Skip to content

গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি

গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি

গলদা চিংড়ি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ। দেশের প্রায় সকল এলাকার স্বাদুপানির জলাশয় গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে বিধায় গলদা চিংড়ি চাষ যথেষ্ট লাভজনক। পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি ও ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি উভয় উপায়ে চিংড়ি মাছের চাষ করা হয়।

দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু ধানের জমিতে ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। ঘের হলো অপেক্ষাকৃত নিচু ধানের জমি যার চারপাশে উঁচু জমি থাকে অথবা মাটির শক্ত বাঁধ থাকে। বর্ষাকালে ঘের পানিতে ভরে যায় বলে এই মৌসুমে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। ঘেরে এপ্রিল-মে বা বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে ধান কাটার পর গলদা চিংড়ির চাষ করা হয় অর্থাৎ ঘেরে প্রথমে ধান চাষের পর সেখানে চিংড়ি চাষ করা হয়। আবার চিংড়ি আহরণ করার পর সেখানে ধান চাষ করা হয়।

বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে গলদা চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অনেক নিচু জমি রয়েছে যেখানে শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষ হয় কিন্তু বর্ষাকালে সেগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এসব জমিতে চিংড়ির চাষ করে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যায়।

এ পাঠ শেষ অবধি পড়লে আপনি- পুুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি এবং ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি, উভয় প্রকার গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি শিখতে পারবেন।

(১) পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি

চিত্র- গলদা চিংড়ি
চিত্র- গলদা চিংড়ি

স্বাদু পানিতে যে চিংড়ি চাষ করা হয় তাকে গলদা চিংড়ি বলা হয়।

বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের প্রায় সবর্ ত্রই গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়। প্রজনন মৌসুমে এরা অল্প লবণাক্ত পানিতে ডিম ছাড়ার জন্য চলে আসে।

পুকুর, দিঘি, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওর ইত্যাদি জলাশয়ে এককভাবে কিংবা রুই জাতীয় মাছের সাথে পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতির ব্যবহার করে চিংড়ি মাছের চাষ করা যায়। তাছাড়া আমাদের বাংলাদেশে ধানক্ষেতেও বর্তমানে গলদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়েছে।

পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য জন্য পুকুরের গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়। যেকোনো আকারের পুকুরে এ চিংড়ি চাষ করা যায়। তবে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে আয়তাকার পুকুরে চিংড়ি চাষ করা অধিকতর উপযোগী।

ক) গলদা চিংড়ির পোনা

চিত্র- গলদা চিংড়ির পোনা
চিত্র- গলদা চিংড়ির পোনা
  • বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী বিশেষ করে মোহনার সাথে সংযুক্ত নদীর নিচু অঞ্চলে যেখানে জোয়ারভাটার প্রভাব বিদ্যমান সেখান থেকে মার্চ হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে গলদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়।
  • এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্থাপিত মৎস্য হ্যাচারিগুলোতে মার্চ হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়।
  • সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক উভয় ভিত্তিতেই গলদার পোনা শনাক্ত করা যায়। আমাদের বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উৎস হতে সাধারণত তরুণ (Juvenile) গলদার পোনা সংগৃহীত হয়। এদের শনাক্ত সহজতর। এদের গায়ে কালো ফোটা এবং মাথার ক্যারাপেসে বা খোলসে কালো দাগ থাকে। শিরবক্ষের খোলসে লম্বালম্বি কয়েকটি রেখা থাকে। লার্ভার আকার বড় হলে উদর খ-কের সংযোগস্থলে নীল বর্ণের ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়।
  • বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা লার্ভা অবস্থা হতে পোস্ট লার্ভা পর্যায় পর্যন্ত এদের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

খ) চাষ পদ্ধতি

আমাদের বাংলাদেশে সনাতন, উন্নত হালকা এবং আধানিবড়ি চাষ পদ্ধতিতে পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়।

তবে উন্নত হালকা গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পূর্বে পুকুরের স্থান নির্বাচন, মাটি ও পানির গুণাগুণ, ক্ষতিকর প্রাণি নিয়ন্ত্রণ, পানি ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাটি ও পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য চুন, সার ও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।

