বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাসকলাইয়ের চাষ বেশি হয়ে থাকে।
মাসকলাই একটি শক্ত ও খরা সহিষ্ণু ফসল যা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
ডাল হিসাবে ছাড়াও এটি কাঁচাগাছ অবস্থায় পশুখাদ্য ও সবুজ সার হিসাবে বহুল ব্যবহৃত হয়। কাজেই ডাল ফসল হিসাবে মাসকলাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(১) মাসকলাই এর চাষ পদ্ধতি
ক) মাসকলাই চাষের জমি নির্বাচন
সুনিষ্কাশিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি মাসকলাই চাষের জন্য উপযোগী। উঁচু থেকে নিচু সব ধরনের জমিতে মাসকলাই চাষ করা যায় যদি পানি জমে থাকার আশঙ্কা না থাকে। মাসকলাই উষ্ণ ও শুকনো জলবায়ুর ফসল।
খ) মাসকলাইয়ের জাতসমূহ
বাংলাদেশে চাষকৃত মাসকলাইয়ের বেশ কিছু উন্নত ও স্থানীয় জাত রয়েছে।
নিচে মাসকলাই এর কয়েকটি জাতের নাম দেওয়া হলো-
- উফশী জাত: পান্থ, শরৎ, হেমন্ত, বিনা মাস-১, বিনা মাস-২।
- স্থানীয় জাত: রাজশাহী, সাধুহাটি।
গ) মাসকলাই বীজ বপনের সময়
মাসকলাই বীজ ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়।
ঙ) জমি তৈরি
মাসকলাই চাষের জন্যে খুব মিহিভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয় না। জমি ও মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমান করে তৈরি করতে হয়।
চ) বীজ হার
নিচে মাসকলাই চাষের জন্য বীজ হার দেওয়া হলো।
উদ্দেশ্য | বপন পদ্ধতি | বীজ হার (গ্রাম/শতক) |
বীজের জন্য | ছিটিয়ে | ১৪০-১৬০ |
ডাল উৎপাদনের জন্য | সারিতে | ১০০-১২০ |
পশুখাদ্য বা সবুজ সারের জন্য | ছিটিয়ে | ২০০-২৪০ |
ছ) বীজ বপন পদ্ধতি
- মাসকলাইয়ের বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বপন করা যায়। তবে বীজের জন্য সারিতে বপন করা ভালো।
- সারিতে বপন করার ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি রাখতে হয়।
- সারিতে বীজগুলো অবিরতভাবে ২-৩ সেমি গভীরে বীজ বপন করা হয়।
- ছিটানো পদ্ধতিতে শেষ চাষের সময় মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয়।
জ) বীজ শোধন
বীজ বাহিত রোগ দমনের জন্য বীজ শোধন করে বপন করা দরকার।
ঝ) সার ব্যবস্থাপনা
মাসকলাই চাষে হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ নিম্নরূপ-
সারের নাম | সারের পরিমাণ (গ্রাম/শতক) |
ইউরিয়া | ১৬০-১৮০ |
টিএসপি | ৩৪০-৩৮০ |
এমওপি | ১২০-১৬০ |
অণুবীজ সার | ১৬-২০ |
ঞ) সার প্রয়োগের নিয়মাবলি
জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সব সার প্রয়োগ করতে হবে। জীবাণুসার প্রয়োগ করা হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগের দরকার হয় না। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অণুবীজ সার প্রয়োগ করতে হবে।
ট) অর্ন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
- চারা গজানোর পরে আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থাকলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বপনের পর জমিতে রসের পরিমাণ কম বা অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে।
- সেচের পর ‘জো’ অবস্থায় মাটির উপরের শক্ত স্তর ভেঙে দিতে হবে।
- ফসলের জমিতে পোকা ও রোগের আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠ) ফলন
জাত ভেদে মাসকলাইয়ের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫-২ টন হয়ে থাকে।
ড) ফসল কাটা, মাড়াই ও গুদামজাতকরণ
- খরিপ-১ মৌসুমে মে মাসের শেষ এবং খরিপ-২ মৌসুমে অক্টোবর মাসের শেষে ফসল সংগ্রহ করা হয়।
- পরিপক্ক হলে সকালের দিকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
- জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একবার বা ২-৩ বার ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
- প্রথম দিকে পরিপক্ব ফল হাত দিয়ে এবং শেষবারের বেলায় কাঁচি দিয়ে গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিতে হবে।
- গাছগুলো রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- সংগৃহীত বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা করে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে গুদামজাত করতে হবে।
(২) মাসকলাইয় চাষে রোগ ব্যবস্থাপনা
ক) মাসকলাইয়ের পাতার দাগ রোগ
রোগের কারণ ও বিস্তার:
- সারকোস্পোরা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগটি হয়।
- পরিত্যক্ত ফসলের অংশ, বায়ু ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
- অধিক আর্দ্রতা ও উচ্চতাপে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত পাতার উপর ছোট ছোট লালচে বাদামি গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে।
- আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ শুকিয়ে যায় এবং পাতা ছিদ্র হয়ে যায়।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়।
প্রতিকার:
- রোগ প্রতিরোধী জাতের (পান্থ, শরৎ ও হেমন্ত) মাসকলাই চাষ করতে হবে।
- আক্রমণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
খ) পাউডারি মিলডিউ রোগ
রোগের কারণ ও বিস্তার:
- ওইডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
- সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে এ রোগের অধিক প্রকোপ দেখা যায়।
- বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ:
পাতার উপর পৃষ্ঠে পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। হাতে স্পর্শ করলে পাউডারের গুঁড়ার মতো লাগে।
প্রতিকার:
- বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- টিল্ট বা থিওভিট প্রয়োগ করতে হবে।
- রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
- ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
গ) হলদে মোজাইক ভাইরাস
রোগের কারণ ও বিস্তার মোজাইক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাদা মাছি এ রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে।
রোগের লক্ষণ:
কচি পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতার উপর হলদে সবুজ দাগ পড়ে। দূর থেকে আক্রান্ত জমি হলদে মনে হয়।
প্রতিকার:
- রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
- সাদা মাছি দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন স্প্রে করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী জাতের মাসকলাইয়ের চাষ করতে হবে।
(১২) মাসকলাইয় চাষে পোকা মাকড় দমন
ক) বিছা পোকা
মাসকলাই ফসলে বিছা পোকার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ পোকা পাতা, অপরিপক্ক সবুজ ফলের রস খেয়ে ফেলে। পাতাসহ সমস্ত গাছ সাদা জালিকার মতো হয়ে যায়। ফলে ফলন কমে যায়।
- এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে হাত দ্বারা সেগুলোকে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে পরিমাণ মতো সাইপারমেথ্রিন ইসি এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
খ) ডালের খোসা ছিদ্র করা পোকা
গুদামজাত মাসকলাই ডাল পূর্ণবয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ই ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডালের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে। ফলে দানা হালকা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপোযুক্ত হয়ে পড়ে।
- গুদামজাত করার আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে দানা শুকিয়ে দানার আদ্রর্তা ১২% এর নিচে আনতে হবে।
- বীজের জন্য টনপ্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন শতকরা ১০ ভাগ গুঁড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
[সূত্র: এনসিটিবি]