মসলা হিসেবে হলুদ বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। মসলা ছাড়াও আচার-অনুষ্ঠানে ও ঔষধি গুণাগুণ হিসেবে হলুদের ব্যবহার ব্যাপক।
হলুদ উৎপাদনে বারি উদ্ভাবিত হলুদের উন্নত/ আধুনিক পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ করে বাড়িয়ে হলুদের ঘাটতি পূরণ ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।
(১) হলুদের জাতের নাম, পরিচিতি ও তাদের বৈশিষ্ট্য
ক) বারি হলুদ-১ (ডিমলা)
- স্থানীয় জাতের তুলনায় ডিমলার ফলন প্রায় ৩ গুন।
- গাছের উচ্চতা প্রায় ১০৫-১২০ সেমি।
- বপনের ৩০০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
- হলুদের ছড়া চওড়া, হেক্টরপ্রতি ফলন ১৭-১৮ টন।
- প্রতি ৮ কেজি শুকনো হলুদ পেতে ৪০ কেজি কাঁচা হলুদের প্রয়োজন হয় (১:৫)।
- এ জাত লিফ ব্লাইট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
খ) বারি হলুদ-২ (সিন্দুরী)
- স্থানীয় জাতের তুলনায় ফলন দ্বিগুন।
- গাছের উচ্চতা ৬০-৭০ সেমি।
- বপনের পর থেকে প্রায় ২৭০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
- হলুদের ছড়ার আকার মাঝারী।
- শাঁস আকর্ষণীয় গাঢ় হলুদ।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-১৩ টন।
- প্রতি ১০ কেজি শুকনো হলুদ তৈরিতে ৪০ কেজি কাঁচা হলুদ প্রয়োজন হয় (১:৪)।
- এ জাত লিফ ব্লাইট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
গ) বারি হলুদ-৩
এ জাতটি ২০০৩ সালে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবমুক্ত হয়।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা গড়ে প্রায় ১১০-১২৫ সেমি।
- প্রতি গাছে মোথার ওজন প্রায় ১৫০-১৮০ গ্রাম এবং প্রতি গাছে হলুদের ওজন প্রায় ৭০০-৮০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
- রং গাঢ় হলুদ।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন।
- শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ শতকরা ১৪-১৫%।
ঘ) বারি হলুদ-৪
- গাছের উচ্চতা ১১০-১২০ সেমি।
- পাতার সংখ্যা ২২-২৮ টি, পাতা ৫০-৫২ সে.মি. লম্বা।
- পাতার রং হালকা সবুজ।
- প্রতি গোছায় গাছের সংখ্যা ৩-৫টি।
- প্রতি গোছায় মোথার সংখ্যা ৩-৫ টি (৫৫-৬০ গ্রাম), ছড়ার (ফিংগার) সংখ্যা ২২-২৫ টি (৪৫০-৫৫০ গ্রাম), ছড়া (ফিংগার) ৯.০-৯.৫ সেমি লম্বা এবং ২.৫-৩.০ সেমি চওড়া।
- অন্তর রং (Core color) কমলা হলুদ (Orange Yellow) এবং শুষ্ক পদার্থের (Dry matter) পরিমাণ শতকরা ২০-২২ ভাগ।
- জাতটির হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ২৮-৩০ টন।
ঙ) বারি হলুদ-৫
- গাছের উচ্চতা ১২০-১৩৫ সেমি ও পাতার সংখ্যা ২৪-৩০টি।
- পাতা ৬২-৬৫ সেমি লম্বা এবং ১৮-২০ সেমি চওড়া।
- পাতার রং হালকা সবুজ।
- প্রতি গোছায় গাছের সংখ্যা ৪-৬টি।
- প্রতি গোছায় মোথার সংখ্যা ৩-৪ টি (৩০-৪০ গ্রাম), ছড়ার (ফিংগার) সংখ্যা ২০-২২ টি (২৫০-৩০০ গ্রাম), ছড়া (ফিংগার) ৯.০-১০.০ সেমি লম্বা এবং ২.০-২.৫ সেমি চওড়া।
- অন্তর রং (Core color) গাঢ় কমলা হলুদ (Deep Orange Yellow) এবং শুষ্ক পদার্থের (Dry matter) পরিমাণ শতকরা ২৬-৩০ ভাগ।
- জাতটির হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ১৮-২০ টন।
(২) বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ এর উৎপাদন কৌশল/হলুদ চাষ পদ্ধতি
ক) চাষের মৌসুম
খরিফ-১ মৌসুমে ‘বারি হলুদ-৪’ ও ‘বারি হলুদ-৫’ রোপণ করা হয়। সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের ১ম সপ্তাহ (বৈশাখের ১ম থেকে ৩য় সপ্তাহ) হলুদ লাগানোর উপযুক্ত সময়। উভয় জাতই রোপণ করার ৯-১০ মাস পর উত্তোলন করা যায়।
খ) বংশ বিস্তার
রূপান্তরিত কান্ড অর্থাৎ রাইজোম (কন্দ) দ্বারা হলুদের বংশ বৃদ্ধি হয়। মাতৃকন্দ ও পার্শ্বকন্দ (ফিংগার) বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
পরিপুষ্ট, সুস্থ, চকচকে ও রোগবালাই মুক্ত কন্দ নির্বাচন করতে হবে। অপর দিকে অন্যান্য হলুদ জাতের মত মাতৃকন্দের স্বল্পতায় সেকেন্ডারী ফিংগার ও বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ) বীজ হার
বারি হলুদ-৪ এর ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ২.৫-৩.০ টন কন্দের (রাইজোম) প্রয়োজন হয়। প্রায় ৪০-৪৫ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট কন্দ (রাইজোম) থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
