমণ বেড়ে যাবে। এখনকার অতিমাত্রায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ সম্ভব হবে না। আলু ও অন্যান্য শীতকালীন ফসল উৎপাদনে ধস নামবে।

ধানের জন্য অসহ্য গরম তাপমাত্রা হলো ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফুল ফোটার সময় ধানগাছ সবচেয়ে বেশি কাতর। এ সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হলে চিটার পরিমাণ বেড়ে যায়।

নিম্ন বা কম তাপমাত্রার কারণে ধানগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ধানগাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে, ধানের চারা দুর্বল হয় এবং ফসলের জীবনকাল বেড়ে যায়।

খ) ফসল উৎপাদনে খরার প্রভাব

বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে খরা অন্যতম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।

ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। কম বৃষ্টিপাত ও অধিক হারে মাটি থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কৃষিক্ষেত্রে খরার প্রভাব দেখা দেয়।

দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় কবলিত হয়ে থাকে। খরাপ্রবণ এলাকায় ফসলের ফলন নির্ভর করে খরার তীব্রতা, খরার স্থিতিকাল এবং ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ের উপর।

ফসলে ক্ষতির মাত্রার উপর নির্ভর করে খরাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়; যেমন-

  1. তীব্র খরা (৭০-৯০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)।
  2. মাঝারি খরা (৪০-৭০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)।
  3. সাধারণ খরা (১৫-৪০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)।

ফসল উৎপাদন মৌসুমের উপর ভিত্তি করে খরাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

  1. রবি খরা।
  2. খরিপ-১ খরা।
  3. খরিপ-২ খরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, ঢাকা ও টাঙ্গাইল জেলার কিছু অংশে তীব্র খরা প্রবণ এলাকা।

রংপুর ও বরিশাল জেলা এবং দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার কিছু অংশ মাঝারি খরাপ্রবণ এলাকা। তবে বর্তমানে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা অববাহিকায় খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

খরাতে খাপ খাওয়ানোর কৌশল হিসাবে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, কম পানি লাগে এমন ফসলের চাষ, জাবড়া প্রয়োগ ইত্যাদি পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযোগী ফসলের চাষ করতে হবে। খরা সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়াতে হবে।

See also  প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদন ও ফসল উৎপাদনে বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষার কৌশল

খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরি হলে নাবি ও খরা সহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করতে হবে। আমন ধান কাটার পর খরা সহনশীল ফসল যেমন— ছোলা চাষ, তেল ফসল হিসাবে তিলের চাষ জনপ্রিয় করতে হবে।

গ) ফসল উৎপাদনে লবণাক্ততার প্রভাব

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততার প্রভাব দেখা যায়।

ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং প্রবল জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বন্যায় সরাসরি লবণাক্ত পানি দিয়ে জমি ডুবে যাওয়ায় মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির নিচের লবণ উপরে উঠে আসে। ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় জমির সিংহভাগ বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর জেলার অনেক এলাকা লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। ফলে এ সব এলাকায় কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ধারা আরও বাড়বে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে অনেক এলাকায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে। এমনিতেই উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫০% জমি বিভিন্ন মাত্রায় প্লাবিত হওয়ায় সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় না। তদুপরি উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল চাষ আরও হুমকির মুখে পড়বে।

এমতাবস্থায় লবণাক্ততা সহনশীল ফসল এবং ফসলের জাতের চাষ উপকূলীয় এলাকায় জনপ্রিয় করতে হবে। লবণাক্ত সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

লবণাক্ত এলাকায় চাষের জন্য বিভিন্ন ধরনের কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমন মৌসুমে বিআর ২৩, ব্রি ধান ৪০, ব্রি ধান ৪১ এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান ৪৭, বিনা ধান ৮ জাতের চাষ করতে হবে।

লবণাক্ততার মাত্রার উপর ভিত্তি করে লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

  1. খুব সামান্য লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটি।
  2. সামান্য লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটি।
  3. মধ্যম লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটি।
  4. তীব্র লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটি।
  5. অতি তীব্র লবণাক্ততা আক্রান্ত মাটি।

ঘ) ফসল উৎপাদনে জলাবদ্ধতা বা বন্যার প্রভাব

যশোর ও খুলনা জেলার ভবদহ এলাকা জলাবদ্ধতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

