মৃত্তিকা পানি বা Soil Water হলো মৃত্তিকার বলয়ে অবস্থিত পানি অর্থাৎ মৃত্তিকার বাতাশ্বয়ন অঞ্চল বা অধিভূজলীয় অঞ্চলের পানি। নিম্নে মৃত্তিকা পানি কাকে বলে/মৃত্তিকা পানি কি এ তা আরেও সহজভাবে আলেচনা করার ও বুঝার চেষ্টা করব।
মূলতঃ ভূ-অভ্যন্তরে মৃত্তিকা কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। তরল মৃত্তিকায় পানি দিয়ে গঠিত দ্রবীভূত বস্ত্ত থাকে। একারণে মৃত্তিকা পানিকে মৃত্তিকা দ্রবণও বলা হয়।
গাছের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য পানি। গাছ শিকড়ের মাধ্যমে মৃত্তিকা থেকে পানি সংগ্রহ করে। এভাবে মৃত্তিকা পানি কৃষি উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভূপৃষ্ঠে শক্তির ভারসাম্য প্রভাবকারী কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেও পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গাছের জন্য মৃত্তিকার পানি সরবরাহ ক্ষমতা বর্ষণ এবং সেচ থেকে পানির নতুন প্রবাহের লাভের উপর নির্ভর করে। ভূত্বক দিয়ে পানি অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং স্থূল ও সূক্ষ রন্ধ্র দিয়ে মৃত্তিকার বিভিন্ন গভীরতায় পুর্ণবন্টিত হয়।
এ পাঠটি শেষ অবধি অধ্যয়ন করলে আপনি- মৃত্তিকা কি ও মৃত্তিকা পানি কাকে বলে তা জানতে পারবেন। ফসল উৎপাদনে মৃত্তিকা পানির ভূমিকা ও মৃত্তিকা পানির গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। মৃত্তিকা পানির শ্রেনিবিভাগ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) মৃত্তিকা পানি কাকে বলে?
মৃত্তিকা পানি কাকে বলে: মাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি। সাধারণত মাটির অভ্যন্তরে যে পানি থাকে তাকে মৃত্তিকা পানি বলে। বৃষ্টিপাত, তুষার, কুয়াশা, সেচের পানি ইত্যাদি মৃত্তিকা পানির উৎস।
মৃত্তিকাতে পানির পরিমাণ পানির আয়তন বা ভর দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ভর ভিত্তিক পানির পরিমাণ নির্ণয়ে মৃত্তিকার প্রাথমিক নমুনার ওজন নেওয়া হয় এবং পরে ১০৫°সে তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা শুকানোর পর পুনরায় ওজন নেওয়া হয়। এ দুটি ওজনের পার্থক্য থেকে পানির পরিমাণ নির্ণয় করে তা একক পরিমাণ মৃত্তিকার ভিত্তিতে প্রকাশ করা হয়।
মৃত্তিকা পানির ভূমিকা: মৃত্তিকা কনা ও জৈব পদার্থ হচ্ছে কঠিন পদার্থ। মাটিতে কঠিন পদার্থের কনাগুলোর ফাঁকা স্থানে (Pore space) পানি ও বায়ু থাকে। মৃত্তিকা পানি মাটিতে যেসব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদন রয়েছে তা দ্রবীভূত করে গাছের গ্রহণ উপযোগী করে তুলে।
মৃত্তিকা রন্ধ্র: মাটিতে দুই প্রকার রন্ধ্র থাকে যেমন সূক্ষ রন্ধ্র (Micro pores) ও স্থূল রন্ধ্র (Macro pores)। সাধারণত সূক্ষ রন্ধ্রে যে পানি থাকে তা গাছ পরিশোষণ করতে পারে। স্থূল রন্ধ্রের পানি মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে নিচে চলে যায় যা গাছ গ্রহণ করতে পারে না। মাটির ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং মাটিতে পানির পরিমান পরীক্ষা করে সেচের সময় ও পরিমান নির্ধারণ করতে হয়।
মৃত্তিকা পানি ধারণ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান:
- মৃত্তিকা বুনট ও সংযুক্তি
- জৈব পদার্থের পরিমান
- রন্ধ্রের প্রকৃতি
- মাটির প্রোফাইলের গভীরতা
মৃত্তিকা পানি অপচয় উপাদান:
- বাস্পীভবন
- প্রস্বেদন
- চুয়ানো
(২) মৃত্তিকা পানির গুরুত্ব
- পানি বিভিন্ন শিলা ও খনিজ পদার্থের ক্ষয় ঘটিয়ে মাটি গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
- পানি একটি সার্বজনীন দ্রাবক যাতে সমস্ত পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। এটি মাটি থেকে উদ্ভিদে পুষ্টি উপাদান এর বাহক হিসেবে কাজ করে এবং উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য করে।
- উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণে পানি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে। CO2 + H2O আলো/ক্লোরোফিল C6H12O6 + O2↑।