এ উন্নত হালকা গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে পুকুরে হেক্টর প্রতি ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টি গলদার পোনা ছাড়া সম্ভব। পুকুরের আয়তন ০.৫ হেক্টর থেকে ৫ হেক্টর এবং আকৃতি আয়তাকার হলে উত্তম হয়।

গ) স্থান নির্বাচন

  • প্রাকৃতিক উৎস, যেমন- নদ-নদী, খাল-বিল অথবা গভীর-অগভীর নলকূপ, হস্তচালিত নলকূপের সাহায্যে পরিমাণ মত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় এমন স্থানকে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য নির্বাচন করা উচিত।
  • খামারের জমির উপরিভাগ প্রায় সমতল বা একদিকে সামান্য ঢালু হলে ভালো হয়।

ঘ) মাটির গুণাগুণ

এঁটেল, দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উত্তম। এ ধরনের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা অধিক এবং এ মাটি দিয়ে সহজেই পুকুরের বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব। ৫ থেকে ৬.৫ পিএইচ (PH) যুক্ত মাটি চিংড়ি চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।

ঙ) পানির গুণাগুণ

পানির গুণাগুণের ওপর চিংড়ির উৎপাদন অনেকাংশে নির্ভরশীল। চিংড়ির কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়ার জন্য পানির গুণাগুণ নিম্নরূপ হওয়া প্রয়োজন।

পানির স্বচ্ছতা:২৫-৩৫ সে.মি.
তাপমাত্রা:১৮-৩৪ সে.
দ্রবীভূত অক্সিজেন:৫.৪ মি.গ্রা /লিটার
পানির পিএইচ (pH): ৭.৮৫
লৌহ:১.০ মি.গ্রাম/লিটার
পানির লবণাক্ততা:০-৪ পিপিটি

চ) পুকুর প্রস্তুতি

গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে পুকুরের উর্বরতা বৃদ্ধি, চিংড়ি পোনার যথাযথ বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার হ্রাস করা, রাক্ষুসে প্রাণী দমন প্রভৃতির জন্য পুকুর প্রস্তুতকরণ একান্ত অপরিহার্য। 

পুকুর প্রস্তুতকরণের ধাপগুলো নিচে দেওয়া হলো-

  1. পুকুরের তলদেশ শুকানো: চিংড়ি চাষ আরম্ভ করার পূর্বের  সম্পূর্ণ পানি পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। অতঃপর পুকুরের তলদেশে ২-৫ সপ্তাহ সূর্যালোকে শুকাতে হবে। পুকুরের তলদেশের এবং পাড়ের সমস্ত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে।
  2. রাক্ষুসে মাছ দমন: পুকুর শুকিয়ে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ এবং ক্ষতিকর প্রাণী (শামুক, ঝিনুক) ইত্যাদি দূর করা যায়। যেসব পুকুর কোনক্রমেই শুকানো যায় না সেসব পুকুরে জাল টেনে বা ওষুধ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে মাছ ও ক্ষতিকর প্রাণী দূর করতে হবে। ৩-৫ পিপিএম রোটেনন পুকুরে প্রয়োগ করে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ ধ্বংস করতে হবে। তাছাড়া পানি প্রবেশ ও নিষ্কাশন গেটে ০.৫-১০.০০ মি.মি. ফাঁক বিশিষ্ট নাইলনের জাল স্থাপন করে রাক্ষুসে মাছের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে হবে। গলদা চিংড়ির একক চাষে পোনা মজুদের পরেও রোটেনন ও টি সীডকেক দিয়ে রাক্ষুসে মাছ দমন করা সম্ভব।
  3. চুন প্রয়োগ: মাটির উর্বরতা শক্তির ওপর চিংড়ির উৎপাদন নির্ভরশীল। তাই মাটিকে শোধন ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যে পুকুরে চুন প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত পুকুরের প্রতি শতাংশে ১.০-১.৫ কেজি চুন গুড়া করে অথবা পানিতে গুলে পুকুরের তলদেশে বা পাড়ে ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হয়। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর ৫-১০ সে.মি. পানি নার্সারিতে ঢুকাতে হয়। তবে চুন প্রয়োগের মাত্রা পিএইচ-এর ওপর নির্ভরশীল।
  4. সার প্রয়োগ: চুন প্রয়োগের পরে পুকুরে পানি ঢুকিয়ে ৫-৭ দিন অপেক্ষা করতে হয়। অতঃপর হেক্টর প্রতি ৩০০ কেজি গোবর, ২৫ কেজি ইউরিয়া, ১২ কেজি টিএসপি, ৫ কেজি পটাশ সার সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে আরও পানি মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ভালোভাবে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই পানির গভীরতা ৪০-৫০ সে.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি করে ১ সপ্তাহ রাখা উচিত।
See also  বাগদা ও গলদা চিংড়ির পার্থক্য, বাগদা ও গলদা চিংড়ি মাছের বৈশিষ্ট্য, বাগদা ও গলদা চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম এবং বাংলাদেশে চিংড়ি মাছ চাষের সম্ভাবনা

