আলোচ্য বিষয়:
(১) ফুলকপির জাত
ক) বারি ফুলকপি-১ (রূপা)
গ্রীষ্মমন্ডলীয় একটি প্রজাতি থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৯৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- প্রতিটি ফুলকপির ওজন ৮৫০-১০০০ গ্রাম।
- ফুলকপি চারদিকে পাতা দ্বারা আংশিক ঢাকা থাকে।
- বাংলাদেশের জলবায়ুতে ‘বারি ফুলকপি-১’ জাতের বীজ উৎপাদন করা যায়।
- জীবন কাল ৯৫-১০৫ দিন।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-২৮ টন হয়।
- বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ৪৫৮-৫৫০ কেজি।
- জাতটি বাংলাদেশের সর্বত্র চাষাবাদের উপযোগী।
খ) বারি ফুলকপি-২
- বারি ফুলকপি-২ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় মাঝারি আগাম জাত।
- প্রতিটি ফুলকপির গড় ওজন ৭৫০-৮০০ গ্রাম।
- সংগ্রহের সময় কপি মজবুত ও সাদাটে ক্রীম রঙের হয়।
- বীজ বপন থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে ফুলকপি খাওয়ার উপযুক্ত সময়।
- জীবনকাল: ৯৫-১০৫ দিন।
- এ জাতটি দেশের জলবায়ুতে সর্বত্র বীজ উৎপাদনে সক্ষম। জাতটি বাংলাদেশের সর্বত্র শীত মৌসুমে (মাঝারি আগাম) চাষাবাদের উপযোগী।
- ফলন কার্ড ২৫ টন/ হেক্টর এবং বীজ (৪৫০ গ্রাম/ হেক্টর)।
(২) ফুলকপি চাষ পদ্ধতি
ক) জলবায়ু ও মাটি
- সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধা আছে এমন জমি ফুলকপি চাষের জন্য উপযুক্ত। অবশ্য প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় সব রকমের মাটিতেই ফুলকপির চাষ করা সম্ভব।
- আগাম ফসলের জন্য দোআঁশ মাটি নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে ফুলকপির সফল চাষের জন্য মাটিতে যথেষ্ট জৈব সার থাকা দরকার এবং মাটির অম্লতা (pH) ৬.০ থেকে ৬.৫ হলে ভাল হয়।
- ফুলকপির বৃদ্ধির জন্য ঠান্ডা ও আর্দ্র জলবায়ু উত্তম। ফুলকপি চাষের জন্য সবচেয়ে অনুকূল মাসিক গড় তাপমাত্রা ১৫-২২০ সে.।
খ) বীজ বপনের সময় এবং বীজের পরিমাণ
- আগাম জাতের ফুলকপির বীজ বপনের উপযুক্ত সময় আগস্ট মাস (মধ্য শ্রাবণ থেকে মধ্য ভাদ্র)।
- মাঝারি জাতের ফুলকপির বীজ বপন করতে হয় সেপ্টেম্বর মাসে (মধ্য আশ্বিন)।
- আর নাবি জাতের বীজ অক্টোবর মাস (মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক)।
- হেক্টরপ্রতি ফুলকপি চাষের জন্য বীজের প্রয়োজন হয় ২০০-২৫০ গ্রাম।
গ) চারা উৎপাদন
- ফুলকপি চাষের জন্য চারা উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত ফুলকপির বীজ সরাসরি বীজতলায় বপন করা হয়। চারাগুলি দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করা হয় না। এতে বীজের পরিমাণ বেশি লাগে। উপরন্তু চারার স্বাস্থ্য ভাল হয় না। অথচ ভাল ফসল পেতে হলে সুস্থ সবল চারা লাগাতে হয়। তাই প্রাথমিকভাবে বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হয়। বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়।
- প্রতিটি বীজতলার আকার পাশে ১ মিটার এবং লম্বায় ৩ মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- এক হেক্টর জমির চারা উৎপাদন করতে ২০টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।
