আধুনিক কৃষি সম্পৃক্ত প্রযুক্তির মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মধ্যে অন্যতম হলো ভূমিক্ষয় রোধ করা। এই পোষ্টটিতে আমরা ভূমিক্ষয়ের কারণ ও রোধের কার্যকরী উপায়সমূহ নিয়ে আলোচনা করব।
এই পাঠ শেষে আপনি- ভূমিক্ষয়ের কারণ গুলো কি কি, তা বৃঝতে পারবেন। ভূমিক্ষয় রোধের উপায়সমূহ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) ভূমিক্ষয়ের কারণ গুলো কি কি?
ভূমিক্ষয়ের কারণ গুলো কি কি: বিভিন্ন কারণে ভূমিক্ষয় ঘটতে পারে। যথা- ১। বৃষ্টিপাত, ২। ভূমির ঢাল, ৩। মাটির প্রকৃতি, ৪। শস্যের প্রকার, ৫। জমি চাষ পদ্ধতি, ৬। অত্যধিক পশুচারণ ও ৭। মানব কার্যাবলি।
ক) বৃষ্টিপাত
ভূমিক্ষয়ের প্রধান কারণ হলো বৃষ্টিপাত। এর তীব্রতা, সংখ্যা এবং পরিমাণ সরাসরি ভূমিক্ষয়ের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। বড় আকারে বৃষ্টির ফোঁটা মাটিকে সজোরে আঘাত করলে মাটির কণা পানির সাথে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। ঘন ঘন এবং অনেক সময় ধরে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলে মৃত্তিকার শোষণ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এমন অবস্থায় অতিরিক্ত পানির সাথে মাটির কণা মিশে জমির উপর দিয়ে নিচের দিকে ধাবিত হয়। প্রবাহমান পানির বেগ যত বেশি হবে মাটির ক্ষয়ও তত বেশি হবে।
খ) ভূমির ঢাল
ভূমির ঢাল মাটি ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। যে জমি যত বেশি ঢালু এবং ঢালের দৈর্ঘ্যও বেশি, সে জমির মাটি ক্ষয় তত বেশি হয় কারণ অধিকতর ঢালু জমিতে প্রবাহমান পানির বেগও অধিক হয়ে থাকে।
গ) মাটির প্রকৃতি
মাটির বুনট মাটি কণার দানাবন্ধন ও জৈব পদার্থের পরিমাণের উপর মাটির ক্ষয় অনেকাংশে নির্ভর করে, হাল্কা, দানাদার ও জৈব পদার্থযুক্ত মাটি রন্ধ্রবহুল বলে বৃষ্টির পানি সহজেই শোষিত হয়। এ ধরনের মাটির ক্ষয় কম হয়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ভারি এঁটেল জাতীয় মাটির রন্ধ্রতা কম থাকায়, এ মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা কম, এ ধরনের মাটি অল্প বৃষ্টিতেও অধিক ক্ষয় হয়।
ঘ) শস্যের প্রকার
শস্য নির্বাচন করে মাটির ক্ষয় কমানো সম্ভব। চীনাবাদাম, খেসারি, বরবটি, সয়াবিন প্রভৃতি অধিক পাতাযুক্ত ফসলের চাষাবাদ করে ভূমিক্ষয় কমানো সম্ভব। অন্যদিকে ইক্ষু, ভূট্টা, তুলা প্রভৃতি কম পাতাযুক্ত ফসলের চাষাবাদে ভূমিক্ষয় বেশি হয়।
ঙ) জমির চাষ পদ্ধতি
জমির প্রকৃতি না বুঝে জমি চাষ করলে উপরিস্তরের উর্বর মাটির ক্ষয়সাধন বেশি হয়ে থাকে। যেমন- অসমতল বিশেষ করে পাহাড়ি জমিতে ঢালের আড়াআড়ি চাষ না করে ঢাল বরাবরে চাষ করলে ভূমিক্ষয় বেশি হয়।
চ) অত্যাধিক পশুচারণ
অত্যাধিক বা অনিয়মিত পশুচারণ ভূমিক্ষয়ের আর একটি অন্যতম কারণ। অত্যধিক পশুচারণে পশুর পা দ্বারা ভূমির মাটি অধিকহারে অপসারিত হয়।
ছ) মানব কার্যাবলি
মানুষ ভূমিক্ষয় বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। সাধারন অবস্থায় বনজঙ্গল বা মাট-ঘাটে ভূমিক্ষয় ঘটে না। মানুষ অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে ফেললে জমি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়।
(২) ভূমিক্ষয় রোধের উপায়
আধুনিক কৃষি সম্পর্কিত কার্যক্রমে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান অংশ হলো ভূমিক্ষয় রোধ করা।
সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রকৃতি ও মানুষের খামখেয়ালীর হাত থেকে ভূমিক্ষয় রোধ করতে না পারলে গ্রামীণ মানুষের প্রধানতম সম্পদ কৃষি বিরাট হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য খুব শিঘ্রই ভূমিক্ষয় রোধ করতে কৃষক ও সরকারী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় কলা-কৌশল গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
