কৃষি তথ্য ও সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, এনজিও এবং বিভিন্ন কৃষি উপকরন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এছাড়াও কৃষি তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির উৎস হিসেবে অভিজ্ঞ কৃষক/কৃষানী, কৃষক সভা, উঠোন বৈঠক এবং কৃষক বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জাতীয় জীবনে সামাজিক পরিবর্তন ও সর্ববিধ উন্নতির মূলে কৃষি উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমাদের কৃষির সার্বিক সমস্যা সমাধান করে সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এখানে বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্রসমূহ, সামাজিক বনায়ন, কৃষি তথ্য সেবা প্রাপ্তিতে কৃষক, বিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, ই-কৃষি ইন্টারনেট, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও কৃষি সম্প্রসারণ, এনজিও ও কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি-
কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি গবেষণা, কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণীবিভাগ, কৃষি তথ্য সেবা প্রাপ্তিতে বিভিন্ন কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিস কি, কৃষি সম্প্রসারণ কি, কৃষি সম্প্রসারনের উদ্দেশ্য, কৃষি সম্প্রসারণের প্রতিষ্ঠানসমূহের নাম ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্পর্কে জানতে পারবেন।
কৃষি তথ্য ও সেবায় কৃষক বিদ্যালয় এর ভূমিকা, কৃষি তথ্য ও সেবায় অভিজ্ঞ কৃষকের ভূমিকা, কৃষকসভা ও উঠোন বৈঠক সম্পর্কে, কৃষি তথ্য ও সেবায় ইন্টারনেটের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
(১) বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করা যায় তাদের কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে। কৃষি উন্নয়নে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে।
ক) কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণীবিভাগ
i) স্তরভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
স্তরভিত্তিক কৃষি শিক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-
- মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ii) সনদ প্রদানভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
সনদ প্রদানের উপর ভিত্তি করে কৃষি প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- সার্টিফিকেট/ডিপ্লোমা সনদ প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
- স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
খ) কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচিত
নিচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচিতি দেয়া হলো-
i) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষি শিক্ষা একটি বিষয় হিসাবে পাঠদান করা হয়। আমাদের দেশের সকল মাধ্যমিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কৃষি শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে কৃষি শিক্ষা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কৃষি বিষয়ে পৃথকভাবে সনদ দেয়া হয় না।
ii) উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষি শিক্ষা ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠদান করা হয়। কৃষি শিক্ষা বিষয়টি সকল বিভাগের অর্থাৎ মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শাখার ছাত্র-ছাত্রীরা ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে পড়তে পারে। বাংলাদেশের সকল উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কলেজসমূহ এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানেও কৃষি বিষয়ে আলাদাভাবে সনদ দেয়া হয় না।
iii) সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পাঠদান শেষে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা প্রদান করে। এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একাডেমিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানে সরকারিভাগে ১৬টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ২টি ভেটেনারী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও ২টি লাইভস্টক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিতে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা প্রদান করে থাকে। বর্তমানে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এ ৪ বছর মেয়াদী কৃষি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে। বেসরকারী পর্যায়ে ১০০টির ও বেশী কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু আছে।
iv) স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করে তাকে স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে। যেমন শেখ ফজিলাতুনন্নেছা ফিসারিজ কলেজ জামালপুর।
v) স্নাতকোত্তর ও তদুর্ধ ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষিতে স্নাতক/স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ ডিগ্রি প্রদান করে তাকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বলে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি.এস.সি, এম. এস. এবং পি. এইচ.ডি. ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। যেমন-বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
গ) বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের তালিকা
i) সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান
সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
১. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | শেরে বাংলা নগর, ঢাকা |
২. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | শিমুলতলী, গাজীপুর |
৩. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | ফরিদপুর |
৪. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | শেরপুর |
৫. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | গাইবান্ধা |
৬. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | তাজহাট, রংপুর |
৭. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | ঈশ্বরদী, পাবনা |
৮. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | দৌলতপুর, খুলনা |
৯. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | রহমতপুর, বরিশাল |
১০. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | খাদিমনগর, সিলেট |
১১. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী |
১২. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | হাটহাজারী, চট্টগ্রাম |
১৩. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | ঝিনাইদহ |
১৪. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ |
