যে সব পশু গৃহে লালন-পালন করা হয়, বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং যাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে সেগুলোই হলো মূলত গবাদি পশু। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি হচ্ছে বাংলাদেশের গবাদি পশু।
বাংলাদেশে পোল্ট্রি চাষ হল বিভিন্ন ধরনের পাখির মাংস, ডিম, পালক উৎপাদন অথবা বিক্রয়ের জন্য গৃহীত প্রক্রিয়া। যাদের মাঝে রয়েছে মুগরী, টার্কি, হাঁস, যাদেরকে মাংস ও ডিমের জন্য পালা হয়।
মাছ সমুদ্রের লোনা জল এবং স্বাদু জলের খাল, বিল, হাওর, বাওর, নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবায় বাস করে। পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে শুরু করে মহাসাগরের গহীন অতল স্থানে, অর্থাৎ যেখানেই পানি রয়েছে সেখানেই মাছের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মাছ মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মাছ মানবদেহে অন্যতম আমিষ যোগানদাতা।
এ পাঠ শেষে আপনি- বাংলাদেশের কৃষিতে গবাদিপশুর ক্ষেত্র ও গবাদিপশুর গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারবেন। বাংলাদেশের কৃষিতে পোল্ট্রি ক্ষেত্র ও পোল্ট্রি উৎপাদনের বিভিন্ন বিষয় জানতে পারবেন। মৎস্য বলতে কী বোঝায়, মাছ উৎপাদনের গুরুত্ব ও বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
(১) বাংলাদেশের কৃষিতে গবাদিপশু
বাংলাদেশের কৃষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল গবাদি পশু। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত পশু গৃহে স্থায়ীভাবে লালন পালন করে আসছে, এদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রধান।
ক) বাংলাদেশে গবাদি পশুর সংখ্যা (লক্ষ)
পশু | ২০০৯-১০ | ২০১০-১১ | ২০১১-১২ | ২০১২-১৩ | ২০১৩-১৪ | ২০১৪-১৫ | ২০১৫-১৬ |
গরু | ২৩০.৫১ | ২৩১.২১ | ২৩১.৯৫ | ২৩৩.৪১ | ২৩৪.৮৮ | ২৩৬.৩৬ | ২৩৭.৩৫ |
মহিষ | ১৩.৪৯ | ১৩.৯৪ | ১৪.৪৩ | ১৪.৫০ | ১৪.৫৭ | ১৪.৬৪ | ১৪.৭১ |
ছাগল | ২৩২.৭৫ | ২৪১.৪৯ | ২৫১.৭৬ | ২৫২.৭ | ২৫৪.৩৯ | ২৫৬.০২ | ২৫৭.৬৬ |
ভেড়া | ২৯.৭৭ | ৩০.০২ | ৩০.৮২ | ৩১.৪৩ | ৩২.০৬ | ৩২.৭০ | ৩৩.৩৫ |
তথ্যসূত্র: প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, ২০১৭
খ) গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত দ্রব্যসমূহ
গবাদি পশু জবাইয়ের পর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল খাদ্য অনুপযোগী দ্রব্য জমা হয় সেগুলোকে গবাদিপশুর উপজাত দ্রব্য বলা হয়। এগুলো হল বর্জ্য মাংস, হাঁড়, রক্ত, নাড়িভূড়ি, মলমূত্র ইত্যাদি। এ উপজাতদ্রব্যগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে বিভিন্ন কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার এগুলো যথাযথ সংরক্ষণের পরিবেশ ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায়। উপজাতগুলো দিয়ে উৎকৃষ্ট জৈব সার ও মাছের খাদ্য তৈরি করা যায়। হাড় ও শিং বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরিতে কুটির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
গ) গবাদি পশুর গুরুত্ব
আমাদের জীবনে গবাদি পশুর গুরুত্ব অনেক। নিম্নে গবাদি পশুর নানাবিধ গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-
- জমি চাষ করতে গরু-মহিষ ব্যবহৃত হয়।
- শস্য মাড়াই করতে গরু মহিষ ব্যবহার করা হয়।
- পণ্য পরিবহনের জন্য গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
- তেলের ঘানি, আখ মাড়াই মেশিন ইত্যাদি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় শক্তি গরু মহিষের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
- প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হল গবাদি পশুর মাংস ও দুধ।
- গবাদি পশু এবং তাদের মাংস ক্রয়-বিক্রয় করে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
- কোন কোন গবাদি পশু যেমন ছাগল ও ভেড়া পালনে মূলধন কম লাগে।
- দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করে প্রচুর আয় করা হয়।
- গবাদিপশুর চর্বি সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
- জ্বালানি হিসেবে গোবর ব্যবহৃত হয়।
- গবাদিপশুর মলমূত্র (গোবর) উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহৃত হয়।
- গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যায়।
- গবাদিপশু বিক্রয় করে এককালীন অনেক অর্থ পাওয়া যায়।
- ভেড়া-ছাগলের পশম দ্বারা দামী শীতবস্ত্র তৈরি করা হয়।
- গবাদিপশুর চামড়া, পশম, হাড় ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়।
(২) বাংলাদেশের কৃষিতে পোল্ট্রি
বাংলাদেশে কৃষির একটি অন্যতম ক্ষেত্র হল পোল্ট্রি বা গৃহপালিত পাখি।
পাখি কাকে বলে: যে সকল জীবের পাখনা আছে, যারা উড়তে পারে এবং ডিম দেয় তাদেরকে পাখি বলা হয়।
গৃহপালিত পাখি কাকে বলে: অর্থনৈতিক প্রয়োজনে মানুষ যেসব পাখি গৃহে পালন করে তাদের গৃহপালিত পাখি বলে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গৃহপালিত পাখি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশে গৃহপালিত পাখি যেমন হাঁস-মুরগী, কবুতর উল্লেখযোগ্য। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই গৃহপালিত পাখি পালন করা হয়। এগুলো একদিকে যেমন পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা মেটায় তেমনি বাড়তি অংশ বিক্রয় করে অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়া যায়।
গ্রামের পরিবারে সাধারণত দেশীয় জাতের পোল্ট্রি পালন করা হয়। তবে বর্তমানে অনেকেই পোল্ট্রি শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এজন্য নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকেও উন্নত জাত আমদানি করা হয়েছে। যেমন ’জাপানি কোয়েল’ নামক এক প্রকারের পাখি বাংলাদেশে পালন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকারি গবেষণা কেন্দ্রে প্রাণীবিজ্ঞানীরা ‘শুভ্রা’ নামে একটি ডিম পাড়া মুরগীর জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতের মুরগী বছরে ২৮০-২৯৫ টি ডিম দেয়।
ক) পোল্ট্রি কাকে বলে? পোল্ট্রি বিজ্ঞানের কাকে বলে? পোল্ট্রি শিল্পের ধারনা
পোল্ট্রি কাকে বলে: অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত যে সব পাখি মানুষের তত্ত্বাবধানে থেকে মুক্তভাবে বংশবৃদ্ধি করে এবং যাদেরকে পারিবারিক বা খামার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে পালন করা হয় তাদেরকে গৃহপালিত পাখি বা পোল্ট্রি বলে। যেমন হাঁস, মুরগী, কোয়েল, কবুতর ইত্যাদি।
পোল্ট্রি বিজ্ঞান কাকে বলে: বিজ্ঞানের যে শাখায় গৃহপালিত পাখি নিয়ে গবেষণা করা হয় বিশেষ করে পাখির খাদ্য, প্রজনন, বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে তাদের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে আালোচনা করা হয় তাকে পোল্ট্রি বিজ্ঞান বলে।
পোল্ট্রি শিল্পের ধারনা: বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নত ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাতের হাঁস মুরগী ও কোয়েল পালন করা হচ্ছে। এ কৃষি ক্ষেত্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে একটি শিল্পের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এদেশের অনেক বেকার যুবকযুবতী তাদের শ্রম দিয়ে নতুন নতুন পোল্ট্রি শিল্প গড়ে তুলছে এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেড় লক্ষের কিছু কম পোল্টি খামার চালু আছে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ১৪৮৯৩৩ এবং এই খাত থেকে নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যা হল ২২৩৩৯৯৫ জন।
খ) পোল্ট্রির (মুরগী) শ্রেণীবিন্যাস
জাত, উপজাত ও স্ট্রেইন মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রকারের মুরগী আছে। এদেরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- উৎপত্তিভিত্তিক ও উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ।