প্রতি বছর দেশের প্রায় ২৫% জমি বন্যার কারণে বিভিন্ন মাত্রায় প্লাবিত হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে এ দেশে বন্যা হয়ে থাকে। দেশের মোট উৎপাদিত দানা শস্যের ৬০ ভাগের বেশি এ সময় উৎপাদন হয়।

ঘন ঘন বন্যার কারণে কৃষকেরা স্থানীয় জাতের আমন ধান চাষে বাধ্য হয়ে পড়ে, কারণ এসব জাত গভীর পানিতে জন্মাতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার তীব্রতা, স্থায়িত্ব ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসজনিত বন্যা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি করে। জমিতে লবণাক্ত পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ফলে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার কারণে ফসল চাষের অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে।

কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, নীলফামারী ইত্যাদি জেলা ঢল বন্যার শিকার হয়। প্রায় প্রতিবছর এ সব অঞ্চলের হাজার হাজার একর জমির পাকা বোরো ধান কর্তনের আগেই ঢল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক হাজার চারশত বর্গকিলোমিটার এলাকা এ ধরনের ঢল বন্যা প্রবণ। বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ ও সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আরও বেশি বাঁধ, সুইস গেট নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিবে। এগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত দিক ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। কোনো রকম ভুল হলে দীর্ঘদিন তার মাশুল দিতে হবে।

খাপ খাওয়ানোর কৌশল হিসাবে ঢল বন্যাপ্রবণ এলাকায় প্রচলিত ফসলের জাতের চেয়ে আগাম পাকে এমন জাতের ফসল চাষ করতে হবে। ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ৪৫ চাষ করলে ব্রি ধান ২৯ এর থেকে আগে পাকে।

দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবী জাতের ধান, যেমন- নাইজারশাইল, বিআর ২২, বিআর ২৩ এবং ব্রি ধান ৪৬ চাষ করতে হবে।

বন্যার কারণে বীজতলা তৈরির জমি না পেলে দাপোগ পদ্ধতির বীজতলা তৈরি করতে হবে।

বন্যা পরবর্তী সময় দ্রুত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল চাষের জন্য কৃষকদের কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

(২) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল

আমরা জানি, প্রতিকূল পরিবেশে উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় ও জৈব-রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেয়। এ খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে।

ফসলের অভিযোজন কৌশলের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কৃষিবিজ্ঞানীরা প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন। এখন আমরা খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা বা বন্যা ইত্যাদি প্রতিকূল বা বিরূপ পরিবেশে ফসলের অভিযোজন কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করব।

See also  আবহাওয়া কাকে বলে? জলবায়ু কাকে বলে? বাংলাদেশের জলবায়ু কেমন? বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর উপাদান সমূহ ব্যাখ্যা

ক) ফসলের খরা অভিযোজন কৌশল

খরা সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। খরা অবস্থায় ফসলের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় রসের ঘাটতি থাকে, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে, তাপমাত্রা বেশি ও সূর্যালোক প্রখর থাকে। এ অবস্থায় ফসল খরা এড়ানো ও খরা প্রতিরোধ করার মাধ্যমে টিকে থাকে।

খরা এড়ানো: বৃষ্টিপাত শুরু হওয়া ও খরা অবস্থা শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে জীবনচক্র শেষ করে খরা কবলিত না হওয়ার কৌশলকে খরা এড়ানো বলে।

খরা অবস্থায় ফসলের অভিযোজনের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো খরা অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া।

আবাদকৃত ফসলের মধ্যে কিছু কিছু জাতের ফসল রয়েছে যাদের জীবনকাল স্বল্প। কোনো কোনো ফসলের আগাম জাত অল্প সময়ে পরিপক্বতার কারণে দুই-একটি খরা এড়াতে পারে। ফসলের ফুল, ফল ধারণ ও পরিপক্বতার কাল স্বল্প হলে খরা এড়াতে পারে।

যেমন- ফেলনের ফুল ফোটা হতে দানা পরিপক্ক হতে ১৭-২০ দিন সময় লাগে। ফলে খরাপ্রবণ এলাকায় ফেলন চাষ করে খরা শুরু হওয়ার পূর্বেই ফসল তোলা সম্ভব।

খরা প্রতিরোধ: খরাকবলিত অবস্থায় ফসলের টিকে থাকার কৌশলকে খরা প্রতিরোধ বলে।

ফসলের খরা প্রতিরোধ কৌশলকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-

  1. খরা পরিহারকরণ।
  2. খরা সহ্যকরণ।

খ) ফসলের খরা সহ্যকরণ কৌশল

ফসল খরায় পতিত হওয়ার পরও দেহাভ্যন্তরের স্বল্প পানি সাম্যতা নিয়ে টিকে থাকার ক্ষমতাকে খরা সহ্যকরণ বলে।