১৫. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | হোমনা, কুমিল্লা |
১৬. কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | রাঙ্গামাটি |
সরকারি লাইভস্টোক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
লাইভস্টোক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | গাইবান্ধা |
লাইভস্টোক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | সিলেট |
সরকারি ভেটেরিনারী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
ভেটেরিনারী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | ময়মনসিংহ |
ভেটেরিনারী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট | আলমডাঙ্গা, কুষ্টিয়া |
ii) স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (কলেজ)
সরকারি স্নাতক ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
১. শেখ ফজিলাতুন্নেছা ফিসারিজ কলেজ | জামালপুর |
iii) স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয়)
কৃষিতে স্নাতকোত্তর ও তদূর্ধ ডিগ্রি প্রদানকারী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
১. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ময়মনসিংহ |
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | গাজীপুর |
৩. হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | দিনাজপুর |
৪. শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ঢাকা |
৫. পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | পটুয়াখালী |
৬. চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও এনিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় | চট্টগ্রাম |
৭. সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | সিলেট |
iv) কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান
উপরোল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোতে কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদান পূর্বক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। নিচে এরকম প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়া হলো-
নাম | অবস্থান |
১. বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় | গাজীপুর |
২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | ঢাকা |
৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় | রাজশাহী |
৪. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় | চট্টগ্রাম |
৫. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় | খুলনা |
ঘ) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) পরিচিতি
বাংলাদেশে কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ও প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৩ সালের ১৮ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা কমিশন, খাদ্য ও কৃষি কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ঘোষিত হয় “পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ”। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ১৯৬১ শিক্ষা বর্ষে স্থাপিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ বিশ্ববিদ্যালয় নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম তীরে এক মনোরম পরিবেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান।
মূলদায়িত্ব: স্নাতক, মাস্টার্স ও পি.এইচ.ডি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষকদের মাঝে সু-সংযোগ স্থাপন করা। অন্যান্য কাজ কৃষি উন্নয়নে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া।
গবেষণা: এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার গবেষণা, ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান বাউরেস (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম) এর মাধ্যম পরিচালিত হয়।
নিরলস গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গত ৪০ বছরে যেসব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
- উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত: বাউ ৬৩, বাউ ১৬;
- সয়াবীনের জাত সোহাগ, জি-২;
- সরিষার জাত সম্পদ, সম্বল;
- জীবানু সার;
- কলা উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি
- সয়েল টেস্টিং কিট;
- ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি;
- কৃত্রিম পশু প্রজনন প্রযুক্তি;
- সার ছিটানো যন্ত্র
- গরু মোটাতাজাকরণ প্রযুক্তি
- ভাসমান খাচায় মাছ চাষ প্রযুক্তি
- কুলের জাত: বাউকুল-১; বাউকুল-২; বাউকুল-৩; ইত্যাদি।
ঙ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ব শে মু র কৃ বি) পরিচিতি
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের আর্থ সামাজি উন্নয়ন মূলতঃ কৃষি উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। কৃষিখাতে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জনের জন্য উচ্চতর কৃষিজ্ঞান ও সঠিক প্রযুক্তি দরকার। এই বাস্তবকে সামনে রেখে ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গাজীপুর জেলার সালনা নামক স্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলী: মুলকাজ স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। অন্যান্য কাজের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি তথ্য কৃষক ও ব্যবহারির কাছে হস্তান্তর করা।
(২) বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
কৃষি শিক্ষাকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করে তুলতে গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম।
অব্যাহত গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
- বারমাসী সাদা ও বারমাসী বেগুনি নামে শিমের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে, যা সারা বছর চাষ করা যায়।
- মটরশুটির তিনটি অত্যাধুনিক জাত যা কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
- ইপসা নামে পেয়ারার একটি বারমাসী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
- ঢেড়শের ভাইরাস প্রতিরোধী জাত, পেঁয়াজের দুটি উচ্চফলনশীল জাত, চীনা বাধাকপির জাত, বারমাসী টমেটোর জাত, স্বল্পঞ্চমেয়াদী উচ্চ ফলনশীল মুগডালের জাত ইত্যাদি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
- পেঁপের পুরুষ ও স্ত্রী উভয় গাছেই ফুল ও ফল হয় এমন জাত (গাইনোডাইয়োসিয়াস জাত) মাটি ও গাছের অভ্যন্তর হতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ ও অণুজীব সার হিসেবে এর ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা।
কৃষি গবেষণা ও কৃষি তথ্য সেবায় বিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অভিজ্ঞ কৃষিবিদ ও মানসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ক) কৃষি গবেষণা কি?