i) উৎপত্তিভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
উৎপত্তি স্থানের উপর ভিত্তি করে মুরগীর জাত ৪ প্রকার, যথা-
- আমেরিকান শ্রেণী: যেমন, রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পাশায়ার, প্লাইমাউথ রক ইত্যাদি।
- ভূ-মধ্যসাগরীয় শ্রেণী: যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, অ্যানকোনা ইত্যাদি।
- ইংলিশ শ্রেণী: যেমন, অস্ট্রারলর্প, কার্ণিশ, সাসেক্স ইত্যাদি।
- এশিয়া শ্রেণী: যেমন: ব্রাহমা, কোচিন, আসিল ইত্যাদি।
ii) উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
ডিম ও মাংস উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে মুরগীর বিশুদ্ধজাত গুলোকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যথা-
- ডিম উৎপাদনকারী জাত: এ জাতের মুরগী আকারে ছোট ও ওজনে তুলনামূলকভাবে হালকা হয়ে থাকে। তবে এরা বেশ বড় আকারের ডিম দেয়। বছরে ২৫০-৩০০ টি বা তার চেয়ে বেশি ডিম ও দিতে পারে। যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, স্টারক্রস সাদা, ইসাব্রাউন ইত্যাদি।
- মাংস উৎপাদনকারী জাত: এ মুরগী আকারে বেশ বড় ও ওজনে খুব ভারী। এদের শারীরিক বৃদ্ধি খুব বেশি হয় তবে এরা ডিম কম দেয়। এরা ৬-৮ সপ্তাহে ১.৫-২.০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে এবং পূর্ণবয়সে ৪ কেজি পর্যন্তও হয়। এদের মাংস অত্যন্ত নরম ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। এদের খাদ্যকে মাংসতে রুপান্তরিত করার ক্ষমতা (১.৮:১) অর্থাৎ এরা গড়ে ১.৮ কেজি খাদ্য গ্রহন করে ১ কেজি মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম।
- ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী বা দ্বৈত জাত: এ জাতের মুরগীর আকার মাঝারি ও ওজনে মোটামুটি ভারী, এরা মাঝারি পরিমান ডিম ও মাংস দেয়। উদাহরণ: রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পশায়ার, অস্ট্রালপ ইত্যাদি।
গ) পোল্ট্রির অর্থনৈতিক গুরুত্ব
মানুষের খাদ্য সরবরাহ, পুষ্টির চাহিদাপুরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষেত্রে পোল্টির গুরুত্ব অপরিসীম।
নিম্নে পোল্ট্রির অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
- পোল্ট্রির মাংস ও ডিমের চাহিদা থাকায় এগুলো বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা যায়।
- বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অল্প সময়ে অনেক মুরগী পালনের মাধ্যমে বেশী অর্থ উপার্জন করা যায়।
- হাঁস মুরগীর খামার করে অনেক বেকার জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়।
- পোল্ট্রির শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প যেমন: পোল্ট্রির খাদ্য ও ঔষধ ইত্যাদি শিল্প গড়ে ওঠে এবং অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
- পোল্ট্রি পালন করে পরিবারে বাড়তি আয় করা যায়।
- হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা ব্যায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- পোল্ট্রির মাংস ও ডিম মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে অনেক ভূমিকা রাখে।
- পোল্ট্রির বিষ্ঠা ও লিটার থেকে উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করা হয়।
- পোল্ট্রির উপজাত দ্রব্য যেমন রক্ত, নাড়িভুড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করে পাখির ও মাছের খাদ্য তৈরী করা যায়।
- অনেক পাখিই মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগায়। যেমন: মোরগের লড়াই, কবুতরের ডাক ইত্যাদি।
(৩) বাংলাদেশের কৃষিতে মৎস্য (মাছ)
মৎস্য উৎপাদন কৃষি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এ উৎপাদন ব্যবস্থার ভৌত পরিবেশ হচ্ছে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, বাঁওর, পুকুর, ডোবা, দীঘি, হ্রদ, নদ-নদী এবং সমুদ্র ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে পতিত জমি ও ফসলের জমি খনন করে এবং ঘের তৈরী করেও মাছের চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ফসলের পরেই মাছের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করে মাছ।