- উদ্ভিদকে সজীব ও সতেজ করে।
- মাটিকে নরম করে ও কর্ষণ কাজ সহজ করে। এর ফলে বীজের অংকুরোদগম ত্বরান্বিত হয়। পানি ছাড়া বীজের অংকুরোদগম সম্ভবপর নয়।
- মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং অণুজৈবিক কার্যাবলীর জন্য পানি অত্যাবশ্যক।
- মাটির তাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং গাছকে অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরম থেকে রক্ষা করে।
- সর্বোপরি ফসলের ফলন, উৎপাদন ও গুনগতমান বাড়ায়।
(৩) মৃত্তিকা পানির শ্রেনিবিভাগ
মৃত্তিকা পানি প্রধানত তিন প্রকার-
- মহাকর্ষীয় পানি (Gravitational water)
- কৈশিক পানি (Capillary water)
- জলাকর্ষী বা আদ্রিক পানি (Hygroscoic water)
ক) মহাকর্ষীয় পানি
অধিক বৃষ্টিপাত বা সেচের ফলে মাটির রন্ধ্র পরিসর যখন পানি দ্বারা পূর্ণ হয় এবং বায়ুশূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে যে পানি নিচের দিকে অপসারিত হয় যাকে মহাকর্ষীয় পানি বলে।
মাটির সমস্ত সূক্ষ্ম ও স্থুল রন্ধ্র পরিসর পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই অবস্থাকে মাটির সম্পৃক্তাবস্থা বলে। এই পানি গাছের গ্রহণ উপযোগী নয়। উপরন্ত পুষ্টি উপাদান অনুস্রবনের (চবৎপড়ষধ:রড়হ) মাধ্যমে নষ্ট হয়।
খ) কৈশিক পানি
ভারী বর্ষনের পরে অথবা সেচ প্রদানের পরে অতিরিক্ত পানি মধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে নিচের দিকে অপসারণ হওয়ার পর মৃত্তিকা কনার গায়ে পানি মোটা আস্তরণের মত লেগে থাকে তাকে কৈশিক পানি বলে।
উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পানি কৈশিক পানি থেকে গ্রহন করে। এ পানির মধ্যে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। মৃত্তিকার গঠন, বিন্যাস, বুনট, জৈব পদার্থ এবং কলয়ডাল পদার্থের উপর মৃত্তিকায় অবস্থানরত কৈশিক পানির পরিমান নির্ভর করে।
কৈশিক পানি দুই প্রকার-
i) উদ্ভিদের গ্রহন উপযোগী কৈশিক পানি: এই পানি গাছ সহজে গ্রহণ করতে পারে। টেনশন ০.৩৩ থেকে ১৫ বার। অর্থাৎ যে কৈশিক পানি মাঠ ক্ষমতা ও ঢলে পড়া অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান করে এবং মাটির রন্ধ্র পরিসরে ২৫ থেকে ৫০ ভাগ পানি থাকে সেই পানিকেই উদ্ভিদের গ্রহনোপযোগী কৈশিক পানি বলে।
ii) উদ্ভিদের গ্রহণ অনুপযোগী কৈশিক পানি: যে পানির টেনশন ১৫-৩১ বার এবং উদ্ভিদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় তাকে উদ্ভিদের গ্রহণ অনুপযোগী কৈশিক পানি বলে। মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসরে ১৫-২৫ ভাগ পানি থাকে।
গ) জলাকর্ষী বা আদ্রিক পানি
যে পানি শুকনো মাটি কনার সাথে শক্তভাবে প্রলেপের ন্যায় থাকে তাকে জলাকর্ষী বা আদ্রিক পানি বলে।
এই পানি খুব কম পরিমানে থাকে যা উদ্ভিদ কোন অবস্থাতেই গ্রহণ করতে পারে না। এই পানি গতিশীল হয় না। এই পানির পরিমান মৃত্তিকা কনা, মৃত্তিকার বুনট, জৈব পদার্থ এবং অন্যান্য কলয়ডাল পদার্থের উপর নির্ভর করে।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা মৃত্তিকা পানি কি, মৃত্তিকা পানি কাকে বলে, মৃত্তিকা পানির ভূমিকা, মৃত্তিকা পানির গুরুত্ব, মৃত্তিকা পানির শ্রেনিবিভাগ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
মাটিতে দুই প্রকার রন্ধ্র থাকে- সূক্ষ্ম রন্ধ্র ও স্থুল রন্ধ্র। মাটির রন্ধ্র পরিসরে যে পানি থাকে তাকে মৃত্তিকা পানি বলে। পানি একটি সার্বজনীন দ্রাবক যাতে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। পানি মাটি থেকে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের বাহক হিসেবে কাজ করে। মৃত্তিকা পানি প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়: মহাকর্ষীয় পানি, কৈশিক পানি ও জলাকর্ষী বা আদ্রিক পানি। কৈশিক পানি গাছের গ্রহণ উপযোগী পানি।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]