ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল বাতাবি লেবু বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ফসল। বাংলাদেশের সব এলাকাতেই এর চাষ হয় তবে সিলেটে বেশি হয়।
(১) বাতাবি লেবুর জাত
ক) বারি বাতাবি লেবু-১
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত বাতাবি লেবুর জার্মপ্লাজম মূল্যায়ন করে ‘বারি বাতাবি লেবু-১’ জাতটি ১৯৯৭ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এ জাতের পাতা বড় আকৃতির গাঢ় সবুজ।
- নিয়মিত ফল ধরে।
- ফলের আকৃতি প্রায় গোলাকার (টিএসএস ৯.২০%)।
- ফলের ওজন ৯০০-১,১০০ গ্রাম।
- ফলের আকার মাঝারী।
- ফলের কোষ সংখ্যা ১৩-১৪টি।
- ভক্ষণযোগ্য অংশ ৪৫%।
- খোসার পুরুত্ব ২.০-২.৫ সেমি।
- ফল সুস্বাদু ও সামান্য তিতা, বেশ রসালো, শাঁসের রং লালচে, মিষ্টতা মাঝারী।
- শাঁস বেশ নরম।
- পাকা ফলর রং হলুদ।
- বীজের রং বাদামী এবং আকৃতি চ্যাপ্টা।
- প্রতি গাছে ৪৫-৫৫টি ফল ধরে।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১৪-১৬ টন।
- দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
খ) বারি বাতাবি লেবু-২
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত বাতাবি লেবুর জার্মপ্লাজম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি উন্নত জাত ‘বারি বাতাবি লেবু-২’ ১৯৯৭ সালে অনুমোদন করা হয়।
- গাছের আকৃতি ছাতার মতো।
- পাতা গাঢ় সবুজ, ডানাযুক্ত বৃত্তাকার।
- টিএসএস ১১.৩৫%।
- মোট এসিড ১.০৫%।
- ফলের ওজন ৭৫০-৭৮০ গ্রাম।
- ফলের আকার ১১.০০ ⨉ ১২.৩০ সেমি।
- ফলের কোষ সংখ্যা ১৩-১৫টি, ভক্ষণযোগ্য অংশ ৪০% এবং খোসার পুরুত্ব ১.২-১.৪ সেমি।
- বীজের সংখ্যা ১১০-১২০টি।
- ফল সুস্বাদু, বেশ রসালো, শাঁসের রং লালচে এবং বেশ মিষ্টি।
- শাঁস নরম এবং পাকা ফলের রং হলুদ।
- বীজের রং বাদামী, আকৃতি চ্যাপ্টা।
- প্রতি গাছে ৪০-৫০টি ফল ধরে।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-১৪ টন।
- দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
গ) বারি বাতাবি লেবু-৩
অভ্যন্তরীণ জরিপের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নত জাত বারি ‘বাতাবি লেবু-৩’ ২০০৩ সালে অবমুক্ত করা হয়।
- গাছের আকার মাঝারী, পাতা গাঢ় সবুজ ও হৃদপিন্ডাকার ডানাযুক্ত।
- প্রতিবছর নিয়মিত ফল ধরে।
- ফল উপবৃত্তাকার ও মাঝারী ধরনের।
- ফলের ওজন ১,০০০-১,১৫০ গ্রাম।
- পাকা ফলের খোসা হলদে বর্ণের, পাতলা (১.২৫-১.৩০ সেমি পুরু) যা খুব সহজেই শাঁস থেকে ছাঁড়ানো যায়।
- প্রতি ফলে কোষের সংখ্যা ১৪-১৫টি।
- ফলের শাঁস অত্যন্ত রসালো, নরম, মিষ্টি, সম্পূর্ণ তিতাবিহীন, গোলাপী বর্ণের এবং খেতে সুস্বাদু।
- টিএসএস (ব্রিক্সমান) ৮.৬% ফলের ভক্ষণযোগ্য অংশ ৫৫-৬০%, গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১০০-১১০টি, প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ৭০-৭৫টি।
- বীজ হালকা বর্ণের ও চ্যাপ্টা আকৃতির।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন।
- দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
ঘ) বারি বাতাবি লেবু-৪
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতটি ‘বারি বাতাবি লেবু-৪’ নামে ২০০৪ সালে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন লাভ করে।
