মটরশুঁটি একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু শীতকালীন সবজি। বাংলাদেশে এটি মূলত সবজি হিসাবে রান্নায় ব্যবহৃত হয়। শুকনো মটরশুটি ছিলে ভেঙে দ্বিখণ্ডিত করে মটর ডাল তৈরি করা হয়।
মটরশুঁটিতে শ্বেতসার রয়েছে। তবে এটি ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি ৬, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, তামা, আয়রন, দস্তা এবং লুটেইন সমৃদ্ধ।
বিশেষভাবে শহর অঞ্চলে এ সবজির জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(১) মটরশুঁটির জাত পরিচিতি
ক) বারি মটরশুঁটি-১
‘বারি মটরশুঁটি-১’ নামে এ জাতটি বাছাইকরণ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত হয় এবং ১৯৯৬ সালে অনুমোদন লাভ করে।
- জাতটি উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী।
- ফুলের রং সাদা এবং শুঁটি সবুজ।
- প্রতি শুঁটিতে ৪-৭টি সবুজ বীজ থাকে।
- শুঁটি বেশ মিষ্টি।
- প্রতিগাছে ২০-২৫টি শুঁটি ধরে।
- পরিপক্ক শুকনা বীজ কুঁচকানো ও রং বাদামী।
- বপনের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে সবুজ শুঁটি সংগ্রহ করা যায়।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন সবুজ শুঁটি উৎপন্ন হয়।
- জাতটি ডাউনি মিলডিউ ও পাউডারি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
খ) বারি মটরশুঁটি-২
এশীয় সবজি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের (AVRDC) সহযোগিতায় প্রাপ্ত এ জাতটি বাছাইকরণ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত হয় এবং ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়।
- শুঁটি হালকা সবুজ।
- আকৃতি কিছুটা চ্যাপ্টা।
- শুঁটির আকার ৮ × ২ সেমি।
- এ জাতের মটরশুঁটি বেশ নরম।
- অপরিপক্ক বীজসহ সবুজ শুঁটি শিমের মত ভক্ষণযোগ্য।
- শুঁটি সালাদ হিসেবে বা সিদ্ধ করে খাওয়া যায়।
- পরিপক্ক শুকনা বীজ গোলাকার ও সবুজ।
- এ জাত দ্রুত বর্ধনশীল।
- বীজ রোপণের ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে সবুজ শুঁটি সংগ্রহ করা যায়।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ১২-১৪ টন ফলন পাওয়া যায়।
- জাতটি পাউডারি মিলডিউ ও ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রাতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
গ) বারি মটরশুঁটি-৩
‘বারি মটরশুটি-৩’ জাতটি বাছাইকরণ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত হয় এবং ১৯৯৯ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এটি একটি আগাম জাত যা বপনের ৫৫-৬০ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা যায়।
- পডস্তলো হালকা সবুজ রঙের এবং পডে ৫-৭টি বীজ থাকে।
- বীজ ক্রিসপি এবং মিষ্টি স্বাদ যুক্ত।
- পরিপক্ক বীজ গোলাকার, হালকা সবুজ।
- ফলন ৮-৯ টন/হেক্টর।
(২) মটরশুঁটি চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
- মটর শীতল ও আংশিক আর্দ্র জলবায়ুর উপযোগী ফসল। ১০০-১৮০ সে. তাপমাত্রায় এটি সবচেয়ে ভাল জন্মে, ২০০ সে. এর উপরে তাপমাত্রা যতো বৃদ্ধি পায় ফলনও ততো কমে আসে এবং অপক্ক বীজের গুন ততো খারাপ হয়। ৩০০ সে. এর উপরে মটরের চাষ প্রায় অসম্ভব।
- মটরের জন্য দোঁ-আশ মাটি সবচেয়ে ভাল। এঁটেল মাটিতে প্রায়শই রোগে চারা গাছ নষ্ট হতে দেখা যায়। মাটি অবশ্যই সুনিষ্কাশিত হতে হবে। অম্লক্ষারত্ব (ঢ়ঐ) ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
খ) চাষের মৌসুম
- বাংলাদেশের মটর চাষের উপযোগী জলবায়ুর স্থায়িত্ব মাত্র চার মাস, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। নভেম্বর মাসই বীজ বোনার উৎকৃষ্ট সময়। অক্টোবরেও বীজ বোনা যেতে পারে, তবে প্রায়শই নাবি বৃষ্টিপাতের কারণে এ সময় জমি তৈরি সম্ভব হয় না।
- ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তাপমাত্র দ্রুত বৃদ্ধি পায়, এ সময় ফল না দিয়েই ফুল ঝরে পড়ে এবং গাছ পাউডারী মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়। তাই ফলন পেতে হলে মৌসুমের শুরুতেই আগাম জাত লাগানো উচিত।
গ) জমি তৈরি ও বীজ বপন
- মটরের গাছ চারা অবস্থায় খুব দূর্বল থাকে, এ জন্য ভাল ফলন পেতে হলে মিহি করে জমি প্রস্তুত করা উচিত।
- কোন কোন সময় মটরের বপনকৃত বীজ পাখি এবং ছত্রাক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য বীজ কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে লাগালে ফসলের নিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়।
- মটরে বীজ বপনের দূরত্ব গাছের উচ্চতা অনুযায়ী নির্ণয় করা হয়। খাটো জাত ৩০ সেমি. এবং উঁচু জাত ৫০ সেমি. ব্যবধানে সারি করে লাগানো যেতে পারে। সারিতে খাটো এনং উঁচু জাত যথাক্রমে ১৫ ও ২০ সে.মি.দূরত্বে বীজ বুনতে হবে।
- বপনের পদ্ধতি ও দূরত্ব অনুযায়ী প্রতি হেক্টরে ৭০-৮০ কেজি বীজ লাগে।
ঘ) সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)
সার | মোট সারের পরিমান | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | বীজ বপনের ২০ দিন পর উপরি প্রয়োগ | বীজ বপনের ৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ |
গোবর | ১০-১২ টন | সম্পূর্ণ | – | – |
ইউরিয়া | ১০০ কেজি | ৫০ কেজি | ২৫ কেজি | ২৫ কেজি |
টিএসপি | ১৫০ কেজি | সম্পূর্ণ | – | – |
এমওপি | ১০০ কেজি | ৫০ কেজি | ২৫ কেজি | ২৫ কেজি |
ঙ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালো ভাবে মিাশয়ে দিতে হবে।
- বাকিগোবর ও টিএসপি সার চারা লাগানোর ৭ দিন পূর্বে গর্তে মাটির সাথে ভালোভাবে মিাশয়ে দিতে হবে।
- বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার ২ কিস্তিতে বীজ বপনের ২০ ও ৪০ দিন পর সমভাবে গাছের গোড়ায় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
চ) পরিচর্যা
মটরের গাছ শুয়ে পড়লে ফলন কমে যায় এবং মাটির সংস্পর্শে পাতা ও শুঁটি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। ভাল ফলন পেতে হলে গাছ যাতে সোজা অবস্থায় থাকে সেজন্য বাউনী দেয়া প্রয়োজন। সারি বরাবর কিছু দূরে দূরে খুঁটি পুঁতে সুতলী দিয়ে সেগুলো যুক্ত করে কম খরচে বাউনী তৈরী করা যায়।
ছ) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- বীজ বোনার ৩৫-৪০ দিন পর আগাম জাতে এবং ৫০-৬০ দিন পর নাবি জাতের গাছে ফুল আসে। ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর অপক্ক বীজের জন্য শুঁটি সংগ্রহ করা যায়।
- পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু শক্ত হয়নি এমন পর্যায়ে সংগৃহীত বীজের গুন সবচেয়ে ভাল হয়।
- জাত ও ফসলের যত্ন অনুযায়ী প্রতি হেক্টওে ৩-৫ টন শুঁটি পাওয়া যায়। শুঁটির ওজনের ৩৫-৪০% বীজ।
(৩) মটরশুঁটির রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
ক) পাউডারী মিলডিউ
রোগের লক্ষন:
Erysiphe pisi নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ সৃষ্টি হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে পাতায় সাদা পাউডারের মত ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে এ দাগ কান্ড, ফুল ও ফলে বিস্তার লাভ করে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে সমস্ত গাছ আক্রান্ত হয় ও মারা যায়।
রোগের প্রতিকার:
- শুটি সংগ্রহ করার পর ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে।
- অত্যধিক সেচ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সালফার জাতীয় বালাইনাশক থিওভিট ৮০ ডব্লিউ পি অথবা কমুলাস ডি এফ জাতীয় ঔষুধ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ৫-৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।