অপর দিকে বারি হলুদ-৫ এর ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১.৫-২.০ টন কন্দ (রাইজোম) প্রয়োজন এবং কন্দের (রাইজোম) ওজন প্রায় ২৫-৩৫ গ্রাম হওয়া বাঞ্চনীয়।
ঘ) বীজ শোধন
বীজ বাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বীজ শোধন পূর্বশর্ত। হলুদের বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করা যায়।
সেক্ষেত্রে রোপণের ৬-৮ ঘণ্টা আগে অটোস্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে হলুদ ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, তারপর পানি থেকে রাইজোম তুলে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
ঙ) মাটি শোধন
ভাল ফলন পেতে হলে বীজ ও মাটি বাহিত রোগ থেকে হলুদ ফসলকে মুক্ত রাখার জন্য মাটি শোধন করা আবশ্যক।
শেষ চাষের আগে ফুরাডান বা কুরাটার ৫ কেজি হেক্টর হারে প্রতি ২৫-৩০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
চ) শষ্য পর্যায়
বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ এর ভাল ফলন পেতে হলে শষ্য পর্যায় অবলম্বন করা আবশ্যক। পূর্ববর্তী ফসল আদা ও হলুদ জমিতে লাগালে পরের বছর সেই জমিতে হলুদ চাষ করা ঠিক নয়।
তাছাড়া আলু বা অন্যান্য কন্দ জাতীয় ফসল মুক্ত জমি হলুদ চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
ছ) জমি তৈরি
মাটি গভীরভাবে কর্ষণ করে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। মাটি যাতে ঝুরঝুরে হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আগাছা, ও অন্যান্যা বর্জ্য পদার্থ জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। মাটির বড় বড় ঢিলা ভেঙ্গে ছোট করতে হবে। সর্বোপরি ভালভাবে মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে।
জ) রোপণ পদ্ধতি ও দূরত্ব
সাধারণত ২ টি পদ্ধতিতে হলুদ রোপণ করা যায়। একটি হলো বেড পদ্ধতি (Bed Method) অপরটি নালা পদ্ধতি (Ridge Method)।
- প্রথম পদ্ধতিতে (Bed Method) জমি প্রস্তুত হবার পর ১.২-১.৮ মি প্রস্থ ও ২৫-৩০ সেমি উচ্চতায় সুবিধাজনক দৈর্ঘ্যে বেড তৈরি করতে হবে।
- পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝে ৬০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
- এই পদ্ধতিতে ৬০ সেমি পরপর সারি টেনে সারিতে ২৫ সেমি পরপর ৭-৮ সেমি গভীরে বীজ কন্দ (রাইজোম) রোপণ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- পরবর্তীতে দুই বেডের মাঝের নালা থেকে মটি উঠিয়ে দিতে হবে।
- নালা পদ্ধতিতে উপরোক্ত নিয়মে সারি টেনে বীজ কন্দ রোপণ করে দু’সারির মাঝের মাটি উঠিয়ে বীজ কন্দ ভালভাবে ঢেকে দিতে হবে।
ঝ) সারে পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি নিম্নোক্ত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করা হয়।
তবে মাটির ঊর্বরতার উপর নির্ভর করে বর্ণিত মাত্রা কম বেশি হতে পারে।
সারের নাম | প্রতি মাত্রা/হেক্টর |
গোবর | ৫ টন |
ইউরিয়া | ২২০ কেজি |
টিএসপি | ১২৫ কেজি |
এমপি | ২৬০ কেজি |
জিপসাম | ১১০ কেজি |
বোরিক এসিড | ১২ কেজি |
জমি পরিষ্কার করে শেষ চাষের সময় বীজ রোপণের ৫-৭ দিন আগে সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বোরিক এসিড, অর্ধেক এমপি সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া সারের অর্ধেক বীজ রোপণের ৫০-৬০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমপি সার সমান দুই কিস্তিতে রোপণের ৮০-৯০ ও ১১০-১২০ দিন পর দ্বিতীয়বার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ঞ) আগাছা দমন
আগাছা জমি থকে খাদ্য, আলোবাতাস ও স্থান দখল করে হলুদ গাছের দুর্বল করে ফেলে। তাছাড়া আগাছা বিভিন্ন রোগ ও পোকান্ডমাকড়ের আবাসস্থল হিসাবে কাজ করে। এতে ফসল সহজেই রোগ ও পোকান্ডমাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় ও ফলন হ্রাস পায়। এজন্য হলুদের জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
জমির অবস্থা বুঝে ৩-৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। সাধারণত আগাছা পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সেক্ষেত্রে রোপণের ৫০-৬০, ৮০-৯০ ও ১১০-১২০ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করলে ফলন ভাল হয়।