- গাছের আকৃতি ছাতার মতো।
- পাতা গাঢ় সবুজ, ডানাযুক্ত বৃত্তাকার।
- গাছে নিয়মিত ফল ধরে।
- ফলের আকৃতি গোলাকার, মাঝারী ধরনের।
- টিএসএস ১১.৬%।
- মোট এসিড ০.৬০%।
- ফলের ওজন ৮৫০-১,১০০ গ্রাম।
- ফলের কোষ সংখ্যা ১২-১৪টি।
- ফল সুস্বাদু, বেশ রসালো, শাঁসের রং সাদা এবং বেশ মিষ্টি।
- কোন তিতাভাব নেই।
- পাকা ফলের রং হলুদাভ।
- প্রতিটি গাছে ৪০-৫০টি ফল ধরে।
- এটা একটি নাবী জাত।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০ টন।
- দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
ঙ) বারি বাতাবি লেবু-৫
- নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছটির পাতা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় ও ঝোপালো।
- ফলের গোলাকার ও বড় (ফলের গড় ওজন ৮৭৫ গ্রাম)।
- ফল দেখতে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের এবং টিএসএস ৯.০৫%।
- ফল সাধারণত একক ভাবে ধরে।
- ফলের অভ্যন্তরে ১৩-১৪টি খন্ড বিদ্যমান এবং খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৬৬.২৬%।
- আট বছর বয়সী প্রতিটি গাছে গড় ফলের সংখ্যা ১৮টি এবং ফলন ১৬.০৪ কেজি এবং ১০.০৩ টন/হেক্টর/বছর।
চ) বারি বাতাবি লেবু-৬
‘বারি বাতাবি লেবু-৬’ নিয়মিত ফলদানকারী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের মধ্য থেকে বাছাই করে মূল্যায়নের মাধ্যমে বারি বাতাবি লেবু-৬ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং জাতটি বাংলদেশে চাষ করার জন্য ২০১৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- গাছ মাঝারী ও ছড়ানো স্বভাবের।
- এর পাতা বড় ও পাতার বোঁটা চওড়া পাখা সম্বলিত, পত্রফলকের অগ্রভাগ সূঁচালো ও গাঢ় সবুজ বর্ণের।
- ফুল দেখতে সাদা রঙের এবং এককভাবে ধারণ করে।
- ফল আহরণের সময় অক্টোবর থেকে নভেম্বর।
- ফল উপ-বৃত্তাকার, পাকা ফলের রং সবুজাভ হলুদ এবং ফলের গড় ওজন ১ কেজি।
- শাঁস আকর্ষণীয় লাল, খুব রসালো, নরম, সুস্বাদু ও সম্পুর্ণ তিতাবিহীন।
- ফলের কোষ খুব সহজে আলাদা করা যায়।
- খাদ্যোপযোগী অংশ ৫৭% ও টিএসএস ৮.৫%।
- বীজ সাধারণত লম্বাটে এবং বোটার দিকে সরু।
(২) বাতাবি লেবু চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি, জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি
সুনিষ্কাশিত গভীর, হালকা, দোআঁশ মাটি লেবু চাষের জন্য উত্তম। মধ্যম অম্লীয় মাটিতে বাতাবি লেবু ভাল জন্মে।
পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা সম্পন্ন উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি বাতাবি লেবু চাষের জন্য উত্তম। জমি নির্বাচনের পর জমি চাষ দিয়ে আগাছামুক্ত করে চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করা প্রয়োজন।
খ) কলম তৈরি ও নির্বাচন
পার্শ্বকলম ও গুটি কলমের মাধ্যমে বাতাবি লেবুর কলম তৈরি করা যায়। সাধারণত ৮-১০ মাস বয়সের বাতাবি লেবুর চারা বাডিং ও গ্রাফটিংয়ের জন্য আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রোপণের জন্য সোজা ও দ্রুত বৃদ্ধি সম্পন্ন কলম নির্বাচন করতে হবে।
গ) রোপণের সময়
মধ্য জ্যৈষ্ঠ-মধ্য আশ্বিন (জুন-সেপ্টেম্বর) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে অধিক বৃষ্টিপাতের সময় কলম রোপণ না করাই ভাল। সেচ সুবিধা থাকলে সারা বছরই বাতাবি লেবুর চারা/কলম রোপণ করা চলে।
