বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষ হয় না। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হয়ে থাকে। সম্প্রতি রজনীগন্ধা, গোলাপ ও গ্লাডিওলাসের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে বেলি, জুঁই, চামেলি, গন্ধরাজ, অপরাজিতা, শেফালি, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি নানা ধরনের ফুল জন্মে। বাণিজ্যিকভাবে এসব ফুলের চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব।
আমরা এখানে শুধু গোলাপ ও বেলি ফুল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
(১) গোলাপ ফুল চাষ পদ্ধতি
গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয়। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বহুজমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে এবং দিন দিন গোলাপের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গোলাপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
ক) জাত সমূহ
পৃথিবীজুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো।
গোলাপের জাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গোলাপ সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি এবং মিশ্র রঙের হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও-
- রানী এলিজাবেথ (গোলাপি)
- ব্ল্যাক প্রিন্স (কালো)
- ইরানি (গোলাপি)
- মিরিন্ডা (লাল)
- দুই রঙা ফুল আইক্যাচার চাষ করা হয়।
বংশবিস্তার গোলাপের বংশ বিস্তারের জন্য অবস্থাভেদে শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও চোখ কলম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বীজ উৎপাদন করে তা থেকে চারা তৈরি করা হয়।
খ) জমি নির্বাচন
- গোলাপ চাষের জন্য উর্বর দোআঁশ মাটির জমি নির্বাচন করা উত্তম।
- ছায়াবিহীন উঁচু জায়গা যেখানে জলাবদ্ধতা হয় না, এরূপ জমিতে গোলাপ ভালো জন্মে।
- জমি তৈরি নির্বাচিত জমি ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল করতে হবে।
- এরপর মাটি কুপিয়ে ৫ সেমি উঁচু করে ৩ মি x ১ মি আকারের বেড বা কেয়ারি তৈরি করতে হবে।
- এভাবে কেয়ারি তৈরির পর নির্দিষ্ট দূরত্বে ৬০ সেমি x ৬০ সেমি আকারের এবং ৪৫ সেমি গভীর গর্ত খনন করতে হবে।
- গর্তের উপরের মাটি ও নিচের মাটি আলাদা করে রাখতে হবে।
- চারা রোপণের ১৫ দিন আগে গর্ত করে খোলা রাখতে হবে। এ সময়ে গর্ভের জীবাণু ও পোকামাকড় মারা যায়।
গ) সার প্রয়োগ
- প্রতি গর্তের উপরের মাটির সাথে প্রদত্ত সুপারিশ অনুযায়ী সারগুলো মিশিয়ে গর্তে ফেলতে হবে।
- এরপর নিচের মাটির সাথে ৫ কেজি পচা গোবর, ৫ কেজি পাতা পচা সার ও ৫০০ গ্রাম ছাই ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তের উপরের স্তরে দিতে হবে।
- এভাবে গর্ত সম্পূর্ণ ভরাট করার পর ১৫-২০ দিন ফেলে রাখলে সারগুলো পচবে ও গাছ লাগানোর উপযুক্ত হবে। .
- বর্ষাকালে যাতে গাছের গোড়ায় বৃষ্টির পানি জমে না থাকে, সে জন্য নালা তৈরি করতে হবে।
ঘ) চারা বা কলম রোপণ
- আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পৌষ মাস পর্যন্ত চারা লাগালে বেডের গর্তের মাঝখানে ক্ষুদ্রাকৃতির গর্ত খুঁড়ে চারা লাগাতে হয়।
- প্রথমে পলিথিন ব্যাগ বা মাটির টব থেকে চারা বের করে দুর্বল শাখা, রোগাক্রান্ত শিকড় ইত্যাদি কেটে ফেলতে হয়।
- চারা লাগিয়ে গোড়ায় শক্তভাবে মাটি চেপে দিতে হবে।
- চারা রোপণের পর চারাটি একটি খুঁটি পুতে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।
- চারা লাগিয়ে গোড়ায় পানি দেওয়া উচিত। ২-৩ দিন ছায়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।
ঙ) পরিচর্যা
- আগাছা দমন: গোলাপের কেয়ারিতে অনেক আগাছা হয়। আগাছা তুলে ফেলতে হবে।
- পানি সেচ: মাটির আর্দ্রতা যাচাই করে গাছের গোড়ায় এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন মাটিতে রসের ঘাটতি না হয়।