ট) গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া
রাইজোমের সঠিক বৃদ্ধি এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য ২-৩ বার হলুদের দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে সারি বরাবর গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এতে করে হলুদের উপর থেকে মাটি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। সাধারণত আগাছা পরিষ্কারের পর পরই গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া হয়।
ঠ) পানিসেচ ও নিষ্কাশন
হলুদ ফসল সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর। তবে মাটি শুষ্ক হলে বীজ রোপণের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। তাছাড়া মাটির ধরন ও আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে ৪-৫টি সেচের দরকার হতে পারে।
হলুদের জমিতে পানি জমে থাকলে সহজেই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। বৃষ্টি পানি যেন কোনভাবেই জমিতে না জমে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। নালা করে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ড) মালচিং
খড় বা লতা-পাতা দিয়ে জমি ঢেকে দেওয়াকে সহজ অর্থে মালচিং বলা হয়। হলুদ রোপণ করার পর মালচিং একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যা।
পরীক্ষণে দেখা গেছে যে, জমিতে রস সংরক্ষণ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও ভূমিক্ষয় রোধের জন্য হেক্টর প্রতি ৮-১০ টন শুকনো পাতা বা খড় দিয়ে হলুদের জমি ঢেকে দিতে হবে। এতে আগাছার পরিমাণও কমে যায়। পরে মালচিং হিসাবে ব্যবহৃত পাতা বা খড় পচে জমিতে জৈব সার তৈরি করে।
ঢ) ফসল সংগ্রহ
- বারি হলুদ-৪ ও ৫ রোপণের ৯-১০ মাস পর গাছের উপরের অংশ হলুদ রং ধারণ করে সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে ফসল সংগ্রহ করা হয়।
- গবেষণায় দেখা গেছে, বীজ হলুদ সংগ্রহের জন্য সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহ উপযুক্ত সময়। এছাড়াও প্রায় এক মাস আগে অবীজ বা খাওয়ার জন্য (Fresh consumption) রাইজোম উত্তোলন করা যেতে পারে।
- কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি আলগা করে নিতে হয়। এরপর রাইজোম সংগ্রহ করে শিকড় কেটে মাটি পরিষ্কার করা হয়। হলুদ উত্তোলনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন রাইজোম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ণ) কিউরিং
হলুদের রাইজোম পরিষ্কার করার পর মোথা ও ছড়া পৃথক করতে হবে। সংগ্রহকৃত রাইজোম ছায়াযুক্ত পরিষ্কার স্থানে গাদা করে রাখা হয়। একে কিউরিং বলে।
২-৩ দিন হলুদের কিউরিং করা হয়। কিউরিং শেষ হলে বীজ হিসাবে সংরক্ষণ বা খাওয়ার জন্য সিদ্ধ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।
ত) সংরক্ষণ
- হলুদ সংরক্ষণের জন্য সতেজ ও রোগমুক্ত রাইজোম নির্বাচন করতে হবে।
- গর্ত খনন করে হলুদ রাখলে রাইজোমের আর্দ্রতা ও সতেজতা বজায় থাকে, ফলে বাজার মূল্য সঠিক থাকে। খড় বা ছনের চাল যুক্ত ঘরের মেঝেতে গর্ত করে হলুদ সংরক্ষণ করা হয়।
- ঘরের ভেতর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২৪ ইঞ্চি প্রশস্ত ১৫ ইঞ্চি গভীর ও প্রয়োজন মত লম্বা গর্ত (ট্রেন্চ) করা যেতে পারে। তবে গভীরতা বজায় রেখে যেকোন মাপের গর্ত করা যায়।
- গর্ত বা ট্রেন্চ করার পর ২-৩ দিন খুলে রাখতে হবে যতে মাটির অতিরিক্ত রস বের হয়ে যায়।
- শুকিয়ে অতঃপর গর্তের তলদেশে ২ ইি পুরু করে শুকনো বালি বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর বাছাই করা হলুদ গর্তে ১০ ইঞ্চি পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর হলুদের স্তরের উপর ৩ ইঞ্চি পুরু মাটি বালি দিয়ে পুরো গর্ত ভালভাবে ঢেকে দিতে হবে।
(৩) রোগ ও পোকা আক্রমণ
বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ জাত দুটিতে রোগ ও পোকার প্রাদুর্ভাব নাই বললেই চলে। জাত দুইটি লিফ স্পট ও লিফ ব্লচ রোগ সহনশীল, কদাচিৎ লিফব্লচ রোগের আক্রমণ দেখা যায়, এদের বর্ণনা ও দমন ব্যবস্থা নিম্নরুপ।
ক) লিফব্লচ
Taphrina maculans নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রমণ হয়।