গবেষণা কি/কাকে বলে: গবেষণা হচ্ছে নতুন জ্ঞান উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো। গবেষণা শব্দটির মুল ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে “Research” সাধারণভাবে গবেষণা বলতে অজানা কোন কিছুকে অনুসন্ধান করে জানা বা স্পষ্ট ধারণা লাভ করাকে গবেষণা বলে।
কৃষি গবেষণা বলতে কি বুঝায়: কৃষি গবেষণা বলতে বুঝায় কৃষি বিষয়ক কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়কে বৈজ্ঞানিক ও ক্রমানুযায়ী অনুসন্ধান করে তথ্য উদঘাটন করা।
কৃষি গবেষণা কাকে বলে: কৃষি সংক্রান্ত নানা বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করাকে কৃষি গবেষণা বলে।
খ) কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির সার্বিক উন্নয়নকে নিমিত্তে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কৃষি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষিগবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে-
নাম | অবস্থান |
১. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট | গাজীপুর |
২. বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট | গাজীপুর |
৩. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল | ঢাকা |
৪. বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট | ময়মনসিংহ |
৫. বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট | ঈশ্বরদী |
৬. বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট | ঢাকা |
৭. বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট | সিলেট |
৮. বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট | চট্টগ্রাম |
৯. বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট | সাভার |
১০. পশু চিকিৎসা গবেষণা ইনস্টিটিউট | ঢাকা |
১১. বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট | ময়মনসিংহ |
১২. বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউট | রাজশাহী |
১৩. মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট | ঢাকা |
গ) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৭৬ সালের ৪ঠা আগস্ট তারিখে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর প্রধান কার্যাবলী গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে অবস্থিত।
প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী ও উদ্দেশ্য নিচে দেওয়া হলো-
- ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবিত জাতসমূহ চাষাবাদের জন্য অনুমোদনের ব্যবস্থা করা।
- ফসল উৎপাদনের জন্য আধুনিক কলাকৌশল উদ্ভাবন করা।
- চাহিদা অনুযায়ী দেশে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- কৃষি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কর্মশালা ইত্যাদির আয়োজন করা।
- উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রদর্শনের জন্য মাঠ দিবসের আয়োজন করা।
- বিভিন্ন ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে ফসল রক্ষার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
- ফসলের উপর বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্বন্ধে পুস্তিকা, পোস্টার লিফলেট তৈরি করা এবং প্রচার করা।
ঘ) বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচিতি
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিউট ১৯৭০ সালের ১লা অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে অবস্থিত।
এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী নিচে দেওয়া হলো-
- ধানের নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা।
- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে ধান ফসলকে রক্ষার কৌশল সহনশীল জাত উদ্ভাবন করা।
- বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে ধান ফসলকে রক্ষা করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
- আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা এবং জাত ও কলাকৌশলের তথ্য বিনিময় করা।
- ধান চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত পুস্তিকা, বই প্রকাশ, পোষ্টার লিফলেট তৈরি করা ও কৃষকের মাঝে বিতরণ করা।
ঙ) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল পরিচিতি
১৯৭৩ সালের ৫ই এপ্রিল ঢাকার ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় কৃষি গবেষণাকে জোরদার করা এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কর্মসূচী প্রণয়ন ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করে থাকে।
নিচে এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী দেওয়া হলো-
- কৃষিক্ষেত্রে বিদেশী সহায়তার ব্যবহার সম্পর্কে ও গবেষণা পরিচালনার জন্য সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা।
- নতুন গবেষণা ইনস্টিটিউট, গবেষণা কেন্দ্র, তথ্য কেন্দ্র, জার্ম প্লাজম সেন্টার, যাদুঘর, হারবেরিয়াম, গ্রন্থাগার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা।
- এনএ আর এস ভুক্ত ইনস্টিটিউটসমূহের গৃহীত ও সম্পাদিত কার্যক্রম একট বিশেষজ্ঞ প্যানেল দ্বারা মূল্যায়ন করা।
- কৃষি বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন সেমিনার সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা।
চ) বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচিতি
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং স্বায়ত্বশাসিত।
নিচে এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী দেওয়া হলো-
- পরমাণু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নতমানের অধিক ফলনশীল ধান, পাট, ডাল, তেলবীজ, সবজি জাতীয় শস্যের জাত উদ্ভাবন করা।
