শস্য পর্যায় একটি উন্নত কৃষি প্রযুক্তি। এর দ্বারা মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ফসল ভালো হয়, অধিক ফলন হয় রোগ-পোকা কম হয় এবং সারের কার্যকারিতা ভালো হয়। প্রযুক্তি হিসেবে শস্য পর্যায়ের ব্যবহার সব দেশেই প্রচলিত।
(১) শস্য পর্যায় কী?
মাটির উর্বরতা বজায় রেখে এক খণ্ড জমিতে শস্য ঋতুর বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ফসল উৎপাদন করার নাম শস্য পর্যায়।
অর্থাৎ একই ধরনের ফসল একই জমিতে বার বার উৎপাদন না করে অন্য জাতের ফসল উৎপাদন করাই হচ্ছে শস্য পর্যায়।
যেমন- গভীরমূলী কমল উৎপাদনের পর অগভীরমূলী জাতীয় ফসলের আবাদ করা উচিত। ফলে পোকান্ডমাকড় ও রোগ-পোকার উপদ্রব কম হয় এবং মাটির বিভিন্ন গভীরতা থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণ সম্ভব হয়।
কৃষক শস্য পর্যায় প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য কৃষক তার সমগ্র জমিকে তিন বা চার খণ্ডে ভাগ করেন।
প্রথম বছর খণ্ডগুলোতে রবি, খরিপ-১, খরিপ-২ মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ফসল ফলানো হয়।
প্রথম বছর, শেষ হলে দ্বিতীয় বছরে প্রথম খণ্ডের ফসল দ্বিতীয় খণ্ডে, দ্বিতীয় খণ্ডের ফসল তৃতীয় খণ্ডে, এভাবে শেষ খণ্ডের ফলল প্রথম খণ্ডে চাষ করা হয়।
দ্বিতীয় বছরের পরে, তৃতীয় বছরে একইভাবে বিভিন্ন ফসলের খণ্ড পরিবর্তন হয়।
তৃতীয় বছরে, শস্যের আবর্তন শেষ হয় এবং প্রত্যেক ফসলই প্ৰতি খণ্ডে একবার করে চাষ করা হয়।
শস্য পর্যায়ের জন্য এমন ফসল নির্বাচন করতে হবে যাতে নিচে উল্লিখিত বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়-
- পর পর একই ফসলের চাষ না করা;
- একই শিকড় বিশিষ্ট ফসলের চাষ না করা;
- ফসলের পুষ্টি চাহিদার কম-বেশি অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করা;
- ফসলের তালিকায় ডাল ফসল অর্ন্তভুক্ত করা;
- সবুজ সার যেমন- ধৈঞ্চা চাষ করা;
- গবাদি পশুর খাবারের জন্য ঘাসের চাষ করা;
- খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসলের চাষ করা।
(২) শস্য পর্যায় এর উপকারিতা
শস্য পর্যায়ের অনেক সুবিধা লক্ষ করা যায়। সুবিধাগুলো নিচে দেওয়া হলো-
- শস্য পর্যায়ের প্রযুক্তি ব্যবহারে মাটির উর্বরতা সংরক্ষিত হয়;
- মাটির পুষ্টির সমতা বজায় থাকে;
- আগাছার উপদ্রব কম হয়;
- রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হয়;
- পানির অপচয় কম হয়;
- ফসলের ফলন বাড়ে;
- গবাদি পশুর খাবারের ব্যবস্থা হয়;
- উচ্চ মাত্রায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রযুক্তি গ্রহণ করা যায়;
- বালাই নাশক (আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিয়ানাশক, কীটনাশক ) ব্যবহার কমায়;
- গাছ পরিমিত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে;
- মাটিতে নাইট্রোজেন যুক্ত হয়।
(৩) শস্য পর্যায়ের ব্যবহার
পূর্বই আমরা শস্য পর্যায়ের ধারণা পেয়েছি। আমাদের কৃষক জেনে অথবা না জেনে শস্য পর্যায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি হয়ত তারা দিতে পারবেন না। কিন্তু এতটুকু জ্ঞান তাদের আছে যে, একই ফসল একই জমিতে বছরের পর বছর চাষ করলে ফলন কম হয়। মাটির উর্বরতা কমে যায়। পোকান্ডমাকড় ও রোগসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।