ছ) পোনা মজুদ

চিংড়ি খামারের মাটির উর্বরতা, পানির গুণাগুণ, সম্পূরক খাবার প্রয়োগ ও পানির ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে পুকুরের পোনা মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। উন্নত হালকা চাষ পদ্ধতিতে একক গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১০,০০০-৫০,০০০টি পোনা ছাড়া সম্ভব।

জ) পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

পোনা মজুদের পর খুব সাবধানতার সাথে নিয়মিতভাবে এর পরিচর্যা করতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা ও সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

ঝ) সার প্রয়োগ

  • প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদানের জন্যে পুকুরে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি সার দেয়া দরকার। রুই জাতীয় মাছ চাষের মতই একই নিয়মে গলদা চিংড়ির পুকুরে সার ব্যবহার করতে হয়।
  • প্রতি বছরে ১০০-১৫০ কেজি ইউরিয়া, ৫০-৭০ কেজি টিএসপি এবং ৩০০০-৪০০০ কেজি গোবর এর পর সরবরাহ করতে হয়। এসব সার মাসিক ভাগ করে দুই কিস্তিতে, দুই সপ্তাহ পর পর পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
  • শীতকালে পুকুরে সার দেয়ার প্রয়োজন নেই। পুকুরে অতিরিক্ত প্ল্যাঙ্কটন জন্মালে সার ও খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে।

ঞ) পানি ব্যবস্থাপনা

  • চিংড়ির সন্তোষজনক কাঙ্খিত উৎপাদনের লক্ষ্যে পুকুরের সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। পুকুরের পানির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা দরকার।
  • উন্নত হালকা চাষপদ্ধতিতে পুকুরের পানির গভীরতা ১.২-১.৫ হওয়া উচিত। মজুদকৃত পানি মাসে ২ বার ৪০-৫০% পরিবর্তন করতে হয়। মাঝে মাঝে পুকুরে জাল টেনে ও বাঁশ পিটিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। পানির স্বচ্ছতা ২৩-৪০ সে.মি. হওয়া উত্তম।
  • সুষ্ঠুভাবে পানি ব্যবস্থাপনার ফলে কাঙ্খিত উৎপাদন সম্ভব।

ট) পুকুর পর্যবেক্ষণ

পুকুরে চিংড়ি বেঁচে থাকার হার, দৈহিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রোগ বালাই ইত্যাদি নিরূপণ ও শনাক্তকরণের জন্যে নিয়মিতভাবে পুকুর পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

রোগবালাই প্রতিরোধের ও চিংড়ির কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিচে উল্লেখিত কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে কি-না তা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

  1. সঠিক পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা।
  2. পুকুরে অতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
  3. উন্নত মানের সম্পূরক খাদ্য নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ করা।
  4. পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাবলি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  5. পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের স্বল্পতা ও আধিক্য যেন না হয় তা পর্যবেক্ষণ করা।
  6. চিংড়ি নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করছে কি-না এবং রোগাক্রান্ত হয়েছে কি-না তা পরীক্ষা করা।
  7. নির্দিষ্ট সময় পরপর পুকুরের পানি সঠিক মাত্রায় পরিবর্তন করা।