- উদ্ভাবিত জাতসমূহের কৃষি তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা ও মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো।
- বিভিন্ন ফসলের জন্য সার সুপারিশমালা প্রণয়ন, বোরাগ ও পোকামাকড় দমনের পদ্ধতি সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করা।
- মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যাবলী নিরূপণ, আর্থ-সামাজিক গবেষণা ও উন্নত প্রযুক্তি কৃষকের নিকট হস্তান্তর করা।
- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা ও একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করা।
ছ) কৃষি গবেষণার গুরুত্ব
প্রকৃতিকে গভীরভাবে বুঝবার ও এর রহস্যকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টাকেও সহজ ভাষায় বিজ্ঞান বলা যেতে পারে। এ প্রচেষ্টাকে ব্যাপক ও সুষ্ঠভাবে রূপ দিতে গিয়েই গবেষণার প্রচলন হয়েছে।
গবেষণার ব্যাপকতা বর্তমান পৃথিবীর একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। গবেষণার পরিধি শুধু বস্তু জগতেই সীমাবদ্ধ নেই, জীবজগত, ভাবজগত এবং সামাজিক জীবনও এর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে। মূলতঃ এসব গবেষণালব্ধ ব্যপ্তি ও সমষ্টি জীবনে রূপায়িত করেই বিভিন্ন দেশ উন্নতি করে চলছে। তাই যে দেশ গবেষণায় যত বেশি অগ্রসর সে দেশ ততই উন্নত।
অপরদিকে অনুন্নত দেশের একটাই লক্ষণ হল গবেণার প্রতি অবহেলা। উদারহরণস্বরূপ জাপান স্বাধীনতা লাভের পর সে দেশটিতে তখন দারুন খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। সে দেশের মানুষ তখন গাছের লতা পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছিল। পরবর্তীতে তারা গবেষণা শুরু করল কিভাবে গাছের লতাপাতা ও ক্ষুদ্র অনুজীবকে কাজে লাগিয়ে মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানো যায়। তারা কৃষি গবেষণার মাধ্যমে আজ বিশ্বের বুকে উন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশে ক্রমেই জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু আবাদী জমির পরিমাণ দারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু রাসায়নিক পদার্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারে ইতোমধ্যে মৃত্তিকা সম্পদ ও পরিবেশে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগজনিত ফসলহানির ঝুঁকির। তদুপরি এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে আমাদের ফসলের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। তাই উন্নত দেশগুলোর সাথে যেতে হলে আমাদের কৃষি গবেষণার প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
(৩) অন্যন্য কৃষি তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির উৎস
নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা কৃষি উন্নয়নের মুল চাবিকাঠি। কিন্তু শুধু কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেই হবে না, পাশাপাশি এটি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে যাতে কৃষক এর সুফল পেতে পারে।
কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন থেকে কৃষকের কাছে হস্তান্তর পর্যন্ত দ্রুত প্রবাহের ব্যবস্থা, অবাধ ও সময়োপযোগী হতে হবে। তথ্য প্রবাহ সঠিকভাবে তথ্য ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতে হবে যাতে এটি তথ্য ব্যবহারকারীর বোধগম্য হয় এবং প্রযুক্তির সুফল যথাযথভাবে মানব কল্যাণে কাজে লাগে।
কৃষি তথ্য ও সেবায় বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। দেশের সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নতুন নতুন তথ্য সেবা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি বেশ এগিয়ে গেছে এবং কৃষি তথ্য প্রবাহে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলছে।
ক) কৃষি তথ্য সার্ভিস
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)/Agricultural Information Service (AIS) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ সনে কৃষি তথ্য সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ১৯৮০ সনে কৃষি তথ্য সংস্থাকে কৃষি তথ্য সার্ভিস নামকরণ করা হয়। সংস্থাটি জন্মলগ্ন থেকে নিরলসভাবে গণমাধ্যমের সাহায্যে কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি তৃণমুল পর্যন্ত দ্রুত বিস্তার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের সদর দপ্তর খামারবাড়ি, ফামগেট ঢাকায় অবস্থিত। মাঠ পর্যায়ে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশালসহ মোট এগারটি আঞ্চলিক কার্যালয় ও কক্সবাজারে দুটি লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে। (তথ্যসূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস)
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আধুনিক লাগসই কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি সহজ সরল ও সাবলীলভাবে অভীষ্ট দলের কাছে বোধগম্য আকারে পোঁছানোর ব্যবস্থা করা কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান লক্ষ্য। (তথ্যসূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস)
খ) কৃষি সম্প্রসারণ
