ব্রোকলি Brassicaceae পরিবরের একটি সুস্বাদু সবজি। এটি উদ্ভিদতাত্বিক দিক থেকে ফুলকপির কাছাকাছি ও বর্ষজীবি ফসল।
পুষ্পমঞ্জুরীর বর্ণ মখমলীয় সবুজ এবং প্রাথমিক অবস্থায় বৌটা মোটা ও মাংসল থাকে এবং এর শাখামন্ত্ররীও ভক্ষণযোগ্য যা মাসাধিক কাল ধরে সংগ্রহ করা যায়।
এটি কপি গোত্রের অন্যান্য সবজি থেকে পুষ্টিকরও বটে।
- সবজিটি ভিটামিন ’এ’, ভিটামিন ’সি’ ও ভিটামিন ’ই’ এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ।
- এটা খেলে দেহে যকৃতের ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সার বাসা বাধতে পারে না।
- এটা খেলে মানব দেহের হাড় মজবুত হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর হয়, রক্তে কোলেস্টেরোলের পরিমান কমে যায় এবং উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে।
- ব্রোকলি চাষে ফসল রোপণ থেকে বীজ সংগ্রহ পর্যন্ত প্রায় ১৩৫-১৪০ দিন সময় লাগে।
(১) ব্রোকলির জাত পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
ক) বারি ব্রোকলি-১
- উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গড়ে প্রতিটি বিক্রয়োপযোগী পুষ্পমঞ্জুরীর ওজন ৪৫০ গ্রাম, ব্যাস ১২.৫০ সেমি ও লম্বায় ১৩.৯৩ সেমি।
- প্রতি হেন্টরে গড় ফলন প্রায় ১২ টন।
- গাছ উর্দমুখী, পাতা পুস্পষ্ট খাজ বিশিষ্ট ও মখমল সবুজ বর্ণের।
- চারা রোপণের ৫৩-৫৫ দিনের মাথায় পুম্পমঞ্জুরী বেড় হওয়া শুরু হয় যা ১৫ দিনের মাথায় খাবার উপযোগী হয়।
- বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মুক্ত পরাগায়ণের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন সম্ভব (প্রতি হেন্টরে প্রায় ৫৫০-৬০০ কেজি)।
- ব্রোকলির পুষ্পমঞ্জুরী সংগহের পর কর্তিত অংশের নীচ থেকে ৪-৫টি শাখামঞ্জুরী বের হয়।
- শাখামঞ্জুরী থেকে উৎপন্ন বীজ পুষ্ট এবং মানে ও গুণে উন্নতর হয়।
(২) ব্রোকলি চাষ পদ্ধতি ধারাবাহিক বর্ণনা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- ব্রোকলির পরিবেশিক উপযোগিতার সীমা ফুলকপির চেয়ে একটু আলাদা। ব্রোকলির গাছ ১৫ -২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভালো জন্মে।
- সাধারণত মাঝ সেপ্টেম্বর থেকে মাঝ অক্টোবর এর বীজ বপনের সময় যা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে ফলন দেয়।
- মাঝারী থেকে উচ্চমানের বেলে দোআশ মাটি বোকলি চাষের জন্য সর্বোত্তম। যে কোন স্থানে সব ধরনের মাটিতেই এর চাষ করা সম্ভব হলেও দীড়ানো পানিতে এরা বেঁচে থাকতে পারে না।
- বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টথামের হিল ভ্যালিতে এর সফল চাষাবাদ সম্ভব।
খ) উৎপাদন মৌসুম
এটি শীতকালীন ফসল।
গ) বীজের হার ও চারা উৎপাদন
- চারা তৈরির জন্য ৩ ও ১ মিটার আকারের বীজতলা তৈরি করতে হবে।
- প্রতি হেক্টর জমিতে ব্রোকলি চাষের জন্য ৩০০-৩৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন।
- ব্রোকলি চাষের জন্য ৩০ দিন বয়সের চারা লাগাতে হয়।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরতু ৪৫ সেমি হবে।
ঘ) বপনের সময়
ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-অক্টোবর) মাসে বীজ বপন করতে হয় এবং কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত ‘মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) জমিতে চারা রোপণ করা যায়।
ঙ) সারের পরিমাণ
ব্রোকলি চাষের জন্য মাঝারী উর্বর জমিতে হেন্টর প্রতি সার প্রয়োগের পরিমাণ ও
প্রয়োগ পদ্ধতি (কেজি/হেক্টর) নিম্নরূপ-
সারের নাম | মোট পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) | শেষ চাষের সময় | চারা রোপণের পূর্বে | চারা রোপণের ১৫ দিন পর | চারা রোপণের ৩৫ দিন পর |
গোবর | ১৫ হাজার কেজি | অর্ধেক ৭৫০০ কেজি | অর্ধেক ৭৫০০ কেজি | – | – |
ইউরিয়া | ২৫০ কেজি | – | – | ১২৫ কেজি | ১২৫ কেজি |
এমওপি | ২০০ কেজি | – | – | ১০০ কেজি | ১০০ কেজি |
টিএসপি | ১৫০ কেজি | – | ১৫০ কেজি | – | – |
পচা খৈল | প্রতি চারায় ৫০ গ্রাম | – | প্রতি পিটে দিতে হবে | – | – |
বরিক এসিড | ১২ কেজি | সম্পূর্ণ পরিমাণ | – | – | – |
চ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর, সমুদয় টিএসপি ও অর্ধেক এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- বাকি অর্ধেক গোবর চারা রোপণের ১ সপ্তাহ পূর্বে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হবে।
- এরপর চারা রোপণ করে সেচ দিতে হয়।
- ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- চারা লাগানোর ১৫ দিন পর ১ম কিস্তি এবং চারা রোপণের ৩০-৫০ দিন পর বাকি সার ২ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- মাটির অম্লক্ষারকত্ব (pH) ৫.৫ এর নিচে হলে হেষ্টরপ্রতি ২.০ টন চুন প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
ছ) ফলন
১২-১৫ টন/হেক্টর।
(৩) হরমোন প্রয়োগে বারি ব্রোকালি -১ এর বীজ উৎপাদন পক্রিয়া
ক) হরমোন প্রয়োগে বীজ উৎপাদনের কারণ ও সুবিধা
বারি ব্রোকলি-১ একটি মুক্ত পরাগায়িত জাত। উদ্ভিদ শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রনে হরমোনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। প্রতিকূল পরিবেশ হরমোনের কার্যকারিতা অধিক।
বাংলাদেশে মুক্ত পরাগায়নের মাধ্যমে বারি ব্রোকলি-১ সবজিটির বীজ উৎপাদন করা যায়। ব্রকলির বীজ সেট হওয়ার সময় তাপমাত্রা বেশী থাকে। তাই সিলিকুয়া/পড এ ভালভাবে বীজ সেট হয় না। বীজ সেট হলেও ভালভাবে পুষ্ট হয় না।
গাছে প্রথম ফুল ধরনের সময় জিবারেলিক এসিড (GA3) ৬০ পিপিএম হারে ৭ দিন পর পর দুইবার স্প্রে করলে সিলিকুয়া/পড এর সংখ্যা বেড়ে যায়, বীজ ভালভাবে সেট হয় ও পুষ্ট হয়। ১০০০ বীজের ওজন বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে হেক্টর প্রতি বীজের ফলন বৃদ্ধি পায়।
অর্থ্যাৎ, জিবারেলিক এসিড বীজ উৎপাদনের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে বলে বীজের ফলন বেড়ে যায়।
খ) হরমোন প্রয়োগে ব্রোকালি চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম
বিষয় | বিবরণ |
ফসল: | ব্রোকলি। |
জাত: | বারি ব্রোকলি-১। |