উৎপত্তি ও বিস্তার:
আক্রান্ত রাইজোম ও বায়ুর মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে। গাছের আক্রান্ত শুকনো পাতা যেগুলো জমিতে পড়ে থাকে তার মাধ্যমে জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
সাধারণত অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। যখন আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০% এবং তাপমাত্রা ২১-২৩০ সে. থাকে তখন প্রাথমিক সংক্রমণ শুরু হয়। পরবর্তীতে ঠান্ডা এবং আর্দ্র আবহাওয়া রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়।
ক্ষতির ধরন:
সাধারণত গাছ একটু বড় হলেই এ রোগ দেখা যায়। পাতা আক্রান্ত হওয়ার ফলে অনেক আগেই গাছ শুকিয়ে যায়। গাছ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। ফলে রাইজোমের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পরিশেষে ফলন হ্রাস পায়।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাতার উভয় পৃষ্ঠায় ছোট ছোট গোলাকার বাদামী দাগের উপস্থিতি এবং পাতার উপর পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
- প্রথমে গাছের নিচের দিকের পাতা ফ্যাকাশে হলুদ রং ধারণ করে। পরবর্তীতে দাগগুলো অতিদ্রুত একত্রিত হয়ে সমস্ত পাতা হলুদ করে ফেলে।
- গাছ ঝলসানোর মত মনে হয় এবং ফলন মারাত্মক ভাবে কমে যায়।
দমন ব্যবস্থা:
- রোগ মুক্ত জমি থেকে সংগৃহীত সুস্থ রাইজোম বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত এবং শুকনো পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- বীজ রোপণের আগে ম্যানকোজেব (০.৩%) অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের কোন ছত্রাকনাশক অথবা স্কোর (০.০৫%) এর দ্রবণে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে বীজ হলুদ শোধন করে নিতে হবে।
- রোগ দেখা দেওয়া মাত্রই অটোস্টিন ২ গ্রাম অথবা মেটারিল ২.৫ গ্রাম অথবা ফলিকুর ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ৩-৪ বার সম্পূর্ণ জমির গাছের পাতায় ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পাতার উভয় দিকে ছত্রাকনাশক ভালভাবে লাগে।
খ) রাইজোম রট বা কন্দ পচা
Pythium graminicolum ছত্রাক দ্বারা এই রোগ সৃষ্টি হয়। বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ রাইজোম রট রোগ সহনশীল। যদি কোনভাবে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়, সেক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা নিম্নরূপ।
রোগের লক্ষণ:
- প্রথমে গাছের নিচের পাতা হলুদ হতে শুরু করে এবং এক সময় পুরো গাছের পাতাই হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়।
- কান্ডের গোরায় দিকে পানি ভেজা দাগ দেখা যায় যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত কান্ড ভেঙ্গে যায় যা হাত দিয়ে টান দিলে সহজেই উঠে আসে।
- এই রোগ আস্তে আস্তে মাটির ভিতরের রাইজোমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পচন সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে পুরো রাইজোমে পচন ধরে এবং পচা রাইজোম হতে দুর্গন্ধ বের হয়।
দমন ব্যবস্থা:
- রোগ মুক্ত জমি হতে সংগৃহীত সুস্থ রাইজোম বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
- জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। একই জমিতে দুই বছর অন্তর অন্তর হলুদ চাষ করলে রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
- রোগাক্রান্ত এবং শুকনো পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
- লিফব্লচ রোগে আক্রান্ত হলুদ গাছ সতেজ ও রোগমুক্ত হলুদ গাছ রোগ দেখা দেওয়া মাত্রই অটোস্টিন ১ গ্রাম/লিটার অথবা মেটারিল ২.৫ গ্রাম/লিটার অথবা ফলিকুর ১ মিমি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার সম্পূর্ণ জমির গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে যাতে মাটিও ভিজে যায়।
- বীজ রোপণের আগে ম্যানকোজেব (০.৩%) অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের কোন ছত্রাকনাশক অথবা স্কোর (০.০৫%) এর দ্রবণে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে বীজ হলুদ শোধন করে নিতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]