কৃষি সম্প্রসারণ একটি ফলিত কৃষি বিজ্ঞান। কৃষি জ্ঞান ও কৃষি গবেষণা থেকে এর জ্ঞান আহরিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ মূলতঃ নতুন জ্ঞানের বিস্তৃতি। এটি এক দিকে কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী সরবরাহ করে ও তাদের প্রয়োগ করতে সাহায্য করে। অন্য দিকে এটা কৃষকদের সমসস্যাবলী সংগ্রহ করে সমাধানের জন্য গবেষণাগারে প্রেরণ করে। এজন্য এটাকে দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া বলা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (১৯৮৫) কৃষি সম্প্রসারণের সংজ্ঞায় বলেছেন, কৃষি সম্পসারণ একটি প্রক্রিয়া বা সেবা যা শিক্ষা পদ্ধতি মাধ্যমে কৃষকদের খামার পদ্ধতি ও প্রয়োগ কৌশলের উন্নয়নসহ উৎপাদন ক্ষমতা ও আয় বৃদ্ধি ও সহায়তা করে এবং পরিশেষে পল্লী জনগণের জীবন মান উন্নয়নে সহায়তা দান করে। কৃষি সম্প্রসারণের লক্ষ্য হচ্ছে কৃষকদের উৎপাদন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা সমস্যার বিশ্লেষণে তাদেরকে সাহায্য করা, কি উপায়ে সমস্যার সমাধান করা যায় তা শিক্ষা দেয়া এবং কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা যাতে তারা দক্ষতার সাথে কৃষিকাজ করে তাদের আয় বাড়াতে পারে।
i) কৃষি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য
কৃষি সম্প্রসারণের এমন কিছু উদ্দেশ্য থাকে যাতে কৃষকের শিক্ষা দীক্ষা ও আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেয়ার পূর্ণ স্বীকৃতি থাকে। তবে বিশেষ করে সম্প্রসারণ শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য স্থির করে। এই শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে কৃষকদের জ্ঞানে, দক্ষতায়, মনোভাবে এবং কর্মে পরিবর্তন এনে দেয়া। কৃষি সম্প্রসারণের নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যাবলী গৃহীত হয়েছে।
- কৃষকদের কৃষি উৎপাদন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদেরকে গবেষণালব্ধ আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান দান করা।
- প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
- কৃষক পরিবারের সকল সদস্যের উপযুক্ত কৃষি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
- স্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তোলা।
- বিভিন্ন অধিদপ্তর হতে প্রাপ্য তথ্য কৃষকদের সরবরাহ করা এবং কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা গবেষণাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
ii) কৃষি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য
- কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণার ফলাফলসমূহ কৃষকদের নিকট পৌঁছে দেয়া।
- আধুনিক কৃষি কলাকৌশল ও উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণে কৃষকদের উৎসাহিত ও সাহায্য করা।
- কৃষকদের চাহিদা, সম্পদ ও সামর্থ অনুযায়ী সর্বোচ্চ উৎপাদন লাভে সহায়তা করা।
- কৃষি উপকরণসমুহের সুষ্ঠুভাবে এবং যথাসময়ে কৃষকদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রাখা।
- কৃষি অফিসারগণের চাকরীকালীন প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা করা।
- কৃষি সংক্রান্ত জরুরী বার্তা ও তথ্য সামগ্রী যেমন পোষ্টার, লিফলেট, পুস্তিকা যথাসময়ে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা।
- কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা।
- কৃষি সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
iii) কৃষি সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান
যে সকল প্রতিষ্ঠান কৃষির প্রযুক্তিসমূহ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে এবং কৃষকদের যথাযথভাবে প্রযুক্তিব্যবহারে সাহায্যে করে এবং কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যাবলী সমাধানের জন্য গবেষণাগারে প্রেরণ করে সেগুলোকে কৃষি সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান বলে।
কৃষি সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
- প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর
- মৎস্য অধিদপ্তর
- পাট অধিদপ্তর
- তুলা উন্নয়ন বোর্ড
- বন অধিদপ্তর
নিম্নে কয়েকটি প্রধান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচিতি দেয়া হলো-
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অধিদপ্তর। এ অধিদপ্তরের অধীনে ৯টি উইং রয়েছে। উইংসমূহ হচ্ছে- ১. প্রশাসন এবং পার্সোনেল উইং, ২. সরেজমিন উইং, ৩. খাদ্যশস্য উইং ৪. অর্থকরী ফসল উইং ৫. উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, ৬. প্রশিক্ষণ উইং, ৭. পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, ৮. পানি ব্যবস্থাপনা ও ৯. কৃষি প্রকৌশল উইং।
iv) কৃষি উন্নয়নে কৃষি সম্প্রসারণের প্রয়োজনীতা
কৃষি উন্নয়ন বলতে কৃষির পুরাতন ও অনুন্নত প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনক্ষম আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারকে বুঝায়।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উন্নত পদ্ধতি অবলম্বন করে হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু পালন করে অধিক ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদন সম্ভব। উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারে একক ফসলের পরিবর্তে বহুমুখী ফসল, নতুন ফসলের প্রবর্তন, নতুন খামার পদ্ধতি, সঠিক মাত্রায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, নতুন জাত এবং আধুনিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু, হাস-মুরগী ও মাছের চাষাবাদ ইত্যাদি কৃষি উন্নয়নের প্রথম ধাপ।
নিচে কৃষি উন্নয়নে কৃষি সম্প্রসারণের প্রয়োজনীতা বর্ণনা করা হলো-