নিচে ভূমিক্ষয় রোধের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ক) পানির প্রবাহ
বৃষ্টির পানির বেগ কমিয়ে ভূমিসংরক্ষণ সম্ভব। পানির বেগ বিভিন্নভাবে কমানো যেতে পারে। যেমন- জমিতে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় স্থানে আড়াআড়িভাবে ছোট আইল বা বাঁধ তৈরী করা। অসমতল জমি ভালভাবে চাষ করে বা মাটি কেটে সমতল করা। জমির ছোট ছোট নালাগুলো ভরাট করা। বড় নালায় বিভিন্ন আগাছা জমানো এবং শেষ প্রান্তে স্থানে স্থানে খুঁটি পুতে তার সাথে তারের জাল আটকে দেওয়া। নদীর উজানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা।
খ) পানি নিস্কাশনের সুব্যবস্থা
কৃষি জমিতে দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে সমস্ত মাঠের পানি একত্রে জমে ফেঁপে উঠে। ফলে পানির গতিবেগ বেড়ে গিয়ে ব্যাপকহারে ভূমিক্ষয় ঘটে। এমন অবস্থায় মাটির নিচের স্তরে টাইল নালা তৈরী করা যেতে পারে, ফলে পানি ধীর গতিতে সরে যাবে।
গ) পর্যাপ্ত জৈব সার প্রয়োগ
মাটিতে অধিক পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করলে মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে পানি সহজেই মাটির ছিদ্রপথে নিচের স্তরে প্রবেশ করতে পারে। এ ছাড়া জৈব পদার্থের হিউমাসের আঠালো বৈশিষ্ট্যের কারণে মাটির কণা পরস্পর শক্তভাবে আটকে থাকে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব পদার্থযুক্ত মাটি সহজেই বায়ু বা পানি দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে না।
ঘ) বনভূমি সৃষ্টি
যে সব অঞ্চলে বায়ু প্রবাহ দ্বারা ভূমিক্ষয় অধিক হয়, সেসব অঞ্চলে বায়ু প্রবাহের দিকে সারি সারি লম্বা ও ঝোপ জাতীয় গাছ লাগানো আবশ্যক। এ সব গাছ বায়ু প্রবাহের বেগ কমিয়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে।
ঙ) ধাপ চাষ
পাহাড়ি অঞ্চলে ঢালু জমিতে ভূমিক্ষয় অধিক দেয়া যায়। সেখানে শস্যের সারিগুলোকে একই উচ্চতায় রেখে সারিগুলোকে ঢালের বিপরীতে আড়াআড়িভাবে সাজানো হয়। ফলে পানির গতিপথে বাধার সৃষ্টি হয়। পানি সরাসরি গড়িয়ে পড়তে না পারাতে ভূমিক্ষয় রোধ পায়। পাহাড়ের গাত্র কেটে সিড়ির ন্যায় ধাপে ধাপে সাজানো হয় বলে একে ধাপ চাষ বলে। প্রতিটি ধাপ দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো।
চ) জমিকে খন্ড খন্ড করে চাষ
পাহাড়ি অঞ্চল বা অসমতল জমির সমস্ত ঢালে একইভাবে একটি ফসল চাষ না করে সুবিধামত জমি খন্ড খন্ড করে ঢাল আড়াআড়ি বিভিন্ন ফসল জন্মাবার পদ্ধতিকে খন্ড খন্ড প্লটে শস্য চাষ পদ্ধতি বলে। এক্ষেত্রে জমির বিভিন্ন খন্ডে ভিন্ন ভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়।
ছ) অনিয়মিত পশুচারণ রোধ
অত্যাধিক পশুচারণে মাটির উপরিভাগ উন্মুক্ত ও আলগা হয়ে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি করে। তাই অনিয়মিত পশুচারণ রোধ করে ভূমি সংরক্ষণ সম্ভব।
জ) বাঁধ বা আইল
জমির চারদিকে সুষ্ঠুভাবে বাঁধ বা আইল দিয়ে ভূমি সংরক্ষণ সম্ভব। কেননা এর দ্বারা বৃষ্টি বা সেচের পানি দ্বারা ভূমিক্ষয় রোধ পায়।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা- ভূমিক্ষয়ের কারণ গুলো কি কি এবং ভূমিক্ষয় রোধের উপায়সমূহ সম্পর্কে জানতে পারলাম।
বিভিন্ন কারণে ভূমিক্ষয় ঘটতে পারে। বৃষ্টিপাত ভূমির ঢাল, মাটির প্রকৃতি শস্যের প্রকার, চাষ পদ্ধতি, পশুচারণ ও মানুষ্য কার্যাবলী এর জন্য দায়ী। ভূমিক্ষয়ের ফলে যেহেতু পুষ্টি উপাদানের স্থানান্তর ঘটে, এ বিপর্যয় রোধের জন্য কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরী। পানি প্রবাহের গতিমুখ পরিবর্তন বা বেগ কমিয়ে ভূমিক্ষয় রোধ করা যায়। এছাড়া পানি নিস্কাশনের কার্যকরি ব্যবস্থা, বনভূমি সৃষ্টি, চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, বাঁধ বা আইল তৈরী করেও ক্ষেত্র বিশেষ ভূমিক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]