- পানি নিকাশ: গোলাপের কেয়ারিতে কোনো সময়ই পানি জমতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ গোলাপ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- ডাল-পালা ছাঁটাইকরণ (Prunning): গোলাপের নতুন ডালে বেশি ফুল হয়। তাই পুরাতন ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করা প্রয়োজন। প্রতিবছর গোলাপ গাছের ডালপালা ছাঁটাই করলে গাছের গঠন কাঠামো সুন্দর ও সুদৃঢ় হয় এবং অধিক হারে বড় আকারের ফুল ফোটে।
- ফুলের কুড়ি ছাঁটাই: অনেক সময় ছাঁটাই করার পর মূলগাছের ডালে অনেক কুঁড়ি জন্মায়। সবগুলো কুঁড়ি ফুটতে দিলে ফুল তেমন বড় হয় না। তাই বড় ফুল ফোটার জন্য মাঝের কুঁড়ি রেখে পাশের কুঁড়িগুলো ধারালো চাকু দিয়ে কেটে দিতে হয়।
চ) পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা
গোলাপ গাছে যেসব পোকা দেখা যায় তন্মধ্যে রেড স্কেল ও বিটল প্রধান।
i) রেড স্কেল
- এ পোকা দেখতে অনেকটা মরা চামড়ার মতো।
- গরমের সময় বর্ষাকালে এর আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হয়।
- এ পোকা গাছের বাকলের রস চুষে খায়। ফলে বাকলে ছোট ছোট কালো দাগ পড়ে।
- প্রতিকার না করলে আক্রান্ত গাছ মারা যায়।
- গাছের সংখ্যা কম হলে দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আক্রান্ত স্থানে ব্রাশ করলে পোকা পড়ে যায়।
- ম্যালাথিয়ন বা ডায়াজিনন জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়।
ii) বিটল পোকা
- শীতকালের শেষে এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
- এ পোকা গাছের কচি পাতা ও ফুলের পাপড়ি ছিদ্র করে খায়।
- সাধারণত রাতের বেলা আক্রমণ করে।
- আলোর ফাঁদ পেতে এ পোকা দমন করা যায়।
- ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায়।
ছ) রোগ ব্যবস্থাপনা
গোলাপ গাছে অনেক রোগ হয়। তন্মধ্যে কালো দাগ পড়া রোগ, ডাইব্যাক ও পাউডারি মিলডিউ প্রধান।
i) কালো দাগ পড়া রোগ
- এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ।
- রোগাক্রান্ত গাছের পাতায় গোলাকার কালো রঙের দাগ পড়ে। আক্রান্ত গাছের পাতা ঝরে গিয়ে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায়।
- চৈত্র থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত এ রোগের আক্রমণ ঘটে।
- এ রোগের প্রতিকারের জন্য গাছে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
- গাছের গোড়ায় যেন পানি জমে না থাকে সে দিকে খেয়াল করতে হবে।
- এ ছাড়া ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায়। আক্রান্ত পাতাগুলো কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।
ii) ডাইব্যাক
- ডাল ছাঁটাইয়ের কাটা স্থানে এ রোগ আক্রমণ করে।
- এ রোগ হলে গাছের ডাল বা কাণ্ড মাথা থেকে কালো হয়ে নিচের দিকে মরতে থাকে।
- এ লক্ষণ ক্রমে কাণ্ডের মধ্য দিয়ে শিকড় পর্যন্ত পৌঁছে এবং সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়।
- এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত কাগু বা ডালের বেশ নিচ থেকে কেটে পুড়ে ফেলতে হবে।
- ডাল ছাঁটাইয়ের চাকু জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ডাল ছাঁটাই করা উচিত। কর্তিত স্থান স্পিরিট দিয়ে মুছে দিতে হবে।
iii) পাউডারি মিলডিউ
- এটি একটি ছত্রাক জনিত রোগ।
- শীতকালে কুয়াশার সময় এ রোগের বিস্তার ঘটে।
- এ রোগে আক্রান্ত হলে পাতা, কচিফুল ও কলিতে সাদা পাউডার দেখা যায়। ফলে কুঁড়ি না ফুটে নষ্ট হয়ে যায়।
- এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত ডগা বা পাতা তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে।
- এছাড়া থিওভিট বা সালফার, ডাইথেন এম-৪৫ যে কোনো একটি পানিতে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।
জ) ফুল সংগ্ৰহ