এ সব ফসল খরা অবস্থা চলে গেলে পুনরায় স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফুল-ফল ধারণ করে।

  1. কোষের পানিশূন্যতা রোধকরণ: এ ধরনের ফসল খরা অবস্থায় কোষের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ দ্রাব জমিয়ে রাখে। ফলে কোষাভ্যন্তরে উচ্চতর অভিস্রবণ চাপ বজায় থাকে। কোষ থেকে পানি শুকিয়ে যায় না এবং কোষ চুপসে যায় না। খরার সময় তুলা ফসলে এটা লক্ষ করা যায়।
  2. মোটা কোষ প্রাচীর: অনেক ফসলে পাতার কোষে পানির পরিমাণ কমে গেলেও কোষ প্রাচীর মোটা হওয়ার কারণে পাতা নেতিয়ে পড়ে না।
  3. উপোসকরণ: কিছু কিছু উদ্ভিদ খরা কবলিত অবস্থায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার হার কমিয়ে দেয়। এ অবস্থায় পাতার কোষ নেতিয়ে পড়লেও রক্ষী কোষ বিভিন্ন প্রকার দ্রাব জমিয়ে রেখে রসস্ফীতি চাপ বজায় রাখে এবং স্বল্প মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রবেশ করিয়ে সীমিত পর্যায়ের সালোকসংশ্লেষণ বজায় রাখে। এভাবে খরাকালীন অবস্থায় উদ্ভিদ কোনো রকমে বেঁচে থাকে।
  4. প্রোটিন ও প্রোলিন জমাকরণ: খরার প্রভাবে উদ্ভিদ দেহের প্রোটিন ভেঙে বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। উদ্ভিদ দেহে প্রোটিন বেশি মজুদ থাকলে তা খরা প্রতিরোধে সাহায্য করে। আবার প্রোটিন ভেঙে নানা রকম বিষাক্ত দ্রব্য উৎপন্ন হতে পারে। এ জন্য কিছু কিছু উদ্ভিদ প্রোলিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করে যা এ বিষাক্ততার মাত্রাকে কমিয়ে ফসলকে খরা সহনশীল করে তোলে।
  5. কোষ গহ্বর শূন্যতা: উদ্ভিদের অঙ্গ ভেদে খরা সহ্য করার সামর্থ্যে পার্থক্য দেখা যায়। উদ্ভিদের যে সব অঙ্গে কোনো কোষ গহ্বর থাকে না, সে সব অঙ্গ খরা সহনশীল হয়। যেমন- খরার কারণে কোনো কোনো উদ্ভিদের পাতা মরে গেলেও পত্র মুকুল মরে না। পত্র মুকুল খরা সহ্য করে এবং খরার অবসান হলে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
  6. সুপ্তাবস্থা: অনেক বহুবর্ষী উদ্ভিদের খরা অবস্থায় মাটির উপরের অংশ মরে যায় কিন্তু মাটির নিচে কন্দ/বাল্ব/রাইজোম ইত্যাদি আকারে সুপ্তাবস্থায় বেঁচে থাকে। অনুকূল পরিবেশে এগুলো অঙ্কুরিত হয়।