কৃষকেরা তাদের জমিতে যত ফসল ফলান সেগুলোকে রবি, খরিপ-১, খরিপ-২ এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন কাজেই কৃষক, প্রথমত: মৌসুম অনুযায়ী কী ফসল চাষ করবেন তা নির্ধারণ করেন। দ্বিতীয়ত: কোন জমিতে কী ফসল ফলাবেন তাও নির্ধারণ করেন।
শস্য পর্যায়ের বিধি অনুযায়ী কৃষকের জমিকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করার প্রয়োজন পড়ে। আর গুগুলোর আকার সমান রাখার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের কৃষকদের জমি বিভিন্ন খণ্ডে ভাগ হয়ে আছে যা আকারে সমান নাও হতে পারে। কৃষকদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই তারা জমি ও ফসল নির্বাচন করেন।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার প্রায় সব এলাকা এবং দিনাজপুরের উত্তর-পশ্চিম অংশ কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১ এর অন্তর্ভুক্ত। এখানে উঁচু, মাঝারি উঁচু, মাঝারি নিচু জমি আছে। এখানকার কৃষক গম, পাট অথবা বোনা আউশ, কাউন, রোপা আমন, আলু, শাকসবজি, মুগডাল, আখ, মরিচ, বোরো, ভুট্টা ইত্যাদি ফসল চাষ করেন।
কৃষকেরা বৃষ্টিপাত নির্ভর ফসল ফলান আবার সেচ নির্ভর ফসলও ফলান। এখানকার কৃষক কী কী শস্য পর্যায় ব্যবহার করেন তা দেখলে আমরা কৃষকের শস্য পর্যায় ব্যবহারের একটা বাস্তব চিত্র পাব।
মনে করি, ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো কৃষকের চার খণ্ড জমি আছে। তিনি চার বছরের শস্য পর্যায়ের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি রবি, খরিপ-১ এবং খরিপ-২ মৌসুমভিত্তিক গম, পাট/আউশ, রোপা আমন, আলু, শাকসবজি, ধৈঞ্চা, আখ, মরিচ, তিল ইত্যাদি ফসল ফলাবেন।
এগুলো ফলানোর জন্য কৃষক বছরভিত্তিক নিম্নোক্ত শস্য পর্যায় গ্রহণ করতে পারেন। শস্য পর্যায়ক্রমে দেখা যায় যে প্রথম বছরে যেভাবে ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছিল চতুর্থ বছরে আবার সেভাবেই শেষ হচ্ছে।
সময় | খন্ড-১ | খন্ড-২ | খন্ড-৩ | খন্ড-৪ |
১ম বছর | রবি: বোরো খরিপ-১: পাট/বোনা আউশ খরিপ-২: পতিত | রবি: সরিষা/গম খরিপ-১: মুগ খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: গোল আলু খরিপ-১: মাষকলাই খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, টমেটো খরিপ-১: ভুট্টা খরিপ-২: বেগুন |
২য় বছর | রবি: ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, টমেটো খরিপ-১: ভুট্টা খরিপ-২: বেগুন | রবি: গোল আলু খরিপ-১: মাষকলাই খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: সরিষা/গম খরিপ-১: মুগ খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: বোরো খরিপ-১: পাট/বোনা আউশ খরিপ-২: পতিত |
৩য় বছর | রবি: গোল আলু খরিপ-১: মাষকলাই খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, টমেটো খরিপ-১: ভুট্টা খরিপ-২: বেগুন | রবি: বোরো খরিপ-১: পাট/বোনা আউশ খরিপ-২: পতিত | রবি: সরিষা/গম খরিপ-১: মুগ খরিপ-২: রোপা আমন |
৪র্থ বছর | রবি: বোরো খরিপ-১: পাট, বোনা আউশ খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: সরিষা/গম খরিপ-১: মুগ খরিপ-২: পতিত | রবি: গোল আলু খরিপ-১: মাষকলাই খরিপ-২: রোপা আমন | রবি: ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, টমেটো খরিপ-১: ভুট্টা খরিপ-২: বেগুন |
[সূত্র: এনসিটিবি]