ক) মৎস্য প্রজাতি ও এর চাষ
মাছ কি: মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের দেহে জোড় বক্ষ শ্রেণি পাখনা থাকে। প্রতিটি পাখনার মাঝে কাঁটা থাকে। এরা ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়।
মৎস্য বলতে কি বুঝায়: মৎস্য বলতে সকল জলজ প্রাণী যেমন-মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, ডলফিন ইত্যাদিকে বোঝায়।
মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২০,০০০ এর মত। বাংলাদেশে স্বাদু ও লোনা পানিতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ২৯৬ ও ৫১১ (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)।
খ) মৎস সম্পদের অবকাঠামো
সাল ২০২০ অনুযায়ী-
- বাংলাদেশে মৎস্য হ্যাচারীর সংখ্যা ৯০২টি। এর মধ্যে সরকারি ৮৯টি এবং বেসরকারি ৮১৩টি। গলদা হ্যাচারি ৩৬টি (সরকারি ১৭টি, বেসরকারি ১৯টি) এবং বাগদা হ্যাচারি ৪৯টি (বেসরকারি)।
- বাংলাদেশে মৎস্য ও চিংড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬টি, মৎস্য প্রশিক্ষণ একাডেমি ১টি, মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট ৪টি, চিংড়ি প্রদর্শনী খামার ২টি।
- মৎস্য হ্যাচারি/মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার ১৩৬টি।
- চিংড়ি আহরণ ও সেবা কেন্দ্র ২০টি।
- মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) ৯টি এবং মৎস্য গবেষণার জন্য উপকেন্দ্র ১০টি।
গ) মাছ উৎপাদনের গুরুত্ব
বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুল এবং পানি সম্পদে সমৃদ্ধ। ১৯৮০ সালে প্রথম বাংলাদেশে বিদেশী মৎস্য প্রজাতির চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। এ সময় থেকে পতিত জমি, ধান ক্ষেত, ডোবা, নালা ও হাজামজা পুকুরকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলা হয়। বিভিন্ন ধরনের বিদেশী মৎস্য প্রজাতি যেমন কার্প, সিলভার কার্প, পাঙ্গাশ, মিরর কার্প, থাই সরপুুঁটি, তেলাপিয়া ইত্যাদি বাংলাদেশে ব্যপক হারে চাষ হয়। এতে মাছের বাজারমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে এবং টাটকা মাছ বাজারে পাওয়া যায়।
মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক সফলতা লাভ করেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ স্থান দখল করেছে। মানুষের আমিষের ঘাটতি কমে আসছে এবং মাথাপিছু মাছ খাবার পরিমান বেড়ে গেছে। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩.৬৫%।
মাছ উৎপাদনে পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা-
- মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস।
- মাছ উৎপাদন, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপনন ইত্যাদি বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে।
- মাছের উপজাত থেকে প্রস্তুুতকৃত ফিস মিল, জৈব সার ও পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- ফসল-গাভী, হাঁস, মুরগী ও মাছের সমন্বিত চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
- মাছের তেল, সাবান, ঔষধ, গ্লিসারিন, বার্নিশ প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
- মাছের কাঁটা, দাঁত, লেজ ইত্যাদি থেকে সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুুত করা হয়।
- বাংলাদেশ হিমায়িত মাছ, চিংড়ি, শুটকি, লবণজাত মাছ এবং অন্যান্য মৎস্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
- মৎস্যজাত শিল্প কারখানা যেমন বরফ তৈরী, জাল বুনন ও মেরামত, মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণ তৈরি শিল্প গড়ে উঠেছে।
ঘ) মাছের প্রতিবেশ
মাছের প্রতিবেশ দু’ধরনের, যথা- আভ্যন্তরীন জলাশয় ও উন্মুক্ত জলাশয়।
i) আভ্যন্তরীন জলাশয়