গ) ফসলের খরা পরিহারকরণ কৌশল

  1. পত্ররন্ধ্র নিয়ন্ত্রণ: অনেক ফসল পত্ররন্ধ্র খোলা ও বন্ধ হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় পানির অপচয় হ্রাস করে খরা অবস্থা মোকাবেলা করে। যেমন- যব ও লম্বা জাতের অনেক গম ফসল সকালের দিকে অল্প সময়ের জন্য পত্ররন্ধ্র খোলা রাখে এবং দিনের বাকি সময় পত্ররন্ধ্র বন্ধ রাখে। আবার অনেক ফসলের কোষে পানি ঘাটতি হলে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পত্ররন্ধ্রের আকার কমিয়ে দেয়, পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দেয়। শিমের অধিকাংশ জাত এভাবে খরা পরিহার করে। আবার অনেক ফসলের পাতায় পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা কম থাকে, পত্ররন্ধ্র পাতার ছোট ছোট ভাঁজ বা গর্তের মধ্যে থাকে। ফলে প্রস্বেদন কম হয়, পানি সংরক্ষিত থাকে।
  2. প্রস্বেদন নিয়ন্ত্রণ: অনেক ফসল খরায় পতিত হলে পাতার উপর লিপিড জমা করে প্রস্বেদন হারকে কমিয়ে দেয়; যেমন- সয়াবিন ফসল। আবার অনেক ফসল পাতার উপরে মোম বা ঘন রোমের আচ্ছাদন সৃষ্টি করে প্রস্বেদন হ্রাস করে।
  3. পাতার আকার হ্রাসকরণ: অনেক ফসল খরাকবলিত অবস্থায় পাতার আকার হ্রাস করে প্রস্বেদন কমিয়ে দেয়; যেমন- ফেলন। পাতার কিনারা বা পাতার অগ্রভাগ পুড়িয়ে অনেক উদ্ভিদ পাতার আকার হ্রাস করে।
  4. পাতা ঝরানো: খরার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে অনেক ফসল নিচ থেকে পুরাতন পাতা ঝরিয়ে প্রস্বেদন হ্রাস করে। তুলা, চিনাবাদাম, জোয়ার ও ফেলনের এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। খরার অবসান হলে এ ধরনের ফসলে কাণ্ডের শীর্ষ বা পাতার কক্ষ থেকে পুনরায় কুশি গজায়। খরার ফলে ইথিলিন (এনজাইম) উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
  5. সালোকসংশ্লেষণ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ: কিছু ফসল পত্ররন্ধ্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রস্বেদন কমালেও পত্ররন্ধের সাহায্যে খুব কম পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে বেশি পরিমাণ খাদ্য তৈরি করে। ভুট্টা, আখ ইত্যাদি ফসলে এটা দেখা যায়।
  6. দক্ষ মূলতন্ত্র: কিছু কিছু উদ্ভিদ মূলের দৈর্ঘ্য, সংখ্যা ও ঘনত্ব বাড়িয়ে অধিক পরিমাণ পানি আহরণের মাধ্যমে খরা অবস্থা মোকাবেলা করে; যেমন- ভুট্টা, তুলা ও গমের অনেক জাতে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। মূলের অধিক গভীরতা ও ঘনত্ব একই ফসলে বিরাজমান থাকলে সে ফসল অধিক খরা প্রতিরোধী হয়; যেমন- জোয়ার ও বাজরা। আবার ধইনচা, তুলা, অড়হর গভীরমূলী হওয়ায় খরা প্রতিরোধী হয়।
  7. পাতা মোড়ানো ও পাতা কুঞ্চিতকরণ: অনেক দানা ফসল; যেমন- জোয়ার, কাউন পাতার আকার হ্রাসকরণ ছাড়াও খরা পরিবেশে পাতা কুঞ্চিত করে। আবার অনেক ফসল পাতা মুড়িয়ে সূর্যালোক প্রাপ্তির আয়তন কমিয়ে দেয়। ফলে এদের প্রস্বেদন কমে যাওয়ার কারণে পানির অপচয় হ্রাস পায় এবং খরা পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়।
  8. পাতার দিক পরিবর্তন: অনেক উদ্ভিদে খরা অবস্থায় সূর্যালোকের সাথে বা খাড়াভাবে পাতার দিক পরিবর্তন করে। ফলে প্রস্বেদনের হার হ্রাস পেয়ে পানি সাশ্রয় হয়। চিনাবাদাম, তুলা ও ফেলনসহ আরও অনেক দ্বি-বীজপত্রী উদ্ভিদ এ প্রক্রিয়ায় খরা প্রতিরোধ করে।
See also  বিরূপ আবহাওয়া-সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত

ঘ) ফসলের লবণাক্ততা অভিযোজন কলাকৌশল

লবণাক্ততার প্রতি সাড়া প্রদানের উপর ভিত্তি করে ফসলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-

  1. হ্যালোফাইটস- গোলপাতা, কেওড়া।
  2. গ্লাইকোফাইটস— সুগারবিট, শিম, তুলা।

হ্যালোফাইটস জাতীয় উদ্ভিদ লবণাক্ত পরিবেশে অঙ্কুরিত হয়ে সেখানেই জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে যা গ্লাইকোফাইটস পারে না।