ঘ) গর্ত তৈরি
কলম রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৬ ⨉ ৬ মিটার দূরত্বে ৬০ ⨉ ৬০ ⨉ ৫০ সেমি আকারের গর্ত করে কয়েকদিন উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে দিতে হয়।
কলম রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে গর্তপ্রতি ১৫-২০ কেজি পচা গোবর, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০-৩০০ গ্রাম এমওপি ও ২০০ গ্রাম জিপসাম সার গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রেখে দিতে হবে।
মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ) কলম রোপণ
গর্তে সার প্রয়োগের ১৫-২০ দিন পর গোড়ার মাটিসহ নির্ধারিত কলমটি গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে রোপণ করা হয়। রোপণের পর হালকা পানি সেচ, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ) গাছে সার প্রয়োগ
বয়সভেদে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ:
সার | গাছের বয়স ১-২ বছর | গাছের বয়স ৩-৪ বছর | গাছের বয়স ৫-১০ বছর | গাছের বয়স ১০ বছরের উর্ধ্বে |
গোবর (কেজি) | ৭-১০ | ১০-১৫ | ২০-২৫ | ২৫-৩০ |
ইউরিয়া (গ্রাম) | ১৭৫-২২৫ | ২৭০-৩০০ | ৫০০-৬০০ | ৬০০-৭০০ |
টিএসপি (গ্রাম) | ৮০-৯০ | ১৪০-১৭০ | ৪০০-৪৫০ | ৪৫০-৫০০ |
এমওপি (গ্রাম) | ১৪০-১৬০ | ৪০০-৫০০ | ৫০০-৫৫০ | ৬০০-৬৮০ |
জ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সার একেবারে গাছের গোড়ায় না দিয়ে যত দূর পর্যন্ত ডালপালা বিস্তার লাভ করে সে এলাকায় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হয়।
উল্লিখিত সার ৩ কিস্তিতে ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি), মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-জ্যৈষ্ঠ (মে) ও মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য-কার্তিক (অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
ঝ) পানি সেচ ও নিকাশ
ফুল আসা ও ফল ধরার সময় পানির অভাব হলে ফল ঝরে পড়া ও সূর্য পোড়া দাগ দেখা যায়। তাই শুষ্ক মৌসুমে ২১ দিন পর পর ২-৩টি সেচ দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সে জন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঞ) অঙ্গ ছাঁটাই
নতুন রোপণকৃত গাছে আদিজোড় হতে উৎপাদিত কুশি ভেঙ্গে দিতে হবে। গাছটির অবকাঠামো মজবুত করার লক্ষ্যে গোড়া থেকে ১ মিটার উঁচু পর্যন্ত কোন ডালপালা রাখা চলবে না। এক থেকে ১.৫ মিটার উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫টি শাখা রাখতে হবে যাতে গাছটির সুন্দর একটি কাঠামো তৈরি হয়।
প্রতি বছর ফল সংগ্রহের পর মরা, পোকান্ডমাকড় ও রোগাক্রান্ত ডাল ছাঁটাই করতে হয়। ডাল ছাঁটাইয়ের পর কর্তিত স্থানে অবশ্যই বর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে।
ট) ফল সংগ্রহ
ফল কিছুটা হলদে বর্ণ ধারণ করলে মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-কার্তিক (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর) ফল সংগ্রহ করা যায়। বাতাবি লেবু পাকার পরও দীর্ঘ দিন গাছে সংরক্ষণ (Tree storage) করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]