(১) মাসকলাই চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি
উঁচু থেকে মাঝারী উচুঁ ও সুনিষ্কাশিত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি মাসকলাই উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী।
খ) জমি তৈরি
২-৩টি আড়াআড়ি চাষ ও প্রয়োজনীয় মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে তৈরি করতে হবে।
গ) বপন পদ্ধতি
ছিটিয়ে এবং সারি করে বপন করা যায়। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি রাখতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে ছিটিয়ে বোনা যায়। বিশেষ করে খরিফ-২ মৌসুমে আউশ ধানের জমিতে সাথী ফসল হিসাবেও চাষ করা যায়।
ঘ) বীজের হার
প্রতি হেক্টরে ৩০-৩৫ কেজি। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ কিছু বেশি দিতে হবে।
ঙ) বপনের সময়
এলাকা ভেদে বপন সময়ের তারতম্য দেখা যায়। খরিফ-১ মৌসুমে ফাল্গুন ২য় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন শেষ সপ্তাহ (ফেব্রুয়ারি শেষ হতে মধ্য-মার্চ) এবং খরিফ-২ মৌসুমে শ্রাবণ মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে ১৫ই ভাদ্র (আগস্টের ২য় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর ১ম সপ্তাহ)।
চ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নরুপ সার প্রয়োগ করতে হয়।
সারের নাম | সারের পরিমাণ/হেক্টর (কেজি) | সারের পরিমাণ/বিঘা (কেজি) |
ইউরিয়া | ৪০-৪৫ | ৫-৬ |
টিএসপি | ৮০-৯০ | ১০-১৩ |
এমওপি | ৪০-৪৫ | ৫-৬ |
জিপসাম | ৫০-৫৫ | ৭-৮ |
বোরন (প্রয়োজনবোধে) | ৭-১০ | ১-১.৫ |
অণুজীব সার (প্রয়োজনবোধে) | সুপারিশমতো | সুপারিশমতো |
সমস্ত সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হয়।
ছ) অন্তবর্তীকালিন পরিচর্যা
- বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। বৃষ্টিপাতের ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে না পারে সে জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- মাসকলাই চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষকগণ যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হন তার মধ্যে রোগ-বালাই এবং পোকান্ডমাকড় এর আক্রমণ অন্যতম।
- বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মাসকলাইয়ের মোট ২০টি রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে মাঠ পর্যায়ে ফসলে ১৭টি এবং গুদামজাত শস্যে ৩টি রোগ সনাক্ত করা হয়েছে।
- এগুলোর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে ৪টি এবং গুদামজাত অবস্থায় ২টি রোগ বেশি ক্ষতিকর।
(২) মাসকলাই চাষে রোগ-বালাই এর লক্ষণ, প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনা
ক) মাসকলাই চাষে হলুদ মোজাইক রোগ
হলুদ মোজাইক মাসকলাইয়ের সবচেয়ে মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব কটি দেশেই মাসকলাইয়ের জমিতে এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। তবে মুগের তুলনায় এর প্রকোপ কিছুটা কম হয়।
চারা অবস্থা থেকে শুরু করে পূর্ণ বয়স্ক গাছ পর্যন্ত ফসলের যেকোন অবস্থায়ই এ রোগের আক্রমণ হতে পারে। তবে আক্রমণ যত কম বয়সে হয় ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি হয়।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় এরোগের আক্রমণ আট সপ্তাহ বয়সের মাসকলাই ক্ষেতে তেমন কোন ক্ষতি হয় না। পক্ষান্তরে সাত, ছয়, পাঁচ এবং চার সপ্তাহ বয়সের ফসলে যথাক্রমে শতকরা ২০, ৩৮, ৬০ ও ৮৫ ভাগ ফলন কমে যেতে পারে। এমনকি এক থেকে দুই সপ্তাহ বয়সের মাসকলাই ফসল আক্রান্ত হলে প্রায় শতকরা ১০০ ভাগ ফলন বিনষ্ট হতে পারে (Yang, 1987)।
এই রোগের আক্রমণকারী ভাইরাস সাদা মাছি (White Fly) দ্বারা বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত পাতার উপর চমকা ও গাঢ় সবুজ এবং হলুদ রং এর মিশ্রণ যুক্ত নানা বর্ণের বিন্যাস এ রোগের প্রধান লক্ষণ। জাতভেদে এ রোগের লক্ষণের কিছুটা তারতম্য হলেও এরূপ হলুদ হয়ে যাওয়া সর্বাবস্থায় দেখা যায়।
- আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতির হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা, ফুল ও ফল কুঁকড়ে যায় এবং ফলের আকার ছোট হয়।
- বীজ অপুষ্ট ও কুঁকড়ানো হয়। প্রতিটি ফলে বীজের সংখ্যা হ্রাস পায়।
- মারাত্মকভাবে আক্রান্ত গাছে ফুল ফল মোটেই ধরে না বা খুবই কম ধরে থাকে।
ব্যবস্থাপনা:
- এ রোগটির ব্যবস্থাপনা খুবই কষ্টসাধ্য। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত মাসকলাইয়ের উন্নত জাতসমূহের (বারি মাস-১, বারি মাস-২,বারি মাস-৩ এবং বারি মাস-৪) এ রোগ সহ্য ক্ষমতা রয়েছে।
- খরিফ মৌসুমে বপনকৃত ফসলে, খরিফ-২ মৌসুমে বপনকৃত ফসলের তুলনায় এ রোগের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কম হতে দেখা যায়।
- ফসলের প্রাথমিক পর্যায়ে হলুদ মোজাইক আক্রান্ত গাছ মাঠে দেখার সাথে সাথে গাছ উপড়ে ফেলে দিতে হবে।
- তাছাড়া রোগ বিস্তারকারী সাদা মাছি কীটনাশকের মাধ্যমে দমন করেও রোগ বিস্তার রোধ করা যায়।
খ) মাসকালাই পাতার সারকোস্পোরা দাগ
সারকোস্পোরা দাগ মাসকলাই পাতার একটি অতি ক্ষতিকর রোগ। আবহাওয়ার তারতম্যের উপর ভিত্তি করে এ রোগের প্রকোপ কম বেশি হয়ে থাকে। রোগের অনুকূল আবহাওয়ায় পাতার দাগের কারণে ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে থাকে।
এ রোগ “সারকোস্পোরা ক্রোয়েন্টা” বা “সারকোস্পোরা কেনেসেন্স” নামক ছত্রাকের আক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। জীবাণু ছত্রাক আক্রান্ত ফসলের পরিত্যক্ত আবর্জনার মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে। গাছের আক্রান্ত অংশ বীজের সাথে মিশে পরবর্তী মৌসুমে আক্রমণের প্রাথমিক উৎস হিসাবে কাজ করতে পারে।
রোগের লক্ষণ:
- রোগের লক্ষণ প্রথমে পাতার উপর ছোট ছোট পানিতে ভেজা আলপিনের মাথার সমান দাগের আকারে প্রকাশ পায়। পরে এই দাগগুলি বাদামী বা লালচে বাদামী রং ধারণ করে ক্রমশ আকারে বড় হতে থাকে। দাগগুলি প্রায় ১.৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট হয়। একাধিক দাগ এক সাথে মিশে বড় দাগের সৃষ্টি হতে পারে।
- ফসলের জাত ভেদে দাগগুলি বিভিন্ন ধরনের হতে দেখা যায়। কোন কোন জাতের দাগগুলি চারিদিকে বাদামী রং বলয়যুক্ত এবং কেন্দ্রের কিছুটা অংশ সাদা হয়। আবার কোন কোন জাতে দাগের বেশির ভাগ অংশই সাদাটে হয়।
- সাধারণত দাগগুলো কোন নির্দিষ্ট আকার বা আকৃতির হয় না। খুব বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হলে গাছের পাতা ঝরে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- রোগের জীবাণু ফসলের আক্রান্ত অংশে বেঁচে থাকতে পারে বিধায় আক্রান্ত ফসলের আবর্জনা যাতে ভালোভাবে পচে যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভবিত মাসকলাইয়ের উন্নত জাতসমূহের (বারি মাস-১, বারি মাস-২, বারি মাস-৩ এবং বারি মাস-৪) এ রোগের আক্রমণ কম হয়।
- এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে অটোস্টিন-৫০ ডব্লিউ পি নামক ঔষধ প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২/৩ বার স্প্রে করলে এরোগ দমন করা যায়।
গ) মাসকালাইয়ের পাউডারী মিলডিউ রোগ দমন
পাউডারী মিলডিউ মাসকলাইয়ের একটি প্রধান রোগ। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মাসকলাইতে এ রোগ আক্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশে এ রোগটি খরিফ-২ মৌসুমে বেশি আক্রমণ করে। বিশেষত দেরিতে বোনা ফসলের বেশি ক্ষতি করে থাকে।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় যে, এ রোগের আক্রমণের কারণে মাসকলাইয়ের খরিফ-২ মৌসুমে ৪২% এবং খরিফ-১ মৌসুমে ১৭% পর্যন্ত ক্ষতি করে থাকে। ইহা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এরোগের জীবাণু ছত্রাক ইরাইছিফি পলিগনি বা অয়ডিয়াম এসপি প্রধানত বায়ু প্রবাহের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্য স্থানে বাহিত হয়।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগ সর্ব প্রথম পাতার উপরে ছোট ছোট সাদা হালকা পাউডারী দাগের আকারে প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে এ দাগ থেকে আরও অসংখ্য অনুরূপ পাউডারী দাগের সৃষ্টি হয় এবং পাতার উপরের পুরো অংশ আক্রান্ত হয়ে সাদা পাউডারের মত হয়ে যায়। পরে পাতা থেকে কান্ড ও ফল-ফুল প্রভৃতি অংশেও আক্রমণ বিস্তার লাভ করে।
