সব ধরনের মাটিতেই মসুর চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত বেলে দোঁয়াশ মাটিতে এটি ভালো জন্মে।
মসুর সাধারণত উষ্ণ তাপমাত্রায় ভালো জন্মে। কিন্তু অঙ্কুরোদগমের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ১৫-২০° সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রা এর চেয়ে নামলে অঙ্কুরোদগম এবং ফলন কম হয়।
অন্য দিকে বীজের আকার ও এর অঙ্কুরোদগমের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন বড় আকারের বীজের চেয়ে ছোট আকারের বীজ অপেক্ষাকৃত দ্রুত অঙ্কুরিত হয়।
মসুর ডাল না হলে ভাত খেতে পারেন না, আমাদের বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। শুধু আমাদের বাংলাদেশেই নয়, গোটা পৃথিবীজুড়েই এটি খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় নানা রকমের পুষ্টিকর ও মুখরোচক খাবার। যেমন- ডালের চচ্চড়ি, ডালনা, নিরামিষ, পিঁয়াজু, ডালপুরি, ডালের স্যুপ, আম ডাল, পুঁই ডাল ইত্যাদি। মসুর ডাল প্রোটিনের আধার বলে একে মাংসের বিকল্প হিসেবেও ধরা হয়। মসুর ডাল শুধু সুস্বাদুই নয় এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ।
বাংলাদেশের দেশীয় জাতের প্রতি ১০০ গ্রাম মসুর ডালে মসুর ডালে প্রায় জলীয় অংশঃ ১২.৪ গ্রাম, খনিজ পদার্থঃ ২.১ গ্রাম, আঁশঃ ০.৭ গ্রাম, খাদ্য শক্তি ৩৪৩ কিলো ক্যালরি, আমিষঃ ২৫.১ গ্রাম, চর্বিঃ ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৯ মিলিগ্রাম, লোহঃ ৪.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৭০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি-২ঃ ০ ৪৯ মিলিগ্রাম, শর্করাঃ ৫৯.০ গ্রাম পুষ্টিগুণ বিদ্যমান থাকে।
(১) মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি
সুনিষ্কাশিত দোআঁশ/বেলে দোআঁশ/এঁটেল দোআঁশ মাটি মসুর চাষের জন্য উত্তম।
খ) জমি তৈরি
- একক ফসল হিসেবে আবাদের ক্ষেত্রে জমিতে সুনিষ্কাশিত ও উপর্যুক্ত রস থাকলে ৩-৪ টি গভীর চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
- মসুর আমন ধান কাটার পূর্বে রিলে ফসল হিসেবে আবাদ করা হলে চাষের প্রয়োজন হয়না।
গ) বপনের সময়
- কাঙ্খিত ফলনের জন্য সঠিক সময়ে বীজ বপন করা প্রয়োজন।
- অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত (কার্তিকের ২য় সপ্তাহ থেকে কার্তিকের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত) বীজ বপনের উত্তম সময়।
- গবেষণায় দেখা যায় বপনের সময় প্রতি ১০ দিন বাড়ার সাথে সাথে ফলন ২০ ভাগ হারে কমতে থাকে। তবে বারি মসুর-৮ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বোনা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ফলন কিছুটা কমলেও রোগের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশংকা কম।
ঘ) বীজ শোধন
ডাল জাতীয় ফসল বীজ বপনের পূর্বে শোধন করলে মাটি ও বীজ বাহিত অনেক জীবাণুর আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই মসুর বীজ বপনের পুর্বে অবশ্যই প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউ পি (কার্বোজিন+থিরাম) ২.৫ গ্রাম হারে প্রতি কেজি বীজে মিশিয়ে শোধন করলে শুরুতে গোড়া পচা রোগের প্রকোপ কমে যায়।
ঙ) বপন পদ্ধতি
- ছিটানো ও সারি এই দুই পদ্ধতিতে মসুরের বীজ বপন করা যায়।
- সারিতে বীজ বপন করলে গাছ সমানভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিভিন্ন রকম অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা যেমন- আগাছা দমন, রোগ ও পোকা দমন, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং পরিশেষে ফসল সংগ্রহ সহজ হয়। তাই সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার দেয়া ভালো।
চ) বীজের হার
- বীজের হার ৩০-৩৫ কেজি/হেক্টর। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ সামান্য বেশি দিতে হয়।
- বারি মসুর-৩ এর বেলায় হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- আমন ধানের সাথে সাথী ফসল (রিলে ক্রপ) হিসাবে আবাদ করলে ৫০-৬০ কেজি/হেক্টর বীজ প্রয়োজন হয়।
- বারি মসুর-৯ জাতের ক্ষেত্রে বীজ হার ৭০-৭৫ কেজি/হেক্টর।
ছ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
- যে জমিতে পূর্বে মসুর চাষ করা হয় নাই সেখানে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৫০ গ্রাম হারে অনুমোদিত অণুজীব সার বীজের সাথে মিশিয়ে বপন করতে হবে।
- ইনোকুলাম ব্যবহার করলে সাধারণত ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয় না।
একক ফসলের জন্য অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নলিখিত সারগুলি জমি শেষ চাষের সময় ব্যবহার করতে হবে-
সারের নাম | সারের পরিমাণ/হেক্টর (কেজি) | সারের পরিমাণ/বিঘা (কেজি) |
ইউরিয়া | ৪০-৪৫ | ৫-৬ |
টিএসপি | ৮০-৯০ | ১১-১৩ |
এমওপি | ৪০-৪৫ | ৫-৬ |
জিপসাম | ৫০-৫৫ | ৭-৮ |
বোরন (প্রয়োজনবোধে) | ৭-১০ | ১-১.৫ |
অণুজীব সার (প্রয়োজনবোধে) | সুপারিশমতো | সুপারিশমতো |
জ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- জমিতে আগাছা থাকলে বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে নিড়ানী দ্বারা একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন।
- অতিবৃষ্টির ফলে জমিতে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- তবে মাটিতে রসের অভাবে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হলে গাছ গজানোর ৩০-৪০ দিনের মধ্যে একবার হালকা সেচ দিতে হবে।
ঝ) ফসল সংগ্রহ
বীজ বপনের ১১০-১১৫ দিন পর মসুর সংগ্রহ করা যায়। বারি মসুর-৯ জাতটি স্বল্প জীবনকাল হওয়ায় ৮৫-৯০ দিন পর মসুর সংগ্রহ করা যায়। গাছসহ ফল পেকে বাদামী বর্ণ ধারন করলে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
(২) রোপা আমন ধানের সাথে মসুরের সাথী ফসল চাষ
এ দেশে সাধারণত রোপা আমন ধান কর্তনের পরই রবি শস্যের আবাদ হয়ে থাকে। তবে ধান কাটার পর অনেক ক্ষেত্রেই জমিতে রস থাকে না। আবার কখনও কখনও জমিতে ‘জো’ আসে না। এ অবস্থায় সময়মত মসুর বপন করা যায় না। কিন্তু আমন ধানের জমিতে মসুর সাথী ফসল (রিলে ক্রপ) হিসেবে চাষ করলে সময়মত মসুর বপন করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
এ প্রযুক্তির মাধ্যমে মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি নিম্নরুপ-
ক) ফসল ধারা
আমন ধান → মসুর → বোরো ধান।
যথা:
জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোম্বর = আমন ধান।
নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি = বারি মসুর-৯।
মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন = বোরো ধান।
খ) সাথী ফসল (রিলে ক্রপ)
- আমন ধানের ফসলের ফুল আসার পর কিন্তু কর্তনের পূর্বে অন্য যে ফসলটি বপন করা হয় তাকে সাথী ফসল বলে।
- এ পদ্ধতিতে ধান কাটার ১০-১৫ তিন পূর্বে ধানের জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই কাদার মধ্যে মসুরের বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হয়।
- এ পদ্ধতিতে আবাদ করলে চাষ করে আবাদের চেয়ে ৪৫% খরচ কম হয়।
গ) বপনের সময়
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ (কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ-শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত) মসুর বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
ঘ) জমি নির্বাচন ও বপন পদ্ধতি
- এ পদ্ধতিতে মসুর আবাদের জন্য দোআঁশ/এঁটেল-দোআঁশ-মাটি বেশি উপযোগী।
- রোপা আমন/বোনা আমন ধানের যে সমন্ত জমি অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহের মধ্যে ‘জো’ আসে না অথবা ধান কাটা সম্ভব হয় না, এমন জমি নির্বাচন করে ধান কাটার ১০-১৫ দিন পূর্বে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ধানের মধ্যে মসুরের বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হয়।
- বীজ বপনের পূর্বে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে বপন করলে ভালো হয়।
ঙ) বীজের পরিমাণ
প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
চ) সার প্রয়োগ
- বীজ বপনের ১/২ দিন পূর্বে হেক্টরপ্রতি ৯০ কেজি টিএসপি এবং ৪৫কেজি এমওপি সার একসাথে পরিমাণমতো ছিটাতে হবে।
- জমিতে বোরনের অভাব থাকলে হেক্টরপ্রতি ৭-১০ কেজি বারিক এসিড/বোরাক্স সার প্রয়োগ করতে হবে।
- কোন জমিতে প্রথমবার মসুর চাষ করলে মসুরের প্রতি কেজি বীজের সাথে ৫০ গ্রাম জীবাণু সার পরিমাণমতো ভাতের মাড়/চিটাগুড় মিশিয়ে বপন করতে হবে। তবে ইউরিয়া সার ধান কাটার ৪-৫ দিন পর প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি হিসেবে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে জমিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে বিকাল বেলায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ছ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- মসুরের বীজ গজানোর ৫-৭ দিন পর ধানের খড় মাটি থেকে ২৫ সেমি উচ্চতায় রেখে ধান কাটতে হবে।
- এ পদ্ধতিতে মসুরের জমিতে সাধারণত আগাছা দমন ও সেচেরে তেমন প্রয়োজন পড়ে না। তবে জমিতে সামান্য কিছু আগাছা থাকলে বপনের ৩০-৩৫ দিন পর হাত দ্বারা আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।
জ) ফলন
এ পদ্ধতিতে মসুরের ফলন হেক্টরপ্রতি ১৫০০-১৬০০ কেজি হয়ে থাকে।
ঝ) ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ
- সাধারণত বীজ বপনের ১১৫-১২০ দিন পর মসুর সংগ্রহ করা হয়।
- মাঠে গাছ ফলসহ শুকিয়ে বাদামী হলে মাটির উপর থেকে গাছের গোড়াসহ কেটে এনে পরিষ্কার খোলায় ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে/গরু ঘুরিয়ে/মেশিনের সাহায্যে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করা হয়।
- বীজ সংগ্রহের পর ভালোভাবে পরিষ্কার করে ২-৩ দিন ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
(৩) শুষ্ক ভূমি অঞ্চলে প্রাইম পদ্ধতিতে মসুর চাষ
শুষ্ক ভূমি অঞ্চলে জমিতে প্রয়োজনীয় রসের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা।
আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত রোপা আমন ধান কাটার পরই রবি শস্যের আবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ধান কাটার পর জমিতে পরিমিত রস থাকে না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উঁচু জমিতে বপন সময়ের পূর্বেই জমির রস শুকিয়ে যায়। তবে এ ধরনের জমিতে বীজ প্রাইমিং (বীজ ভিজানো) করে বপন করলে স্বাভাবিক পদ্ধতির চেয়ে ৩-৪ দিন আগে বীজ গজায় এবং গাছের পরবর্তী বৃদ্ধিও ভালো হয়, যা উচ্চ ফলনের সহায়ক।
প্রাইম পদ্ধতিতে মসুরের চাষ নিম্নরূপ-
ক) বপনের সময়
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ (কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত) বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
খ) জমি নির্বচন
সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটি মসুর চাষের জন্য বেশি ভালো।
গ) বীজের পরিমাণ
জমিতে পরিমিত পরিমাণ গাছের জন্য প্রতি হেক্টরে ৩০-৩৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
ঘ) বীজ প্রাইমিং পদ্ধতি
রাত্রে প্রয়োজনীয় বীজ বালতি/গামলা অথবা অনুরূপ পাত্রে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরের দিন সকালে পাত্র থেকে বীজগুলি উঠিয়ে ছায়াতে রেখে শুধু মাত্র বীজের গায়ের পানি শুকিয়ে ঐ দিনই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজ বপন করতে হবে।
ঙ) সার প্রয়োগ
- জমি তৈরির শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি এবং ৪৫ কেজি এমওপি সার একসাথে ছিটাতে হবে।
- কোন জমিতে প্রথমবার মসুর চাষ করলে মসুরের প্রতি কেজি বীজের সাথে ৫০ গ্রাম জীবাণুসার, পরিমিত পরিমাণ ভাতের মাড়/চিটাগুড় মিশিয়ে বপন করতে হবে। তবে জমিতে বোরনের অভাব থাকলে অন্যান্য সারের সাতে ৭-১০ কেজি/হেক্টর বারিক এসিড বোরাক্স সার প্রয়োগ করতে হবে।
চ) জমি চাষ ও বপন পদ্ধতি
- মাটির প্রকারভেদে ৩-৪ টি চাষ ও উত্তমরূপে মই দিয়ে তৈরি করতে হয়।
- জমি তৈরির শেষ চাষের পর পরিমাণ মতো বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হয়।
- তারপর একটি চাষ ও আড়াআড়িভাবে দুটি মই দিতে হয়। এতে করে জমির রস ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং বীজ গজাতে সাহায্য করে।
- এ ছাড়া ২৫ সেমি দূরে সারি করেও বীজ বপন করা যায়।
ছ) আন্তঃপরিচর্যা