- ফুল ফোটার পূর্বেই গাছ হতে ফুল সংগ্রহ করতে হয়।
- সংগ্রহের পর ফুলের ডাটার নিচের অংশ পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখলে ফুল ভালো থাকে।
- মাঝে মাঝে ফুলে পানির ছিটা দেওয়া ভালো।
(২) বেলি ফুল চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশের অধিকাংশ উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ফুলের তোড়া, ফুলের মালাতে সুগন্ধীফুল হিসাবে বেলির কদর আছে। উৎসব ও অনুষ্ঠানে বেলিফুল ব্যবহৃত হয়। এটি একটি অর্থকরী ফুল।
ক) জাত
তিন জাতের বেলি ফুল দেখা যায়। যথা-
- সিঙ্গেল ধরনের ও অধিক গন্ধযুক্ত।
- মাঝারি আকার ও ডবল ধরনের।
- বৃহদাকার ডবল ধরনের
খ) বংশ বিস্তার
বেলি ফুলে গুটি কলম, দাবা কলম ও ডাল কলম পদ্ধতির মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়।
গ) জমি চাষ ও সার প্রয়োগ
- বেলে মাটি ও ভারী এঁটেল মাটি ব্যতীত সব ধরনের মাটিতে বেলি ফুল চাষ করা যায়।
- জমিতে পানি সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকা ভালো।
- জমি ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরা ও সমান করতে হবে।
- জমি তৈরির সময় জৈব সার, ইউরিয়া, ফসফেট এবং এমওপি প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রায় ১ মিটার অন্তর চারা রোপণ করতে হবে।
- চারা লাগানোর পর ইউরিয়া প্রয়োগ করে পানি সেচ দিতে হবে।
ঘ) কলম বা চারা তৈরি
- গ্রীষ্মের শেষ হতে বর্ষার শেষ পর্যন্ত বেলি ফুলের কলম বা চারা তৈরি করা যায়।
- চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি হতে হবে।
- চারা লাগনোর জন্য গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটি রোদ লাগিয়ে, জৈব সার ও কাঠের ছাই গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
- এরপর প্রতি গর্তে বেলির কলম বসাতে হবে।
- বর্ষায় বা বর্ষার শেষের দিকে কলম বসানোই ভালো। তবে সেচের ব্যবস্থা ভালো হলে বসন্তকালেও কলম তৈরি করা যায়।
ঙ) টবে চারা লাগানো
- জৈব পদার্থ যুক্ত দোআঁশ মাটিতে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার পরিমাণমতো মিশিয়ে টবে বেলি ফুলের চাষ করা যায়।
- টব ঘরের বারান্দা বা ঘরের ছাদে রেখে দেওয়া যায়।
চ) পরিচর্যা
i) সেচ দেওয়া
- বেলি ফুলের চাষে জমিতে সবসময় রস থাকা দরকার।
- গ্রীষ্মকালে ১০-১২ দিন পর পর, শীতকালে ১৫-২০ দিন পর পর ও বর্ষাকালে বৃষ্টি সময়মতো না হলে জমির অবস্থা বুঝে ২-১ টি সেচ দেওয়া দরকার।
ii) আগাছা দমন
- জমি বা টব থেকে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- খড় কেটে কুচি করে জমিতে বিছিয়ে রাখলে সেচের প্রয়োজন কম হয় এবং আগাছাও বেশি জন্মাতে পারে না।
iii) অঙ্গ ছাঁটাইকরণ
- প্রতিবছরই বেলি ফুলের গাছের ডাল-পালা ছাঁটাই করা দরকার। শীতের মাঝামাঝি সময় ডাল ছাঁটাই করতে হবে।
- মাটির উপরের স্তর থেকে ৩০ সেমি উপরে বেলি ফুলের গাছ ছাঁটাই করতে হবে।
- অঙ্গ ছাঁটাইয়ের কয়েকদিন পর জমিতে বা টবে সার প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা
- বেলি ফুল গাছে ক্ষতিকারক কীট তেমন দেখা যায় না। তবে মাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। এদের আক্রমণে পাতায় সাদা আস্তরণ পড়ে, আক্রান্ত পাতাগুলো কুঁকড়ে যায় ও গোল হয়ে পাকিয়ে যায়। গন্ধক গুঁড়া বা গন্ধক ঘটিত মাকড়নাশক যেমন- সালট্যাফ, কেলথেন ইত্যাদি পাতায় ছিটিয়ে মাকড় দমন করা যায়।
- বেলি ফুলের পাতায় হলদে বর্ণের ছিটে ছিটে দাগযুক্ত এক প্রকার ছত্রাক রোগ দেখা যায়। ট্রেসেল-২ প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায়।
জ) ফলন
- ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গাছে ফুল ফোটে। ফলন প্রতি বছর বাড়ে। লতানো বেলিতে ফলন আরও বেশি হয়।
- সাধারণত ৫-৬ বছর পর গাছ কেটে ফেলে নতুন চারা লাগানো হয়।
[সূত্র: এনসিটিবি]