লবণাক্ত এলাকার মৃত্তিকা পানিতে অতিরিক্ত সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদির ক্যালসিয়াম ও সালফেট লবণ দ্রবীভূত থাকায় পানির ঘনত্ব বেশি থাকে। এ পরিবেশে উদ্ভিদকে টিকে থাকতে হলে উদ্ভিদের কোষ রসের ঘনত্ব মৃত্তিকা পানির ঘনত্ব থেকে বেশি হতে হয়। বেশি না হলে উদ্ভিদ মাটি থেকে পানি বা খাদ্যোপাদান শোষণ করতে পারে না, উল্টা পানি হারিয়ে নেতিয়ে পড়ে।

এমতাবস্থায় উদ্ভিদ কোষের রসস্ফীতি বজায় রাখার জন্য মাটি হতে বিভিন্ন প্রকার আয়ন (K+, Nat) আহরণ করে লবণাক্ততার এ বাধা অতিক্রম করে। এতে করে উদ্ভিদের দেহাভ্যন্তরে আয়নের আধিক্য ঘটে। কিন্তু লবণ সহ্যকারী উদ্ভিদ আয়নের আহরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

কোনো কোনো প্রজাতির পাতায় একধরনের লবণ জালিকা থাকে যার মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ন বের করে দিতে পারে। আবার কোনো কোনো প্রজাতি পাতার আয়তন বাড়িয়ে শরীরে লবণের ঘনত্ব কমিয়ে নেয়। কোনো কোনো প্রজাতিতে পাতার কোষে অতিরিক্ত আয়ন জমিয়ে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে।

কিছু কিছু উদ্ভিদ আছে যারা লবণাক্ত পরিবেশে আয়ন আহরণ না করে অন্য উপায় অবলম্বন করে। এসব উদ্ভিদের মূলের কোষের রসস্ফীতি বজায় রাখার জন্য কোষ গহ্বরে বিভিন্ন প্রকার জৈব দ্রাব জমা করে রাখে। এ ধরনের উদ্ভিদের কোষ গহ্বরের আয়তন কোষের মোট আয়তনের ৯৫% হয়ে থাকে। কোষ গহ্বরে জমা করা জৈব দ্রব্যের মধ্যে সালোক-সংশ্লেষণজাত দ্রব্যই বেশি থাকে।

জলাবদ্ধ অবস্থায় বা বন্যায় ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল জলজ উদ্ভিদ ছাড়া অধিকাংশ ফসল বন্যা বা জলাবদ্ধ বা মৃত্তিকা পানির সম্পৃক্ত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে না। এ অবস্থায় মাটিতে অক্সিজেনের অভাবে উদ্ভিদের মূল শ্বসনকাজ চালাতে পারে না। যত দ্রুত মাটি বা পানিস্থ দ্রবীভূত অক্সিজেন শেষ হয়ে যায় এ সব উদ্ভিদ তত দ্রুত মারা যায়।

ধান পানি পছন্দকারী উদ্ভিদ। ধান গাছে এ্যারেনকাইমা টিস্যু থাকে। এ টিস্যুর মধ্যে প্রচুর বায়ু কুঠুরি থাকে। বায়ু কুঠুরিতে অক্সিজেন জমা থাকে। ফলে ধানগাছ ডুবে না গেলে বন্যা বা জলাবদ্ধ অবস্থায় বেঁচে থাকে এবং ভালো ফলন দেয়। তবে অনেক দিন ডুবে থাকলে মারা যায়।

গভীর পানির আমন ধান বন্যার পানি বাড়ার সাথে সাথে উচ্চতায় বাড়তে থাকে। এ সব জাতের ধানগাছের পর্ব মধ্যে এক ধরনের ভাজক কলা থাকে যা বন্যার পানি বাড়ার সাথে সাথে দ্রুত বিভাজিত হয়ে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে বন্যা মোকাবেলা করে। আবার লম্বা জাতের ধান উচ্চতার কারণে বন্যা এড়াতে পারে।

ঙ) উচ্চ তাপমাত্রা অভিযোজন কৌশল

উচ্চ তাপমাত্রায় ফসলের সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসনের হার কমে যায়। শ্বসনের তুলনায় সালোকসংশ্লেষণের হার বেশি কমে।

এ অবস্থায় ফসলের প্রোটিন ভেঙে যায়, পানির অপচয় হয়। তাপ সহনশীল উদ্ভিদে উচ্চ তাপমাত্রায় বিশেষ ধরনের স্থিতিশীল প্রোটিন সৃষ্টি হয়।

তাপ সহনশীল উদ্ভিদ দেহ থেকে ভেঙে যাওয়া প্রোটিনকে সরিয়ে দিতে পারে।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts