(১) মাছের সম্পূরক খাদ্যের পরিচিতি ও প্রয়োজনীয়তা
দেহের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য মাছ পুকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা) জু-প্লাংকটন (প্রাণিকণা) খুদিপানা, ছোট জলজ পতঙ্গ, পুকুরের তলদেশের কীট, লার্ভা, কেঁচো, ছোট ছোট শামুক, ঝিনুক, মৃত জৈব পদার্থ ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।
কিন্তু মাছ চাষের ক্ষেত্রে অধিক উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরে অধিক ঘনত্বে পোনা ছাড়া হয়। এ অবস্থায় শুধু প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক উৎপাদন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি সার প্রয়োগ করে প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধি করলেও তা যথেষ্ট হয় না।
প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে বাহির থেকে অতিরিক্ত খাদ্য দিতে হয়। একে সম্পূরক খাদ্য বলে। যেমন-চালের কুঁড়া, সরিষার খৈল, ফিশ মিল ইত্যাদি।
গ্রাসকার্প ও সরপুঁটি মাছ উদ্ভিদভোজী বলে এদের জন্য খুদিপানা, কুটিপানা, শাকসবজির নরম পাতা, ঘাস কেটে সম্পূরক খাবার হিসাবে পুকুরে দেওয়া যায়। মাছকে সরবরাহকৃত সম্পূরক খাদ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন-আমিষ, স্নেহ বা তেল, শর্করা, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের মাত্রা যেন চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।
যে সম্পূরক খাবার এ সকল পুষ্টি উপাদান যথাযথ মাত্রায় রেখে তৈরি করা হয় তাকে সুষম সম্পূরক খাদ্য বলে।
(২) মাছের সম্পূরক খাদ্যের উৎস
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান ব্যবহার করা হয়। উৎসের উপর ভিত্তি করে এসব উপাদানকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
- উদ্ভিদজাত
- প্রাণিজাত
নিচে এদের কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো-
ক) উদ্ভিদজাত
উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদানের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে- চালের কুঁড়া, গম ও ডালের মিহিভুসি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, আটা, চিটাগুড়, খুদিপানা, রান্না ঘরের উচ্ছিষ্ট, বিভিন্ন নরম পাতা যেমন- মিষ্টিকুমড়া, কলাপাতা, বাঁধাকপি ইত্যাদি।
খ) প্রাণিজাত
প্রাণিজাত কয়েকটি খাদ্য উপাদান হচ্ছে শুটকি মাছের গুঁড়া বা ফিশমিল, রেশম কীট মিল, চিংড়ির গুঁড়া (স্রিম্প মিল), কাঁকড়ার গুঁড়া, হাড়ের চূর্ণ (বোন মিল), শামুকের মাংস, গবাদিপশুর রক্ত (ব্লাড মিল) ইত্যাদি।
(৩) মাছের সম্পূরক খাদ্যের উপকারিতা
- মাছকে নিয়মিত সম্পূরক খাবার সরবরাহ করলে অধিক ঘনত্বে পোনা ও বড় মাছ চাষ করা যায়।
- অল্প সময়ে বড় আকারের সুস্থসবল পোনা উৎপাদন করা যায়।
- পোনার বাঁচার হার বেড়ে যায়।
- মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে।
- মাছ পুষ্টির অভাবজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকে।
- সর্বোপরি কম সময়ে জলাশয় থেকে অধিক মাছ ও আর্থিক মুনাফা পাওয়া সম্ভব হয়।
(৪) মাছের পুষ্টি চাহিদা
মাছের প্রজাতি, বয়স ও আকারের উপর ভিত্তি করে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা বিভিন্ন হয়।
প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন মাছের-
- রেণু পোনার জন্য দেহের ওজনের ১০-২০%,
- আঙ্গুলে পোনার জন্য ৫-১০% এবং
- বড় মাছের জন্য ৩-৫% হারে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।
সুস্থ-সবল মাছ ও এর দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য মাছের খাবারে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকা আবশ্যক। এসব উপাদানের মধ্যে আমিষ বা প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। এটি খাবারে বেশি মাত্রায় প্রয়োজন। এজন্য মাছের পুষ্টি চাহিদা বলতে প্রধানত আমিষের চাহিদাকে বোঝায়।
মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান যেমন-শর্করা, তেল ও খনিজ লবণ কম-বেশি বিদ্যমান থাকে। এসব খাদ্যে আমিষের চাহিদা পূরণ হলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলোর খুব একটা অভাব হয় না।
খাদ্যে আমিষের এই চাহিদা প্রজাতি ও জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তর ভেদে-
- কার্প বা রুই জাতীয় মাছের জন্য ২০-৩০%,
- চিংড়ির জন্য ৩০-৪৫% ও
- ক্যাটফিশ (আঁশ বিহীন লম্বা শুঁড়যুক্ত মাছ) বা মাগুর জাতীয় মাছের জন্য ৩৫-৪৫% থাকে।
একটি পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে যখন মাছ উৎপাদন করা হয় তখন ঐ খাদ্য কী পরিমাণ মাছ দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে (মাছ খাচ্ছে) এবং তা থেকে কী পরিমাণ মাছ উৎপাদন হচ্ছে তা খাদ্য রূপান্তর হার বা FCR (Food Conversion Ratio) নির্ণয়ের মাধ্যমে হিসাব করা যায়।
এভাবে একাধিক খাদ্যের FCR নির্ণয় করে তুলনা করলে কোন খাদ্য অধিক ভালো তা বোঝা যায়।
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, খাদ্য রূপান্তর হার বা FCR হচ্ছে খাদ্য প্রয়োগ ও খাদ্য গ্রহণের ফলে জীবের দৈহিক বৃদ্ধির অনুপাত। অর্থাৎ ১ কেজি মাছ পেতে যত কেজি খাবার খাওয়াতে হয়, তাই খাদ্য রূপান্তর হার।
FCR = মাছকে প্রদানকৃত খাদ্য/ দৈহিক বৃদ্ধি
দৈহিক বৃদ্ধি = আহরণকালীন মোট ওজন – মজুদকালীন মোট ওজন
ধরা যাক, একটি পুকুরে কিছু মাছের পোনা ছাড়া হলো যার মোট ওজন ১ কেজি। নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করে ৬ মাস পর আহরণের সময় মোট ১৫ কেজি মাছ পাওয়া গেল। এ ৬ মাসে মোট ২১ কেজি খাদ্য প্রয়োগ করা হলো।
সুতরাং, FCR = ২১ /১৫ – ১ = ১.৫
FCR-এর মান সবসময় ১ এর চেয়ে বড় হয়। যে খাদ্যের FCR এর মান যত কম সে খাদ্যের গুণগত মান তত ভালো অর্থাৎ, সে খাদ্য ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন করা যায়।
(৫) মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির ফর্মুলা তালিকা উপাদানসহ
কার্প বা রুই জাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে নিম্নের উপাদানগুলোর মিশ্রণে সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা যায়-
উপকরণের নাম | শতকরা হার (%) |
ফিসমিল | ১০-২১ |
সরিষার খৈল | ৪৫-৫৩ |
চালের কুঁড়া | ২৮-৩০ |
ভিটামিন ও খনিজ লবণ | ০.৫-১.০ |
চিটাগুড় ও আটা | ৫ |
মোট | ১০০ |
(৬) মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুত প্রণালি
- প্রথমে ভালো মান সম্পন্ন নির্ধারিত খাদ্য উপাদানসমূহ সংগ্রহ করতে হবে। উপাদানসমূহ প্রয়োজনে আটা পেষা মেশিনে বা ঢেঁকিতে ভালো করে চূর্ণ বা গুঁড়া করে নিতে হবে এবং চালনি দিয়ে চেলে নিতে হবে।
- সূত্র অনুযায়ী খাদ্য উপাদানসমূহ একটি একটি করে মেপে নিয়ে মিক্সার মেশিনে বা একটি বড় পাত্রে ভালোভাবে মেশাতে হবে।
- মেশানো উপাদানগুলোতে পানি দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে মণ্ড তৈরি করতে হবে।
- এখন মণ্ড ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে ভেজা বা আর্দ্র খাদ্য হিসাবে মাছকে দিতে হবে।
- মাছকে সরবরাহকৃত খাবার পানিতে বেশি স্থিতিশীল রাখার জন্য বাইন্ডার হিসাবে আটা বা ময়দা বা চিটাগুড় ব্যবহার করা যায়।
- ভেজা বা আর্দ্র খাবার প্রতিদিন প্রয়োগের পূর্বে পরিমাণমতো তৈরি করতে হবে। আবার এই মণ্ড দিয়ে সহজ পদ্ধতিতে স্বল্প মূল্যে দেশীয় পিলেট মেশিনের সাহায্যে পিলেট বা দানাদার খাবার তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পিলেট বা দানাদার খাবার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে এবং পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য বায়ুরোধী প্লাষ্টিক ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
- খৈলে কিছু বিষাক্ত উপাদান থাকে, যা মাছের জন্য ক্ষতিকর। তাই খৈল একদিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করতে হয়। খৈল ভেজানো পানি মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না।
- সুষম খাদ্য তৈরির জন্য নির্বাচিত খাদ্য উপাদানের সাথে ০.৫-১% ভিটামিন ও খনিজ লবণের মিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে। ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ কিনতে পাওয়া যায়।
(৭) মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি
- মাছ দিনের বেলায় খাবার গ্রহণ করে। এজন্য চাষের পুকুরে দিনের প্রয়োজনীয় খাবার সমান দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগ সকালে এবং অন্য ভাগ বিকালে দিতে হবে। অন্যদিকে চিংড়ি নৈশভোজী বলে এদেরকে সন্ধ্যায় বা রাতে খাবার দিতে হয়।
- প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন মাছের রেণু পোনার জন্য দেহের ওজনের ১০-২০%, আঙ্গুলে পোনার জন্য ৫- ১০% এবং বড় মাছের জন্য ৩-৫% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। পোনা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ১ বার এবং মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে ১৫ দিন বা মাসে ১ বার জাল টেনে কয়েকটি মাছের গড় ওজন নিয়ে পুকুরে সর্বমোট যতটি মাছ ছাড়া হয়েছিল তা দিয়ে গুণ করলে পুকুরে মোট মাছের ওজন পাওয়া যাবে। এভাবে দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে খাবারের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।
- পুকুরে গ্রাসকার্প ও সরপুঁটি চাষ করা হলে এদেরকে খুদিপানা, কুটিপানা, সবুজ ঘাস, হেলেঞ্চা, কচুরিপানার নরম অংশ ও বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতা যেমন-বাঁধাকপি, পুঁইশাক, কলাপাতা কেটে পুকুরে সরবরাহ করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বাঁশের টুকরা বা গাছের ডালদিয়ে বর্গাকারের একটি ফ্রেম তৈরি করতে হবে। ফ্রেমটি একটি খুঁটির সাহায্যে পুকুরের পানিতে স্থাপন করতে হবে যেন এটি সবসময় একই স্থানে থাকে। এই ফিডিং ফ্রেম বা রিং-এ উপরোক্ত খাদ্য দিতে হবে। মাঝে মাঝে এটি পরিষ্কার করতে হবে।
- শুকনো খাবার পানির উপরে ছিটিয়ে এবং আর্দ্র বা ভেজা খাবার পানির ৩০-৬০ সেমি নিচে স্থাপিত খাদ্যদানি, ট্রে বা মাচায় প্রয়োগ করতে হবে। এতে খাদ্যের অপচয় কম হবে।
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পুকুরের চারপাশে ৩-৪ টি নির্দিষ্ট স্থানে খাবার দিতে হবে। এতে করে খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
- শীতকালে মাছের বৃদ্ধি কম হয় বলে খাদ্য প্রয়োগের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বা তিনভাগের একভাগ কমিয়ে আনতে হয়।
- পুকুর অত্যধিক সবুজ হয়ে গেলে খাবার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে।
- খাদ্য প্রয়োগের যথেষ্ট সময় পর খাবার থেকে গেলে বুঝতে হবে খাদ্যের পরিমাণ বেশি হয়েছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
[সূত্র: এনসিটিবি]