(১) বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বৃক্ষরোপণের নিয়মাবলি
বসতবাড়ির চারপাশে নানারকম গাছপালা লাগানো হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্নরকম সবজি চাষও করা হয়। এর ফলে বাড়িতে ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ রকম পরিবেশে দেহ ও মন সুস্থ থাকে। বাগানের বিভিন্ন রকম ফল ও সবজি বাড়ির লোকজনের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। অতিরিক্ত উৎপাদিত দ্রব্যাদি পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দেয়।
বসতবাড়িতে প্রধানত ফল জাতীয় গাছ যেমন: আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, কুল প্রভৃতি গাছ লাগানো হয়। অনেক বাড়িতে নানা রকম কাঠের গাছ যেমন: সেগুন, মেহগনি ইত্যাদি গাছ লাগাতে দেখা যায়। এ ছাড়া বসতবাড়ির আঙ্গিনায় লাউ, শসা, শিম, পুঁইশাক, বেগুন, টমেটো, মরিচ জাতীয় সবজি চাষও করা হয়।
বসতবাড়িতে গাছ লাগানোর সময় যেসকল বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, তা হলো-
- বসতবাড়ি হতে দূরে গাছপালা লাগাতে হবে। যাতে গাছের মরা ডাল ও পাতা করে বসতবাড়ির টিনের চালা ও ছাদের ক্ষতি করতে না পারে।
- বাড়িতে আলো-বাতাস প্রবেশে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
- ঝড় তুফানে গাছপালা ভেঙে পড়ে যেন জীবনহানি করতে না পারে।
- গাছপালা যেন বসতবাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে মনোরম পরিবেশ তৈরি করে।
বসতবাড়ির বৃক্ষরোপণের বিভিন্ন নিয়মাবলি-
- পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে ছোট ও মাঝারি আকারের গাছ যেমন- পেয়ারা, আতা, শরিফা, মেহেদী, জবা ইত্যাদি গাছ লাগাতে হবে। কারণ দক্ষিণ ও পূর্ব দিক নিয়ে বাড়িতে যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।
- দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে শক্ত ও পাতাঝরা গাছ লাগাতে হবে। যেমন: সুপারি, নারিকেল, শিশু, সেগুন ইত্যাদি। এসব গাছের ডালপালা কম ও শীতকালে পাতা ঝরে যায়। ফলে বাড়িতে পর্যাপ্ত রোদ আসতে পারে।
- বাড়ির উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে সব রকমের বড় গাছপালা লাগানো যায়। যেমন: আম, কাঁঠাল, জাম, মেহগনি, কড়ই ইত্যাদি। এসব বড় বড় বৃক্ষ কালবৈশাখীর হাত থেকে আমাদের বাড়িঘরকে রক্ষা করে।
- বাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিকে ফাঁকা জায়গা বেশি থাকলে বাঁশ লাগানো যেতে পারে। কারণ গ্রামীণ জীবনে বাঁশের ব্যবহার বেশি হয়। তাছাড়া বাঁশের অর্থনৈতিক গুরুত্বও বেশি।
- এছাড়াও বাড়ির পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করা যায়। ধুন্দল, মেটে আলু, শিম, ঝিঙ্গা, গোলমরিচ ইত্যাদি লতানো উদ্ভিদগুলো মাঝারি উচ্চতার গাছে জন্মানো যায়। তাছাড়া বাড়ির ছায়াযুক্ত স্থানে আদা, হলুদ, মানকচু ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে।
(২) বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা
পলিব্যাগে উৎপাদিত চারা রোপণের ধাপ:
- সব জায়গায় বৃক্ষরোপণের নিয়ম প্রায় একই রকম। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বৃক্ষরোপণের জন্য মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হওয়ার এক মাস আগে গর্ত করতে হবে। গর্ভের আকার হবে (৫০ সেমি x ৫০ সেমি x ৫০ সেমি)।
- গর্তে মাটির সঙ্গে ১০ কেজি গোবর সার, ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০ গ্রাম এমওপি সার ভালো করে মেশাতে হবে।
- সার মেশানো মাটি গর্তে কমপক্ষে এক মাস রেখে দিতে হবে। এক মাস পর যখন মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হবে, তখন ভালো নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে।
চারা লাগানোর সময় প্রয়োজনীয় সাবধানতা:
- সতর্কতার সাথে পলিব্যাগটি ধরে একটি ধারালো ব্লেড বা ছুরি দিয়ে পলিব্যাগটি কেটে অপসারণ করতে হবে।
- খেয়াল রাখতে হবে চারার গোড়ার মাটি যেন ভেঙে না পড়ে।
- চিত্রের মতো করে চারাটি সাবধানে গর্তে বসিয়ে মাটি দিয়ে চারদিকের ফাঁকা অংশ ভরাট করে দিতে হবে।
- লাগানোর সময় চারাটির সবুজ অংশ যাতে মাটিতে ঢেকে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
- চারার গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে নিতে হবে, যাতে গোড়ায় পানি জমতে না পারে।