বীজ বপনের সময়: | সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ – অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। |
চারা রোপনের সময়: | অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ – নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। |
রোপন পদ্ধতি: | সাধারণত ২৫-৩০ দিনের চারা ৬০ সেমি x ৪০ সেমি দূরত্বে রোপন করতে হয়। |
প্রয়োগকৃত হরমোনের মাত্রা: | জিবারেলিক এসিড ৬০ পিপিএম। |
হরমোন প্রয়োগ পদ্ধতি: | সাধারণত চারা লাগানোর ৮৫-৯০ দিনের মধ্যে ব্রোকলি গাছে ফুল আসতে শুরু করে। প্রথম ফুল আসলে নির্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন প্রয়োগ করতে হয়। তারপর ৭ দিন পর পর আরো দু’বার ব্রোকলি গাছে হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। |
সারের মাত্রা (প্রতি হেক্টরে): | ১। ইউরিয়া ৩৫০ কেজি; ২। টিএসপি ১৫০ কেজি; ৩। এমওপি ২৫০ কেজি; ৪। জিঙ্ক সালফেট ১০ কেজি; ৫। বরিক এসিড ১২ কেজি; ও ৬। গোবর/কম্পোস্ট ১০ টন। |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি: | জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর/কম্পোস্ট, সমুদয় টিএসপি ও সমুদয় বরিক এসিড সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর/কম্পোস্ট চারা রোপণের ১ সপ্তাহ পূর্বে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হবে। এরপর চারা রোপণ করে চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর ১৫ দিন পর ১ম কিস্তি, ৩০-৩৫ দিন পর ২য় কিস্তি এবং ৮০-৮৫ দিন পর ৩য় কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর ৮০ দিন পর সারের অতিরিক্ত মাত্রা হিসেবে হ্ক্টেরপ্রতি ইউরিয়া ১১০ কেজি, এমওপি ১০০ কেজি এবং টিএসপি ৫০ কেজি সার প্রয়োগ করতে হবে। |
অন্যান্য অন্তবর্তীকলিীন পরিচর্যা: | আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। জমির প্রয়োজন অনুসারে সেচ প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর পর চারার পোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে বেশ কয়েকদিন পানি দিতে হবে। চারা মাটিতে সেট না হওয়া পর্যন্ত এভাবে পানি দিতে হবে। এরপর ৭ দিন পর পর প্লাবন সেচ দিতে হবে। পাতায় দাগ রোগ (Alternaria leaf spot) দেখা দিলে দেরী না করে ১৫ দিন পর পর ছত্রাকনাশক রোভরাল (২%) গাছে স্প্রে হরতে হবে। গাছে ফুল আসলে ১৫ দিন পর পর ছত্রাকনাশক রোভরাল (২%) এর স্প্রে চালিয়ে যেতে হবে। |
প্রযুক্তি ব্যবহারে সম্ভাব্য ফলন: | ৫৫০-৬০০ কেজি/হেক্টর। হরমোন প্রয়োগের ফলে হেক্টর প্রতি ২০-২৫% বেশী বীজের ফলন পাওয়া সম্ভব। |
ফসল সংগ্রহ: | চারা রোপণের ১৩৫-১৪০ দিন পর সিলিকুয়া/পড (৮০-৮৫%) বাদামী রং ধারণ করলে গাছ কেটে লাঠির কোমল আঘাতে বীজ গাছ থেকে আলাদা করতে হবে। পরে বীজ রৌদ্রে শুকায়ে সংরক্ষণ করতে হবে। |
হরমোন বাবদ খরচ (২০২৩ সালের হিসেবে): | প্রতি শতাংশে হরমোন বাবদ খরচ-১০০.০০ টাকা; স্প্রে করার জন্য প্রতি শতাংশে খরচ-১০০০.০০ টাকা। |
প্রতি শতাংশে নীট লাভ (২০২৩ সালের হিসেবে): | ৮,০০০ থেকে ১০,০০০.০০ টাকা। |
[সূত্র: বিএআরআই]