- সাধারণত মসুর বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে। তবে মাটিতে যদি রসের অভাব হয় এবং রসের অভাবে গাছের বৃদ্ধি কম হয় সেক্ষেত্রে চারা গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর একবার হালকা সেচ দিতে হয়।
- সেচ দেওয়ার পর জমি নিড়ানী দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হবে।
- জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ মসুর জলবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- আগাছার প্রকোপ বেশি হলে বীজ গজানোর ২৫-৩০ দিন পর এক বার নিড়ানী দিতে হবে।
(৪) সংরক্ষণ কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে ধানী জমিতে মসুর চাষ
অনিশ্চিত জলবায়ুগত অবস্থা, শ্রমিক এবং জ্বালানী ঘাটতির বর্তমান এসময়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদনে প্রচলিত কৃষক পদ্ধতিতে (নিবিড় চাষাবাদ এবং পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ উচ্ছেদকরণ) চাষাবাদের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে জৈব পদার্থের ক্রমাগত হ্রাস, মাটির ভৌতিক গুণাবলীর অবনতি ও ফসলের ফলন ঘাটতিসহ কৃষকের খামারের মুনাফা হ্রাস হচ্ছে। ফলে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থাপনা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এই অসুবিধা নিরসনের লক্ষ্যে সংরক্ষণ কৃষির পদ্ধতিতে ধানী জমিতে মসুর চাষ করা হচ্ছে এবং সফলতার সাথে বিস্তার লাভ করছে।
এই পদ্ধতি (স্ট্রিপ টিলেজ এবং পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ) যা তিনটি আন্তঃসংযুক্ত মূলনীতি যেমন- স্বল্প চাষ, পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ ধরে রাখা এবং উপযোগী শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো, ফসলের ফলন ও মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা যায়।
দেশের উত্তরাঞ্চলের যেসকল মাটির pH ৭-৮ এর মধ্যে, সেসকল ধানী জমিতে সংরক্ষণকৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে আমন ধানের পরে মসুর উৎপাদন করা যায়।
- আমন ধান কাটার সময় ধানের খড়ের ৫০ % অবশিষ্টাংশ জমিতে রেখে টু-হুইল ট্রাক্টর (2-wheel tractor) নামক একটি মেশিন ব্যবহার করে স্ট্রিপ টিলেজে একই সাথে জমি চাষ, বীজ বপন ও সার প্রয়োগ করা হয় (ছবি সংযুক্ত)।
- এ পদ্ধতিতে মসুর বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ।
- এ পদ্ধতিতে ধানের খড়ের মধ্যে মসুর সারিতে বপন করা হয়, ফলে প্রতিটি গাছ সমানভাবে আলো, বাতাস ও পুষ্টি পায় এবং খড়ের দ্বারা সংরক্ষিত মাটির রস পায় যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় গাছের বর্ধন ও ফলন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে (ছবি সংযুক্ত)।
- এ পদ্ধতিতে মসুর চাষ করলে প্রতিটি স্ট্রিপ ৪-৫ সে. মি. প্রসস্থ এবং ৫-৭ সে. মি. গভীরতার হয়ে থাকে। মসুরের সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-৩০ সে. মি. রাখা হয়।
- উল্লেখ্য যে, পদ্ধতিটিতে শুধুমাত্র সারির মধ্যে চাষ হয় এবং দুই সারির মধ্যে অচাষ অবস্থায় থাকে, ফলে পুরো জমির মাত্র ২০ ভাগ জায়গা একবার চাষ হয় এবং বাকি ৮০ ভাগ জায়গা অচাষ অবস্থায় থাকে।
- সংরক্ষণকৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে ধানী জমিতে মসুর চাষ করে কৃষক প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ১৬-১৮ % ফলন বেশি পায়। অধিকন্তু, এই পদ্ধতিতে চাষবাদ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় তিনগুন জ্বালানী খরচ ও সময় কমায়।
- এছাড়া প্রচলিত কৃষক পদ্ধতির তুলনায় সংরক্ষণকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে মসুরের আগাছার পরিমাণ, জাবপোকা এবং পাতা ঝলসানো রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়।
সুতরাং, কৃষক সংরক্ষণকৃষি (স্বল্প চাষ, পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ ধরে রাখা এবং লিগিউম ভিত্তিক শস্য বিন্যাস) পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে স্বল্প খরচে, সময়ে ও স্বল্প শ্রমিকে মসুরের উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
[সূত্র: বিএআরআই]