স্ট্রবেরি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। মৃদু শীত প্রধান দেশে এটি স্বল্প মেয়াদী ফল হিসেবে চাষ হয়।
আকর্ষণীয় রং, গন্ধ ও উচ্চ পুষ্টিমানের জন্য স্ট্রবেরি অত্যন্ত সমাদৃত।
এতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান।
ফল হিসেবে সরাসরি খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বৃদ্ধিতেও স্ট্রবেরি ব্যবহৃত হয়।
(১) স্ট্রবেরির জাত পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
ক) বারি স্ট্রবেরি-১
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি স্ট্রবেরি-১’
নামে একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতটি ২০০৮ সালে অবমুক্ত
করা হয়।
- বাংলাদেশে সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছের গড় উচ্চতা ৩০ সেমি এবং বিস্তার ৪৫-৫০ সেমি।
- নভেম্বরের মাঝামাঝী সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বার থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- গাছপ্রতি গড়ে ৩২টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন।
- হৃৎপিন্ডাকৃতির ফল ক্ষুদ্র থেকে মধ্যম আকারের যার গড় ওজন ১৪ গ্রাম।
- পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল বর্ণের।
- ফলের ত্বক নরম ও ঈষৎ খসখসে।
- ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য।
- স্ট্রবেরির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি (টিএসএস-১২%)।
- জাতটি পর্যাপ্ত সরু লতা ও চারা উৎপাদন করে বিধায় এর বংশ বিস্তার সহজ।
খ) বারি স্ট্রবেরি-২
- বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী একাট উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছপ্রতি গড়ে ৩৭টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৭৪১ গ্রাম।
- ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য।
- মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়।
- ফল দেখতে আকর্ষণীয় গাঢ় লাল রঙের, তুলনামূলক দৃঢ়, আকারে বেশ বড়, প্রান্তভাগ চ্যাপ্টা, রসালো, সুগন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি (টিএসএস ৮%)।
- ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি’ বিদ্যমান (৭৬ মি. গ্রা./১০০ গ্রাম)।
- ফল ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
- জাতটি পর্যাপ্ত সরুলতা (রানার) ও চারা উৎপাদন করে বিধায় এর বংশবিস্তার সহজ।
গ) বারি স্ট্রবেরি-৩
- বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছ প্রতি গড়ে ৩৯ টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৭৭০ গ্রাম।
- ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য।
- ফল দেখতে আকর্ষণীয় লাল রঙের, লম্বা মোচাকৃতি, আকারে বেশ বড়, ফল তুলানামূলক দৃঢ়, প্রান্তভাগ সরু, রসালো, সুগন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি।
- ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি’ বিদ্যমান (৭২ মি. গ্রা./১০০ গ্রাম)।
- ফল ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
- জাতটি পর্যাপ্ত সরু লতা (রানার) ও চারা উৎপাদন করে বিধায় এর বংশ বিস্তার সহজ।
(২) স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি ও গাছের পরিচর্যা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
স্ট্রবেরি মূলত মৃদু শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল। কিন্তু গ্রীষ্মায়িত জাত কিছুটা তাপ সহিষ্ণু। দিন ও রাতে যথাক্রমে ২০-২৬০ ও ১২-১৬০ সে. তাপমাত্রা গ্রীষ্মায়িত জাতসমূহের জন্য প্রয়োজন।
ফুল ও ফল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় রবি মৌসুম স্ট্রবেরি চাষের উপযোগী।
বৃষ্টির পানি জমে না এ ধরনের ঊর্বর দোআঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটি স্ট্রবেরি চাষের জন্য উত্তম।
খ) চারা উৎপাদন
- স্ট্রবেরি রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে।
- উক্ত গাছ হতে উৎপন্ন রানারে যখন শিকড় বের হবে তখন তা কেটে ৫০ ভাগ গোবর ও ৫০ ভাগ পলিমাটিযুক্ত পলিথিন ব্যাগে লাগাতে হবে এবং হালকা ছায়াযুক্ত নার্সারিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
- অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত হতে চারাকে রক্ষার জন্য বৃষ্টির মৌসুমে চারার উপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে।
- রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। তাইজাতের ফলন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করা উত্তম।
গ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ
- স্ট্রবেরি উৎপাদনের জন্য কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে উত্তমরূপে জমি তৈরি করতে হবে।
- চারা রোপণের জন্য বেড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এ জন্য ১ মিটার প্রশস্ত এবং ১৫-২০ সেমি উঁচু বেড তৈরি করতে হবে।
- দুটি বেডের মাঝে ৪০-৫০ সেমি নালা রাখতে হবে। প্রতি বেডে ৫০-৬০ সেমি দূরত্বে দুই সারিতে ৩০-৪০ সেমি দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
- বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আশ্বিন মাস (মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য-অক্টোবর) স্ট্রবেরির চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়।
ঘ) সার প্রয়োগ
গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চফলন পেতে হলে স্ট্রবেরির জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নলিখিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | হেক্টরপ্রতি পরিমাণ |
পচা গোবর | ৩০ (টন) |
ইউরিয়া | ২৫০ (কেজি) |
টিএসপি | ২০০ (কেজি) |
এমওপি | ২২০ (কেজি) |
জিপসাম | ১৫০ (কেজি) |
প্রয়োগ পদ্ধতি:
শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম ও অর্ধেক পরিমাণ এমওপি সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া ও অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১৫-২০ দিন অন্তর ৪-৫ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) সেচ ও নিষ্কাশন
জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে প্রয়োজন মতো পানি সেচ দিতে হবে। স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- সরাসরি মাটির সংস্পর্শে এলে স্ট্রবেরির ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরির বেড খড় বা কাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- খড়ে যাতে উঁই পোকার আক্রমণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ মিলি ডার্সবান-২০ ইসি ও ২ গ্রাম অটোস্টিন ডিএফ মিশিয়ে ঐ দ্রবণে খড় শোধন করে নিলে তাতে উঁই পোকার আক্রমণ হয় না এবং দীর্ঘ দিন তা অবিকৃত থাকে।
- জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
- গাছের গোড়া হতে নিয়মিতভাবে রানার বের হয়। উক্ত রানারসমূহ ১০/১৫ দিন পর পর কেটে ফেলতে হবে। রানার কেটে না ফেললে গাছের উৎপাদন হ্রাস পায়।
ছ) ফল সংগ্রহ
- ভাদ্র মাসের মাঝামাঝী (অক্টোবরের শুরু) সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে।
- ফল পেকে লাল বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করতে হয়।
- স্ট্রবেরির সংরক্ষণ কাল খুবই কম বিধায় ফল সংগ্রহের পর পরই তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে।
- ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে।
- স্ট্রবেরির সংরক্ষণ গুণ ও পরিবহন সহিষ্ণুতা কম হওয়ায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এর চাষ করা উত্তম।
- হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ হাজার চারা রোপণ করা যায়। প্রতি গাছে ২৫০-৩০০ গ্রাম হিসেবে ‘বারি স্ট্রবেরি-১’ এর ফলন হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন।
জ) মাতৃ গাছ রক্ষণাবেক্ষণ
স্ট্রবেরি গাছ প্রখর সৌর-তাপ এবং ভারী বর্ষণ সহ্য করতে পারে না। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ফল আহরণের পর মাতৃ গাছ তুলে টবে রোপণ করে ছায়ায় রাখতে হবে।
ফল আহরণ শেষ হওয়ার পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃ গাছকে খরতাপ ও ভারী বর্ষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা য়ায়। মাতৃ গাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
(৩) স্ট্রবেরি গাছের রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
ক) পাতায় দাগ পড়া রোগ
কোন কোন সময় ছত্রাকজনিত রোগের পাতায় বাদামী রঙের দাগ পরিলক্ষিত
হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে ফলন এবং ফলের গুণগত মান হ্রাস পায়।
প্রতিকার: সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করে সুফল পাওয়া যায়।
খ) ফল পচা রোগ
এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামী বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
প্রতিকার: ফল পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে নোইন ৫০ ডব্লিওপি অথবা অটোস্টিন নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গ) ভারটিসিলাম উইল্ট রোগ
এ রোগে আক্রান্ত গাছ হঠাৎ করে দুর্বল ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ বাদামী বর্ণ ধারণ করে এবং মারা যায়। সাধারণত জলাবদ্ধতাসম্পন্ন জমিতে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়।
প্রতিকার: জমি শুষ্ক রাখতে হবে। পলিথিন মাল্চ ব্যবহার করলে তা তুলে ফেলতে হবে। কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমনবর্দোমিক্সার (১ঃ১ঃ১০) ৮-১০ দিন পরপর ২-৩ বার গাছের গোড়া ও মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ঘ) পাখি
বুলবুলি পাখি স্ট্রবেরির সবচেয়ে বড় শত্রু। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়।
প্রতিকার: ফল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দ্বারা ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল খেতে না পারে।
ঙ) ভাইরাস
ভাইরাস রোগের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা এবং গুণগত মান হ্রাস পেতে থাকে। সাদা মাছি এ ভাইরাস রোগ ছড়ায়।
প্রতিকার: এডমায়ার ২০০ এসএল নামক কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ০.২৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করে সাদা মাছি দমন করলে ভাইরাস রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
চ) মাইট
মাইটের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ও গুণগত মান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এদের আক্রমণে পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে ও পুরু হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে কুচকে যায়। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
প্রতিকার: ভারটিমেক ১৮ ইসি নামক মাকড়নাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]