খ) মরিচা রোগ
রোগের লক্ষন:
Uromyces fabae নামক ছত্রাকের আক্রমণে মরিচা রোগ হয়ে থাকে। পাতার নিচের দিকে, কান্ডে ও ফলের উপর মরিচা রঙের ছোট ছোট দাগ দেখা যায় এবং ফল পাকার পূর্বেই গাছ শুকিয়ে খড়ের মত রং ধারণ করে। উচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতা, কুয়াশাচ্ছন্ন বা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া এবং রাতের তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে এ রোগ সহজেই বিস্তার লাভ করে।
রোগের প্রতিকার:
- দেরীতে বীজ বপন না করে মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে।
- লিগুমিনোসি বহির্ভূত ফসলের সাথে মটরশুটির ২-৩ বছর শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে।
- অধিক নাইট্রোজেন সার দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- আক্রান্ত ফসলে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ইসি) অথবা টেবুকোনাজোল (ফলিকুর ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ টি স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়। স্প্রে করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন স্প্রে দ্রবন ভালোভাবে পাতার নীচের দিকে পড়ে।
গ) ডাউনি মিল্ডিউ
রোগের লক্ষন:
Pernospera pisi নামক ছত্রাকের আক্রমণে ডাউনি মিল্ডিউ রোগ হয়ে থাকে। ফুল আসার আগে পাতার নীচের পৃষ্ঠে ঝুলন্ত কিছুর বৃদ্ধি দেখা যায়।
- রোগের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে পাতার আক্রান্ত স্থান বাদামী ধুসর বর্ণের হয়, শুকিয়ে যায় এবং পুর্ণতাপ্রাপ্তি হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। যদি তরুণ বর্ধিষ্ণু কান্ড আক্রান্ত হয় তবে এটি কুচকিয়ে যায় এবং এর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে গাছ খর্বাকৃতির হয়।
- এ রোগ দ্বারা শুটি তখনই আক্রান্ত হয় যখন শুটিগুলো কচি এবং চ্যাপ্টা থাকে। ক্ষত স্থান ফ্যাকাশে সবুজ বর্ণের ও কমরবশী ডিম্বাকৃতির হয়, শুটির পার্শ্ব বরাবর স্পষ্ট দাগ দেখা যায় অথবা শুটিতে এ্যাবড়োথেবড়ো লম্বাটে লেশন তৈরি হয়। লেশনগুলো ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের হয়।
রোগের প্রতিকার:
- ফসলের মাঠ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- শুটি সংগ্রহ করার পর ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
- লিগুমিনোসি বহিভূত ফসলের সাথে মটরশুটির ২-৩ বছর শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে।
- অত্যধিক সেচ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- গ্রীষ্মে জমি গভীরভাবে চাষ দিতে হবে এবং আগাছাসমূহ দূর করতে হবে।।
- রিডোমিল গোল্ড অথবা হেক্সাকোনাজোল (ফলিকুর ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে ৭-১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ টি স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।
(৪) মটরশুঁটির পোকান্ডমাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
ক) জাব পোকা দমন ব্যবস্থা
- প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়।
- কীটনাশক ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা ডাইমেথোয়েট (যেমন টাফগর) এর ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে.মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
খ) ফলছিদ্রকারী পোকা দমন ব্যবস্থা
- পোকা সহ আক্রান্ত ফল হাতে বাছাই করে মেরে ফেলতে হবে।
- এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করতে হবে।
- আক্রমনের হার অত্যন্ত বেশী হলে সাইপারমেথ্রিন ৪০ ইসি জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মি. লি.মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করা।
[সূত্র: বিএআরআই]