- বীজতলার মাটি সমপরিমাণ বালি, মাটি ও কম্পোস্ট মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়।
- দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরের ৭/৮ দিন পূর্বে প্রতিটি বীজতলায় ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমপি মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হয়।
- পরবর্তীতে চারা বৃদ্ধির হার কম হলে প্রতিটি বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া ছিটিয়ে দিতে হবে।
ঘ) জমি তৈরি
- সারা দিন রোদ পায় এমন জমি ফুলকপি চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত।
- গভীর চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এরপর দু’সারিতে চারা রোপণের জন্য ১ মি. চওড়া ১৫ থেকে ২০ সেমি উঁচু মিড়ি (বেড) তৈরি করতে হবে।
- সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধার জন্য মিড়িতে চারা রোপণ করাই ভাল। মিড়ির দৈর্ঘ্য জমির আকৃতি এবং কাজের সুবিধা বিবেচনা করে যত ইচ্ছা করা যেতে পারে।
- পাশাপাশি দুই মিড়ির মাঝখানে ৩০ সেমি প্রশস্ত এবং ১৫-২০ সেমি গভীর পিলি (নালা) থাকবে। পিলির মাটি তুলেই মিড়ি তৈরি করা হয়। সেচ দেয়া এবং পানি নিকাশের জন্য পিলি অত্যন্ত জরুরি।
ঙ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি (হেক্টর/কেজি)
ফুলকপির একরপ্রতি ফলন যথেষ্ট। তাই জমিতে সারের কমতি হলে গাছের বৃদ্ধি আশানুরুপ হয় না এবং পরবর্তীতে ফলন কমে যায়। তাই ফুলকপির জমিতে জৈব এবং রাসায়নিক উভয় প্রকারের সার প্রয়োগ করা উচিত। ফুলকপি চাষের জমি সাধারণত নিন্মোক্ত হারে সার প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়।
ফুলকপি চাষে ‘হেক্টরপ্রতি’ সারের পরিমাণ এর সারিণি:
সারের নাম | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | চারা রোপণের পূর্বে গর্তে প্রয়োগ | প্রথম কিস্তি (রোপণের ১৫ দিন পর) | দ্বিতীয় কিস্তি (রোপণের ৩৫ দিন পর) |
গোবর | ১০ টন | ৫ টন | ৫ টন | – | – |
ইউরিয়া | ১৫০ কেজি | – | – | ৭৫ কেজি | ৭৫ কেজি |
টিএসপি | ১৫০ কেজি | ৭৫ কেজি | ৭৫ কেজি | – | – |
এমওপি | ১২০ কেজি | – | – | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি |
জিপসাম | ১০০ কেজি | ১০০ কেজি | – | – | – |
বোরিক এসিড | ১০ কেজি | ১০ কেজি | – | – | – |
চ) চারা রোপণ
- বীজ বপণের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যেই চারা জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়। এসময় প্রতিটি চারায় ৫-৬টি প্রকৃত পাতা হয়ে থাকে। জমির উর্বরতা এবং গাছের বৃদ্ধির উপর রোপণের দূরত্ব নির্ভর করে।
- ফুলকপির চারা দু’সারি পদ্ধতিতে রোপণ করা হয়। সাধারণত এক মিটার প্রশস্ত মিড়িতে ৬০ সেমি দূরত্বে দু’সারিতে ৪৫ সেমি দূরে দূরে চারা রোপণ করা হয়।
- রোপণের জন্য চারা একদিন পূর্বে নার্সারি বীজতলা ভালভাবে ভিজিয়ে নিতে হবে। এতে চারা উঠানো সহজ হয় এবং চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
- ঠান্ডার দিনে বা বিকালেই চারা উঠানো এবং রোপণ করা উচিত। কারণ রাতের বেলা চারা ধকল সামলিয়ে উঠতে পারে।