বাংলাদেশের স্থুলভাগে যে সমস্ত জলাশয় রয়েছে তাই আভ্যন্তরীণ জলাশয়।
আভ্যন্তরীন জলাশয় ৫ প্রকার হয়ে থাকে, যথা-
- মুক্ত জলাশয়: নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল, হাওর ইত্যাদি। এই মুক্ত জলাশয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- বদ্ধ জলাশয়: পুকুর, ডোবা ও দীঘি। মোট আয়তন ৭৮২৫৫৯ হেক্টর। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- বাঁওর: নদীর প্রবাহ বাধা প্রাপ্তির জন্য নদীর কিছু অংশ বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি করে, একেই বাঁওর বলে। এদেশে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৮০ টি বাঁওর আছে। কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও সিলেট জুড়ে এই বাঁওরগুলোর অবস্থান এবং আনুমানিক মোট আয়তন ৫.৪৮৮ হেক্টর। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- চিংড়ির ঘের প্রতিবেশ: জোয়ারের পানি আটকিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা যেমন খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের খামারগুলো অবস্থিত। অধিকাংশ ঘের দেশীয় পদ্ধতিতে করা হয়। ঘের চাষের মোট আয়তন ১৭৫২৭৪ হেক্টরের মত। গলদার ফলন ৫০০-৬০০ কেজি এবং বাগদার ফলন ২৫০-৩০০ কেজি হেক্টরে। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- লেক বা হ্রদ: কৃত্রিম বা স্বাভাবিক বৃহৎ আকারের বদ্ধ জলরাশিকে লেক বা হ্রদ বলে। যেমন ফয়েজ লেক, কাপ্তাই লেক।
ii) উন্মুক্ত জলাশয়
বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয়ের মোট আয়তন ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- নদনদী: বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, আত্রাই, বুড়িগঙ্গা ইত্যাদি অনেক ছোট বড় নদী বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মোহনাসহ এর মোট আয়তন ৮৫৩৮৬৩ হেক্টর। এই উন্মুক্ত জলাশয় থেকে প্রতি বছর ২.৫-৩.০ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ ধরা হয়। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- প্লাবন ভূমি: বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি এসে নদীর উভয় কূল প্লাবিত করে এবং খাল বিল ভরে যায়। এ অবস্থা প্রায় ৪/৫ মাস থাকে। এ প্লাবিত ভূমির আয়তন ২৭০২৩০৪ হেক্টর। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
- হাওড় ও বিল: হাওড় ও বিল প্রতিবেশ মোটামুটি একই ধরনের। হাওড় আয়তনে বিলের চেয়ে বড় হয়। হাওড় ও বিলে মাছ ও বোরো ধান চাষ করা হয়। বাংলাদেশে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় হাওড়গুলোর অবস্থান কিন্তু বিল অনেক জেলাতেই রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওড় সিলেটের হাকালুকি হাওড় এবং সবচেয়ে বড় বিল নাটোরের চলনবিল।
- সামুদ্রিক জলাশয়: বাংলাদেশে সামুদ্রিক লোনা পানির মাছের প্রতিবেশ হল বঙ্গোপসাগর। লোনা পানির অনেক প্রজাতির মাছ এখানে পাওয়া যায়। এ জলরাশির আয়তন ১৬৬০০ বর্গকিলোমিটার। (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে গবাদিপশু, পোল্ট্রি ও মৎস্যের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পারলাম।
যেসব পশু গৃহে পালন করা হয় তাদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। গবাদি পশুর মাংস, দুধ খাদ্য ও আমিষের উৎস হিসেবে এবং গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পোল্ট্রি শিল্পের ভূমিকা ব্যপক। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গৃহপালিত পাখি ও পোল্ট্রি পালন করা হয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা অপরিহার্য। মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। বাংলাদেশ মৎস্য প্রতিবেশ ও মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুলে এবং মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ৪র্থ স্থান দখল করেছে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]