বার্লির অপর নাম যব। এদেশে বার্লির চাষ দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আসছে। সধারণত চরাঞ্চলে অনুর্বর জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এর চাষ করা হয়।
বালি কিছুটা লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। বার্লি দিয়ে শিশু খাদ্য, ওভালটিন, হরলিক্স প্রভৃতি সুস্বাদু খাদ্য তৈরি হয়। পুষ্টি মানের দিক থেকে বার্লি গমের চেয়ে উন্নত।
সাল ২০১০ এ বাংলাদেশে মোট বার্লি জমির পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় পৌনে ৬ হাজার মে. টন।
আমারা আজকের এই আলোচনাটির মাধ্যমে যব বা বার্লির জাত এবং যব বা বার্লি চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
(১) যব বা বার্লির জাত পরিচিতি
ক) বারি বার্লি-১
জাতের নাম: বারি বার্লি-১।
ভূমিকা: ১৯৮৮ সালে সিমিট থেকে এ জাতটি বাংলাদেশে আনা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে বারি বার্লি-১ নামে এ জাত অনুমোদন করা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- এ জাতের উচ্চতা মাঝারী (৮৫-৯০ সেমি)।
- পাতার রং গাঢ় সবুজ ও কাণ্ড শক্ত।
- বীজ, শীষে ৬ সারিতে অবস্থান করে।
- দানা খোসাযুক্ত। দানার রং সোনালী। হাজার দানার ওজন ৩৬-৩৮ গ্রাম।
- এ দেশের আবহাওয়ায় এর জীবন কাল ১০৮-১১২ দিন।
বিশেষ গুণ: গাছ সহজে নুয়ে পড়ে না। এবং এ জাতটিতে রোগ ও পোকার আক্রমণ খুব কম।
ফলন: সেচ ছাড়া চাষ করলেও হেক্টরপ্রতি ২.০-২.৫ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে একটি সেচ প্রয়োগে ফলন বৃদ্ধি পায়।
খ) বারি বার্লি-২
জাতের নাম: বারি বার্লি-২।
ভূমিকা: বারি বার্লি-২ জাতটি ১৯৯৪ সালে অনুমোদিত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- এ জাতের গাছ মাঝারী উচ্চতা সম্পন্ন।
- এ জাতটির হাজার বীজের ওজন ৩৫-৩৮ গ্রাম।
- দানাতে ১২-১৪% আমিষ থাকে।
বিশেষ গুণ: কাও শক্ত, ফলে সহজে হেলে পড়ে না। এবং জাতটি গোড়া পচা ও কলসানো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
ফলন: বারি বার্ণি-২ সেচবিহীন চাষে হেক্টরপ্রতি ২.০-২.৫ টন এবং একটি সেচসহ চাষে ২.৫-৩.০ টন ফলন পাওয়া যায়।
গ) বারি বার্লি-৩
জাতের নাম: বারি বার্লি-৩।
ভূমিকা: জাতটি ২০০১ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- গাছ খাট প্রকৃতির ৭৫-৮৫ সেমি।
- পাতা মোমযুক্ত ৬ সারি, খোসামুক্ত দানা, শীর্ষ ১০-১২ সেমি লম্বা।
- হাজার দানার ওজন ৩৪-৩৬ গ্রাম।
- দানা বড়, ৯৫-১০০ দিনে ফসল পরিপক্ক হয়।
বিশেষ গুণ: রোগবালাই কম।
ফলন: গড় ফলন ২.২০ -২.৫০ টন/হেক্টর।
ঘ) বারি বার্লি-৪
জাতের নাম: বারি বার্লি-৪।
ভূমিকা: জাতটি ২০০১ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- বারি বার্লি-৪ এর ফদ দানা লবণাক্ত এলাকায় গাছের উচচতা ১০০-১১০ সেমি, ৬ সারি খোসাযুক্ত দানা।
- শীর্ষ ৮- ১০ সেমি।
- হাজার দানার ওজন ৩৫-৩৮ গ্রাম।
- রোগবালাই কম, দানা পরিপুষ্ট ও সোনালী বর্ণের, ৯৫-১০০ দিনে ফসল পরিপক্ক হয়।
বিশেষ গুণ: লবণাক্ততা সহনশীল।
ফলন: গড় ফলন ১.৭৫-২.০০ টন/হেক্টর।
ঙ) বারি বার্লি-৫
জাতের নাম: বারি বার্লি-৫
ভূমিকা: বারি বার্লি-১ ও বেল-৪ এর মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতটি ২০০৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- গাছের উচচতা ৯৫-১০০ সেমি।
- পাতার রং সবুজ।
- বীজের রং বাদামী, বীজ ৬ সারি বিশিষ্ট।
- শীষ ১০-১২ বারি বার্লি-৫ এর ফল শীলানা সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়।
- প্রতি শীষে ৬০-৬৫টি দানা থাকে।
- বীজ খোসাযুক্ত।
- জীবন কাল ৯৫-৯৮ দিন।
- হাজার দানার ওজন ৩৬-৩৮ গ্রাম।
বিশেষ গুণ: আগাম পরিপক্কতা বিশিষ্ট।
চাষ উপযোগী অঞ্চল: এটি বাংলাদেশের কম উর্বর, খড়া পিড়ীত ও চর অঞ্চলে চাষ উপযোগী।
ফলন: উপযুক্ত পরিবেশে গড় ফলন ২.৫০-৩.০০ টন/হেক্টর।
চ) বারি বার্লি-৬
জাতের নাম: বারি বার্লি-৬।
ভূমিকা: জাতটি ২০০৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়। বারি বার্লি-১ এবং ই-৬ এর মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত।
বিশিষ্ট্য:
- গাছের উচচতা ৮৫-৯০ সেমি।
- পাতার রং সবুজ।
- শীঘ্র ১০-১২ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়।
- বীজ ও সারি বিশিষ্ট এবং খোসামুক্ত।
- প্রতিটি শীর্ষে ৪৮-৬৫ টি বীজ থাকে।
- জীবন কাল ১৮-১০২ দিন।
- হাজার দানার ওজন ৩৫-৩৮ গ্রাম।
- বীজের রং বাদামী।