- পাতার উপরের সাদা পাউডার ক্রমে ছাই রং ধারণ করে এবং পরিশেষে তা কাল বা গাঢ় বাদামী রঙের পাউডারে পরিণত হয়। পাতার সবুজ রং পরিবর্তিত হয়ে ছাই রঙে পরিণত হয়।
ব্যবস্থাপনা:
- রোগ সহনশীল কোন জাতের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে সময়মত বপন করলে এ রোগের আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
- এছাড়া ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেও এ রোগ দমন করা যায়। টিল্ট-২৫০ ইসি/০.৫ মিলি অথবা থিউভিট ৮০ ডব্লিউ পি ২.০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে রোগের আক্রমণের শুরু থেকে ৭ হতে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত মাসকলাইয়ের উন্নত জাতসমূহে এ রোগের আক্রমণ কম পরিলক্ষিত হয়।
ঘ) মাসকালাই এর পাতা পচা রোগের প্রতিকার
সাস্প্রতিকালে মাকলাইয়ে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইহা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগটি সর্ব প্রথম যশোর এবং ঈশ্বরদী আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহের গবেষণা খামারে লক্ষ্য করা যায় এবং আক্রমণকারী ছত্রাককে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকের জমিতেও এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে এই রোগ একটা প্রধান রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগের আক্রমণের শুরুতে পাতার উপর পানিতে ভেজা দাগের সৃষ্টি হয়। উষ্ণ ও মেঘলা আবহাওয়ায় দাগের আকার বৃদ্ধি পেয়ে পাতার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আক্রান্ত পাতাগুলো শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে।
- শুকনা আক্রান্ত অংশে ছত্রাকের সাদা মাইসিলিয়াম দেখা যায় এবং পরে বিভিন্ন আকারে স্কে্লরোশিয়াম তৈরি হয়। স্কে্লরোশিয়ামগুলো প্রথমে সাদা রঙের থাকে এবং পুরোমাত্রায় পরিপক্কতা আসলে তুলার বীজের মতো গাঢ় বাদামী বা কাল রং ধারণ করে।
রোগ বিস্তার:
এ রোগের আক্রমণকারী ছত্রাক (Selerotiniasclerotiorum) মাটিতে থাকে। আক্রান্ত গাছের উপর ইহা ছত্রাকের স্কে্লরোশিয়াম তৈরি করে। স্কে্লরোশিয়াম মাটির সাথে মিশে মাটিতে থেকে যায়। উপযুক্ত আবহাওয়ায় ইহা অঙ্কুরিত হয়ে এসকোকার্প তৈরি করে। পরিপক্ক এসকোকার্প বিষ্ফোরিত হয়ে এসকোস্পোর নিক্ষেপ করে যা শস্যকে আক্রমণ করে।
ব্যবস্থাপনা:
- এরোগের দমন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের উপর বাংলাদেশে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। রোগ দমনের জন্য জমিতে আক্রান্ত ফসলের আবর্জনা এবং স্কে্লরোশিয়াসমূহ পরিপক্ক হয়ে পড়ে যাওয়ার পূর্বে পরিষ্কার করা দরকার।
- আক্রমণ দেখা দেয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগের দমন ব্যবস্থা হিসাবে আক্রান্ত গাছের অংশ পরিস্কার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- এছাড়া রেখা দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোভরাল নামক ছত্রাক নাশক ২.০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ স্প্রে করলে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
ঙ) মাসকালাইয়ে জাবপোকার আক্রমন রোধ
জাবপোকা সাধারণত দলবদ্ধভাবে পাতা, ডগা, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায়। এদের আক্রমণে গাছ খর্বাকৃতি হয়, ফুল ও ফল ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়, বীজের দানা অপুষ্ট ও আকারে ছোট হয়।
জাবপোকার আক্রমণ দেখা গেলে ডাইমেথয়েট গ্রুপের (যেমন- টাফগর-৪০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি/লিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করে সহজেই জাবপোকা দমন করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]