- প্রযুক্তি শিক্ষায় কৃষি সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে সব প্রযুক্তি কৃষি গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ সেগুলো কৃষকদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকে। গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে জৈব পদার্থের ভূমিকা ও জৈব সারের ব্যবহারের ফলে কি পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, খাদ্য হিসেবে সারের প্রয়োজনীয়তা, কোন সময়ে কোন সার প্রয়োগ করতে হয় কোন ফসলে কোন সার কি মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়, কোন প্রকার খামার পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশি লাভজনক হবে, কোন জাতের কোন ফসল কোন সময়ে চাষ করতে হবে, কোন সময়ে কোন ফসলে পোকার আক্রমণ বেশি, কি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পোকার আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যাবে ইত্যাদি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কর্মীরা কৃষকদেরকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সম্প্রসারণের এই শিক্ষার ফলে কৃষকদের কৃষি জ্ঞান উন্নত হয় এবং আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে তারা আরও আগ্রহশীল হয়।
- কৃষি উপকরণের জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা: কৃষি উপকরণের ব্যবহার হচ্ছে কৃষি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম ধাপ। কিন্তু সেই উপকরণগুলোর প্রতি আগ্রহ বা জনপ্রিয়তা না থাকলে সেগুলো তারা ব্যবহার করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে না। তাই সম্প্রসারণের দায়িত্ব হচ্ছে কৃষি উপকরণগুলোর জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করা। এর ফলে বীজ, সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, সেচ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কৃষি উৎপাদনের উকরণগুলোর ব্যবহার কৃষকসমাজে দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃষি সম্প্রসারনের শিক্ষামূলক প্রচারের মাধ্যমে কৃষকদের দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে এবং উপকরণগুলোর জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়েছে।
- প্রযুক্তি বিস্তারে কৃষি সম্পসারণের প্রয়োজনীতা: কৃষি সম্প্রসারণ কৃষি প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়াসহ কৃষক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রযুক্তির পূর্ণ বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। সম্প্রসারণ কর্মীরা প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদেরকে এমনভাবে জ্ঞানদান করে যাতে তারা প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্যগুলো ভালোভাবে বিবেচনা করে ব্যবহারের বা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে কৃষি গবেষণা হতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো দ্রুত বিস্তার ঘটে চলেছে। আধুনিক ধানের জাত লাইন পদ্ধতিতে চাষ, প্রত্যেক ফসলে সুষম সার ব্যবহার ইত্যাদি প্রযুক্তির বিস্তার সম্প্রসারণের শিক্ষার ফলে ঘটে থাকে।
- স্থানীয় সম্পদ পূর্ণ ব্যবহারে কৃষি সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা: কৃষি সম্প্রসারণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের নিজের যে সম্পদ আছে বা উপকরণ আছে তারই সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়। কৃষকগণ নিজের সম্পদ ব্যবহার করে অনেক ভাবে লাভবান হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের গোবর সংরক্ষণ ও ব্যবহার, কম্পোষ্ট তৈরি ও ব্যবহার, নিজস্ব কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন সাধন, পশু সম্পদের উন্নয়ন, স্থানীয় পদ্ধতিতে পোকামাকড় দমন, জমির উর্বরতার জন্য জৈব সারের ব্যবহার ইত্যাদি স্থানীয় সম্পদ পূর্ণ ব্যবহারে শিক্ষা দিয়ে থাকে।
- স্থানীয় নেতৃত্বের উন্নয়নে কৃষি সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা: কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্বের উন্নয়ন ঘটে থাকে। স্থানীয় নেতারা যাতে কৃষি ও অন্যান্য সমস্যা কৃষি সম্পসারণের নজরে আনতে পারে এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
গ) বেসরকারী সংস্থা বা এনজিও (NGO)
এনজিও কাকে বলে: সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় কিন্তু সরকারের উন্নয়ন নীতিমালা অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও বলে। মূলতঃ গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক ও মহিলাদের নানামুখী কল্যান সাধন করাই এনজিও গুলোর উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে অনেক এনজিও কাজ করে এবং এরা কৃষকদের তথ্য ও সেবা প্রদান করে কৃষি উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখছে।
বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে কাজ করে এমন কিছু এনজিও হল টি এম এস এস (TMSS), ব্র্যাক (BRAC), আরডিআরএস (DRS প্রশিকা, গ্রামীণ ব্যাংক, কারিতাস, কেয়ার, ভোসড ইত্যাদি।
বাংলাদেশে এনজিওগুলো কৃষি বিষয়ক নিম্নোক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে-
- কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও কৃষি ঋণ সরবরাহ করে।
- কৃষকদের কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ৩। কৃষি সমস্যার সমাধান দেয়।
- উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ করে।
- উচ্চফলনশীল জাতের ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে।
- কৃষি বিষয়ক তথ্য সরবরাহ করে।
- সেচ কার্যক্রমে সহায়তা করে।
- বীজ ও চারা উৎপাদন করে কৃষকদের সরবরাহ করে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য আপদকালীন সময়ে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করে।
ঘ) অভিজ্ঞ কৃষক/কৃষাণী
কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে ৭০-৮০% লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ভাগের মত লোক শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। এ সকল কৃষক জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে কৃষি কাজে নিয়োজিত থাকেন। এ কারণে মাঠ ও উদ্যান ফসল, বনায়ন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন ইত্যাদি বিষয়ে কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। ফসল চাষের বিভিন্ন কলাকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে।