- রোপণের পরপরই গোড়ায় সেচ দিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং চারা কম মারা যায়। তবে কিছু সংখ্যক চারা নষ্ট হয়ে থাকে। রোপণের ৭ খেকে ১০ দিনের মধ্যেই অতিরিক্ত চারা রোপণ করে খালি জায়গাগুলি পূরণ করতে হবে।
ছ) পরবর্তী পরিচর্যা
- রোপনের পর প্রথম ৪-৫ দিন পরপরই সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৮-১০ দিন অন্তর বা প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিলেই চলবে।
- সেচ পরবর্তী জমিতে ‘জো’ আসলে ফুলকপির স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য চটা ভেঙ্গে দিতে হবে এবং জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
- সারের উপরি প্রয়োগ যথাসময়ে করতে হবে। উল্লেখ্য সারের উপরি প্রয়োগের পর অবশ্যই সেচ দিতে হবে।
- পানি সেচ ও নিকাশের জন্য নালা সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
জ) ফসল সংগ্রহ
- রোপণের পর গাছে যখন ১২ থেকে ১৫টি পাতা হয় তখনই প্রপুস্প মঞ্জুরী দেখা যায়। নাবি জাতসমূহে বা যে সমস্ত জাত দ্বি-বর্ষজীবী সে ক্ষেত্রে ২৫-৩০ পাতা হওয়ার পর প্রপুস্প মঞ্জুরী দেখা যায়। এরপর প্রপুস্পমঞ্জুরী পূর্ণ আকার ধারণ করতে আরও ১৫ দিন সময় লাগে।
- জাতভেদে রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর প্রপুস্পমঞ্জুরী দেখা যায় এবং ৮০-৯০ দিন পর সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। অবশ্য নাবি জাতে বিশেষ করে যেগুলি দ্বি-বর্ষজীবী সে গুলো আরও অনেক বেশি সময় নিয়ে থাকে।
- ফুলকপির প্রপুস্পমঞ্জুরী একটি নির্দিষ্ট আকার লাভ করার পর দৃঢ়, ঠাসা এবং আকর্ষণীয় অবস্থায় সংগ্রহ করা ভাল। পাতা যাতে ফুলকপির প্রপুস্পমঞ্জুরীকে আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে সেজন্য পাতাসহ ফুলকপি আহরণ বা সংগ্রহ করতে হয়।
ঝ) ফলন
উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ২৫ থেকে ৩৫ টন ফুলকপি পাওয়া যায়।
ঞ) ফুলকপির বীজ উৎপাদন
- যে সব ফুলকপির জাত এদেশীয় আবহাওয়ায় উৎপাদন অনুকূল সেসব জাতের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। তবে ফুলকপি পরপরাগায়িত ফসল। এর বীজ উৎপাদনের জন্য অন্য জাত থেকে কমপক্ষে ১০০০ মিটার প্রাথকীকরণ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
- সাধারণত নির্বাচিত সবচেয়ে ভাল ফুলকপিগুলি সংগ্রহ না করে মাঠেই রাখা যেতে পারে। সেখানেই প্রপুষ্প মঞ্জুরীগুলি ফুলে পরিণত হবে এবং মার্চ/এপ্রিল মাসে অর্থাৎ চৈত্র মাসেই বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। এ পদ্ধতিতেই সবচেয়ে বেশি বীজ পাওয়া যায়।
- যেহেতু নির্বাচিত গাছগুলি ক্ষেতে দূরে দূরে থাকে এগুলি পরিচর্যা ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া জমিও পড়ে থাকে। এসব বিষয় বিবেচনা করে বীজের জন্য নির্বাচিত গাছগুলি পুষ্পমঞ্জুরীসহ উঠিয়ে যথাযথ সার এবং যত্নসহকারে তৈরি একটি জায়গায় ৭৫ সেমি × ৭৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করা যেতে পারে স্থানান্তরের সময়ে প্রপুষ্পমঞ্জুরীর মধ্যবর্তী অংশ কেটে ফেলতে হয়। এতে বীজের মান উন্নত হয়।
- মৌমাছি যাতে ভিড়তে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এসময় কোন কীটনাশক ছিঠানো ঠিক হবে না।
[সূত্র: বিএআরআই]