- রোগবালাই কম, দানা বড় ও সোনালী বর্ণের।
বিশেষ গুণ: শক্ত কাণ্ড বিশিষ্ট, নুয়ে পড়ে না।
চাষ উপযোগী এলাকা: এটি বাংলাদেশের কম উর্বর, খড়া পিড়ীত ও চর অঞ্চলে চাষ উপযোগী।
ফলন: উপযুক্ত পরিবেশে গড় ফলন ২.৫০-২.৭৫ টন/হেক্টর। লবণাক্ত এলাকায় গড় ফলন ২-২.২০ টন/হেক্টর।
(২) যব বা বার্লি চাষের পদ্ধতি
ক) মাটি
পানি জমে না এমন বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি বার্লি চাষের জন্য উপযুক্ত। জমিতে ‘জো’ আসার পর মাটির প্রকারভেদে ৩-৪ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করাতে হয়।
খ) বপনের সময়
মধ্য-কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।
গ) বীজের হার
বার্লি ছিটিয়ে ও সারিতে বপন করা যায়। ছিটিয়ে হেক্টরপ্রতি ১২০ কেজি এবং সারিতে বুনলে ১০০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। সারিতে বুনলে ২ সারির মাঝে দূরত্ব ২০-২৫ সেমি রাখতে হবে। লাঙ্গল দিয়ে ৩.৫ সেমি গভীর নালা টেনে তাতে বীজ বুনে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
ঘ) আগাছা দমন
চারা গজানোর পর ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ৮-১০ সেমি দূরত্বে একটি চারা রেখে বাকি চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে।
ঙ) সারের পরিমাণ
সাধারণত অনুর্বর জমিতে চাষ করা হলেও সুপারিশমত সার প্রয়োগে এর ফলন বাড়ানো যায়।
বার্ণির জমিতে নিম্নরূপ হারে সারে প্রয়োগ করা যায়।
সারের নাম | সারের পরিমাণ |
ইউরিয়া | ১৭০-১৮৫ কেজি/হেক্টর |
টিএসপি | ১১৫-১২৫ কেজি/হেক্টর |
এমপি | ৭৫-৮৫ কেজি/হেক্টর |
চ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সেচের ব্যবস্থা থাকলে শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু টিএসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ২ কিস্তিতে বীজ বপনের ৩০- ৩৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ বপনের ৫৫-৬০ দিন পর (সেচের পর) প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) পানি সেচ
রবি মৌসুমে খরা দেখা দিলে ১-২ টি হালকা সেচের ব্যবস্থা করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।
জ) ফসল সংগ্রহ
শীর্ষ খড়ের রং এবং পাতা বাদামি হয়ে এলে বুঝা যাবে ফসল পেকেছে। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য-সপ্তাহ।
(৩) বার্লি বা যব চাষে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
ক) বার্লির পাতা ঝলসানো রোগ দমন
ড্রেক্সলেরা প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগটি ঘটে।
সবুজ পাতায় ঈষৎ বাদামি রঙের ছোট ছোট ডিম্বাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীকালে এ সকল দাগ বাড়তে থাকে ও গাঢ় বাদামী থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে। দাগ একত্রিত হয়ে সমস্ত পাতা বাদামী বর্ণ ধারণ করে এবং কলসানোর লক্ষণ দেখা যায়।
ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বায়ুর অধিক আর্দ্রতা ও ২৫° সে. তাপমাত্রা এ রোগ বিস্তারের জন্য সহায়ক।
প্রতিকার:
- গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- টিস্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১ মিলি ঔষধ আড়াই লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
খ) বার্লির গোড়া পচা রোগ দমন
স্কেলেরোসিয়াম রলফসি নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ জীবণু প্রায় সকল ক্ষেত্রে মাটির নিকটবর্তী কাণ্ড ও মূলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে।
প্রথমে গাছের গোড়ায় হলদে দাগ দেখা যায়, পরে দাগ গাঢ় বাদামি হয়ে আক্রান্ত স্থানের চারদিক ঘিরে ফেলে, ফলে গাছ শুকিয়ে মরে যায়। অকে সময় গাছের গোড়ায় ও মাটিতে সরিষার দানার মত মাদামি থেকে কালো রঙের স্কেলেরোসিয়া গুটি দেখা যায়।
রোগের জীবাণু মাটিতে বা ফসলের পরিত্যক্ত অংশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং বৃষ্টি ও সেচের পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। আর্দ্রতাপূর্ণ মাটি রোগ দ্রুত বিস্তারের জন্য সহায়ক।
প্রতিকার:
- সব সময় মাটিতে পরিমিত আর্দ্রতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
- ভিটাভেক্স-২০০ (প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম) মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই ও বিডব্লিউএমআরআই]