কাজেই ফসল চাষ থেকে শুরু করে মাছ চাষ, পোল্ট্রি পালন, গবাদি পশু পালন ইত্যাদি কৃষি বিষয়ক সমস্ত কাজের তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির উৎস হিসেবে আমাদের দেশের অভিজ্ঞ কৃষকেরা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারেন।
ঙ) কৃষক বিদ্যালয়
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত কৃষক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে কৃষকরা বিভিন্ন তথ্য সেবা পেয়ে থাকেন। এই সকল বিদ্যালয়ে কৃষকদের বিভিন্ন নতুন কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয় যেমন, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (আইসিএম) ও সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা (আইএফএম) ইত্যাদি। এ তথ্য সমৃদ্ধ জ্ঞান তারা কৃষি কাজে সরাসরি বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশের ৩৩৫ টি উপজেলায় কৃষক মাঠ স্কুল স্থাপন করেছে। সারা দেশে মোট ১১ হাজার ৪৭০ টি কৃষক মাঠ স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ২ হাজার ৫৯৭ জন কৃষক/কৃষাণীকে প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বিদ্যালয়গুলোতে ফসলের ব্যবস্থাপনা কলা-কৌশলের উপর কৃষকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য একদল
কৃষক-কৃষাণীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হাতে কলমে মৌসুমব্যাপী মাঠ ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। একটি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ৫০ জন কৃষক-কৃষাণীকে একটি মৌসুমের পুরো সময় ধরে ২০টি অধিবেশনের মাধ্যমে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রতিটি অধিবেশনের সময় ৩-৪ ঘন্টা। এর মধ্যে মহিলাদের জন্য ৪টি , পুরুষ ও মহিলাদের যৌথ ৫টি এবং কৃষকদের ১১টি অধিবেশন।
প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করে কৃষকরা একাকী বা দলীয়ভাবে পরীক্ষা প্লট ও প্রদর্শনী স্থাপন করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানের শিক্ষাদান পদ্ধতি হলোপারস্পরিক অংশগ্রহণমূলক করে শেখা, দেখে শেখা, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে শেখা ও আবিষ্কার প্রক্রিয়ায় শেখা। এতে বয়স্ক কৃষকরাও খুব ভালোভাবে শিখতে পারেন এবং নতুন কিছু আবিষ্কার বা শেখার আনন্দে প্রশিক্ষণের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। তাই কৃষক মাঠ স্কুলের প্রশিক্ষণ কৃষকদের জন্য প্রায়োগিক ও বাস্তবসম্মত। ভবিষ্যতে এই প্রশিক্ষিত কৃষকদের মাধ্যমেই অন্যান্য কৃষকেরা তথ্য ও সেবা পাবে।
চ) কৃষকসভা ও উঠোন বৈঠক
কৃষক সভা কাকে বলে: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি অফিস প্রায় প্রতি মাসে অথবা প্রয়োজন অনুসারে মাঝে মাঝে কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে যে সভা বা বৈঠক করে তাকে কৃষক সভা বা উঠোন বৈঠক বলে।
কৃষক সভা এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি হস্তান্তরে উদ্বুদ্ধ করা, কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধন দেওয়া। কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কৃষকদের সাথে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অথবা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাগণ মতবিনিময় করেন। এছাড়াও হঠাৎ কোন সমস্যা হলে যেমন ধান ক্ষেতে পোকার আক্রমণ হলে তাৎক্ষণিক ফসলের মাঠে কৃষক সভা করা হয়। মত বিনিময়ের ফলে জ্ঞান ও তথ্যে দুর্বল কৃষকের জ্ঞান বাড়ে এবং কাজে আগ্রহী হয়। এভাবে কৃষক সভা বা উঠোন বৈঠক কৃষির তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে।
ছ) ইন্টারনেট
ইন্টারনেট কি: ইন্টারনেট হল ইলেকট্রিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেটি অনেকগুলো কম্পিউটারকে একই নেটওয়ার্কের আওতায় সংযুক্ত করে এবং তথ্যের আদান প্রদান ঘটায়।
কৃষি তথ্য ও সেবা প্রাপ্তিতে ইন্টারনেটের ভূমিকা অনিস্বীকার্য। কৃষি তথ্যের বৃহৎ ভান্ডারে হচ্ছে ইন্টারনেট ওয়েবসাইট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক যেকোন তথ্য সমস্যার সমাধান অনায়াসে স্বল্প সময়ে পাওয়া যায়।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা-
- ভিডিও কনফারেন্সিং: ইন্টারনেট ব্যবহার করে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কৃষকদের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারেন এবং কৃষকদের সমস্যার সমাধান দিতে পারেন।
- ই-মেইল: কৃষি বিষয়ক যেকোন তথ্য ইমেইলের মাধ্যমে একজন আরেক জনের নিকট অতি দ্রুত পাঠাতে পারে।
- তথ্য সরবরাহ: ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান, তথ্য-উপাত্ত, গবেষণাপত্র সহ সর্ব প্রকার তথ্যও আদান প্রদান করা যায়।
- গবেষণা: কৃষিবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং নিজেদের গবেষণা প্রকাশ করার জন্য ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল।
- বাজার দর ও কেনাবেচা: বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার বিভিন্ন কৃষি পণ্যের বাজার দর সম্পর্কে হাল নাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনের কৃষি পণ্য ক্রয় বিক্রয়ও করা যায়। যাকে বর্তমানে ই-কমার্স বলা হয়।
জ) ই-কৃষি
ই-কৃষি বলতে কি বুঝায়: ই-কৃষি বলতে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে কৃষির বিভিন্ন সেবার আদান-প্রদানকে বোঝায়।