চারার পরিচর্যা:
- চারার গোড়ার আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
- শীতকালে মাটির রস ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য চারার গোড়ায় খড়কুটা বিছিয়ে মালচিং করতে হবে।
- শুষ্ক মৌসুমে বিকেলে নিয়মিত পানি সেচ করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
- চারার বৃদ্ধি ভালো না হলে ৩-৪ মাস পরে সার প্রয়োগ করতে হবে। চারাপ্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার দিতে হবে।
- চারার গোড়া থেকে ১২-১৫ সেমি দূরে চারার চারদিকে সরু শক্ত কাঠি দিয়ে ৮-১০টি গর্ত করাতে হবে। এ গর্তসমূহে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার সমান ভাগ করে দিতে হবে। এভাবে সার প্রয়োগ করাকে ডিলিং পদ্ধতি বলে।
- মাটি শুকনো থাকলে সার দেওয়ার পর যথেষ্ট পরিমাণ পানি নিয়ে গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।
- প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে একবার এবং বর্ষার শেষে একবার সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতিবার ইউরিয়া ৭৫ গ্রাম, টিএসপি ৫০ গ্রাম এবং এমওপি ৫০ গ্রাম করে ডিবলিং পদ্ধতিতে চারার গোড়ায় সার প্রয়োগ করতে হবে।
- চারা রোপণের পরের ৩ বছর এভাবে সার প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে।
(৩) বসতবাড়ির ছাদে, টবে ও বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা
ক) বাড়ির ছাদে ও টবে লাগানোর উপযোগী গাছ
লেবু, কমলা, পেয়ারা, বিলিম্বি, কামরাঙ্গা, ডালিম, আম্রপালি, আম প্রভৃতি ফল গাছ। প্রায় সব রকমের ফুল গাছ বাড়ির ছাদে টবে চাষ করা যায়। লাউ, মরিচ, টমেটো, পুঁইশাক, বেগুনসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ বাড়ির ছাদে টবে করা যায়।
খ) টবে চাষ পদ্ধতি
গাছ লাগানোর টব বিভিন্ন রকম ও আকারের হয়ে থাকে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, গাছের আকার টবের আকারের উপর নির্ভরশীল।
৪৫ সেমি একটি টবের জন্য মাটি তৈরির নিয়ম:
টবে চারা লাগানোর পূর্বে ২ ভাগ দোআঁশ মাটি ও ১ ভাগ গোবর সার একসাথে মেশাতে হবে। ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার ভালো করে মিশিয়ে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। এবার টবের ঠিক মাঝখানে কলম বা চারা রোপণ করতে হবে।
স্থায়ী বেড পদ্ধতি:
আমাদের দেশে বাগান করার জন্য বর্তমানে এটি একটি আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ছাদের চারদিকে ২ মিটার গ্রন্থের দুই পাশে ৫০ সেমি উঁচু দেয়ালে ১৫ সেমি গাঁথুনির নেট ফিনিশিং ঢালাই দিয়ে তৈরি করতে হয়। মাঝখানে খালি জায়গার তলায় ৫ সেমি ইটের শুরকির পরে ৫ সেমি গোবর সার দিতে হয়।
এবার ২ ভাগ দোজীশ মাটি ও ১ ভাগ গোবর সার মিশিয়ে ভরাট করে স্থায়ী বেড তৈরি করা হয়। ছাদ ঢালাই ও দেয়াল গাথুনির প্রতিটি ক্ষেত্রে নেট ফিনিশিং দিতে হয়। এতে ছাদের কোনো রকম ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
টব বা হালের গাছের পরিচর্যা:
১ কেজি পঁচানো খইলের সাথে ৩ লিটার পানি মিশিয়ে মধ্যম তরল তৈরি করতে হবে। ৪৫ সেমি টবের জন্য আধা লিটার, ড্রাম বা স্থায়ী বেডের জন্য ১ লিটার পরিমাণ দিতে হবে। ১৫ দিন পরপর নিয়মিত এ সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। তরল সার প্রয়োগের ১ ঘন্টা আগে ও এক ঘণ্টা পরে পানি দিতে হবে।
টবে লাগানো দীর্ঘজীবী গাছে নিয়মিত সেচ ও সার প্রয়োগ করতে হবে। এমনভাবে পানি দিতে হবে, যাতে টবের মাটিতে সর্বদা রস থাকে। সপ্তাহে দুইবার গাছের গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে দিতে হবে।
গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাগান
আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে ফুল, ফল ও কাঠের গাছ রোপণ করা হয়। এ বাগানে কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠালিচাপা, সোনালু, বাগান বিলাস, আরুল, পক্ষরাজ, জবা, উপরসহ নানা রকম ফুলের গাছ লাগানো হয়। আবার মেহগনি, রেইনট্রি, আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি কাঠ ও ফলের গাছ রোপণ করা হয়।
আমাদের দেশে বিশেষ করে শীতকালীন ফুল বাগান খুব সুন্দর হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি ও সৌন্দর্য বর্ধনে এ ধরনের বাগান করা অপরিহার্য।
[সূত্র: এনসিটিবি]