বর্তমানে প্রতিটি ক্ষেত্রে ই-সেবার প্রভাব লক্ষণীয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে ই-কৃষির বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে কৃষিতে ইলেকট্রনিক সার্ভিস বা ই-সেবার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সরকার আধুনিক মানসম্মত আইসিটি কেন্দ্র চালু করেছে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে (www.ais.gov.bd) কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমসাময়িক তথ্য সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আমাদের বাংলাদেশে কৃষি তথ্য সার্ভিসই প্রথম গ্রাম পর্যায়ে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করে কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সূত্রপাত করেছে। এ কেন্দ্রগুলোতে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার, মডেম সরবরাহ করা হয়েছে। ই-বুক তৈরির মাধ্যমে আরো সহজভাবে কৃষি তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। টেলিভিশনের মাধ্যমে অনলাইনে সরাসরি ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং তথ্য প্রাপ্তির জন্য ‘কিয়স্ক’ তৈরি করা হচ্ছে।
ঝ) টেলিভিশন ও বেতার
কৃষি তথ্য সার্ভিসের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ’ সপ্তাহে ৬ দিন সম্প্রচারিত হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় সংবাদের সাথে বিশেষায়িত সংবাদের অংশ হিসেবে কৃষি সংবাদ প্রচারের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। এক্ষেত্রে চ্যানেল আই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারাই প্রথম ১৯ জানুয়ারী ২০০৮ সাল থেকে কৃষি সংবাদ প্রচার শুরু করে। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৮ থেকে বিটিভির সংবাদে এবং ৬ এপ্রিল ২০০৮ থেকে বাংলাদেশ বেতারে কৃষি সংবাদ প্রচার হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য চ্যানেলগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে।
ঞ) মোবাইল ভিত্তিক কৃষি তথ্য সেবা
বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক মোবাইল ভিত্তিক কৃষি তথ্য সেবা দেয়ার জন্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও প্রাকটিক্যাল একশন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘কৃষি কল সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে। এই কল সেন্টার থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ সরাসরি যেকোন সমস্যার সমাধান ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিস, এটুআই প্রকল্প এবং বাংলালিংকের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে যেটি মোবাইল এসএমএস ভিত্তিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এছাড়াও উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকায় সন্নিবেশিত মৃত্তিকা উর্বরতাবিষয়ক তথ্য উপাত্ত জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল তথ্য রূপান্তর করা হয়েছে। এ তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাটলিস্টের সহযোগীতায় অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম নামক সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে। যা পরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সার্ভিস হিসেবে চালু করা হয়।
অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সার্ভিস ব্যবহারের ফলাফল-
- সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
- মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে এবং মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হবে।
- ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
- মটি ও পানি দুষণ কমে যাবে।
পরিশেষে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ই-কৃষির বিকল্প নেই। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে কৃষি তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির সুযোগ সুবিধা ব্যপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ সমস্ত তথ্য ও সেবাপ্রদানকারী উৎসের মধ্যে সামগ্রিক সহযোগিতা ও সমন্বয় শক্তিশালী করতে পারলে কৃষক তথ্য ও কৃষির উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোনার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অন্যন্য কৃষি তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির উৎস যেমন- তথ্য সার্ভিস, কৃষি সম্প্রসারণ, এনজিও, কৃষক বিদ্যালয়, ইন্টারনেট ও ই-কৃষি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম।
কৃষি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটগুলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক কৃষি বিজ্ঞানী তৈরি করছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নকে তরান্বিত করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম কৃষকদের কৃষি বিষয়ক শিক্ষা দেয় এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের প্রয়োজনীয় সকল কৃষি উপকরণ সরবরাহে মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন তরান্বিত করছে। এছাড়াও কৃষক তথা কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন এনজিও এর অবদান ও যথেষ্ট।
নতুন কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন কৃষি তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এছাড়া কৃষক বিদ্যালয়কৃষক সভা ও উঠোন বৈঠক এর মাধ্যমে কৃষকরা নবুতন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহার করেকৃষকরা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পায় এবং তাদের কৃষি পণ্য ক্রয় বিক্রয় করার সুযোগ পায়।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]