ঠ) চিংড়ি আহরণ

গলদা চিংড়ির ওজন যখন গড়ে ৮০ গ্রাম-এর উপর হয় তখন আহরণের উপযুক্ত সময়। এ অবস্থায় ১০-১৫টি চিংড়ির ওজন ১ কেজি হয়ে থাকে।

আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় গলদা চিংড়ি আহরণ করা হয়।

চাষের পদ্ধতি ভেদে গলদা চিংড়ির আহরণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।

  1. গুণগত চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ: এ পদ্ধতিতে একই সময়ে একই বয়সের পোনা পুকুরে মজুদ করা হয়। ৬-৭ মাস বয়সের চিংড়িগুলো বিক্রয়যোগ্য হলে জাল দিয়ে বড় চিংড়িগুলো ধরা হয়ে থাকে। রেণু পুকুরের সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করে বাকি চিংড়ি ধরা হয়। গলদা চিংড়ির মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিকে আংশিক আহরণও বলা হয়।
  2. অনবরত চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ: এ পদ্ধতিতে পুকুরে পোনা মজুদের ৫-৬ মাস পর চিংড়ি বাজারজাতকরণের উপযুক্ত হয়। এ অবস্থায় প্রতি মাসে জাল দিয়ে বড় চিংড়ি আহরণ করে আবার সমান সংখ্যক পোনা পুকুরে মজুদ করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ করা সুবিধাজনক।
  3. সম্পূর্ণ আহরণ: গলদা চিংড়ির একক চাষ, মিশ্র চাষ কিংবা ধানক্ষেতে সকল ক্ষেত্রেই এ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ করা যায়। এ ধরনের আহরণের ক্ষেত্রে চিংড়ির আকার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তাই সবগুলো চিংড়ির গ্রেড একই রকম হয় না। এ পদ্ধতিতে চিংড়িগুলোকে দীর্ঘদিন জলাশয়ে রাখতে হয়। এ পদ্ধতিতে সবগুলো চিংড়ি একসাথে বিক্রি করার ফলে চাষীর মূলধন বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ থাকে।

(২) ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি

বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত নিচু ধানের জমিতে ঘের পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি প্রয়োগ চাষ করা যায়।

অনুকূল জলবায়ু মাটি ও পানির কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অন্যতম গলদা চিংড়ি উৎপাদনকারি দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

ঘের হলো নিচু ধানের জমি যার পাশে উঁচু জমি থাকে অথবা মাটির শক্ত বাঁধ থাকে। বর্ষাকালে এসব ঘের পানিতে ভরে যায় ফলে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। তাই উক্ত সময়ে চিংড়ি চাষ করা হয়।

বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা রোধ ও জলচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রনে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেসব বাঁধের ভিতরে ঘের তৈরি করে সহজেই গলদা চিংড়ি চাষ করা যায়। 

নিম্নে ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতির ধাপ বর্ণনা করা হলো-

ক) স্থান নির্বাচন

নিচু অঞ্চলে বর্ষাকালে ৫-৬ মাস ১-২ মিটার পানি থাকে বা ঘের করে পানি আটকিয়ে রাখা যায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। ঘের এলাকা বন্যামুক্ত হতে হবে।

খ) ঘেরের বৈশিষ্ট্য

একটি ঘেরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকলে তা গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা যায়-

  1. গলদা চিংড়ি চাষের জন্য নির্বাচিত ঘেরে ৪-৬ মাস ৩.০-৪.০ ফুট উচ্চতার পানি ধরে রাখার সুবিধা থাকতে হবে।
  2. ঘেরের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি থাকতে হবে যাতে ঘের তাড়াতাড়ি শুকিয়ে না যায়।
  3. সাধারণত দোআঁশ বা বেলে-দোআশ মাটির ঘের গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত।
  4. ঘের একটু নিচু জায়গায় হলে পানি ধরে রাখতে সুবিধা হয়।
  5. ঘেরে বন্যার পানি যেন প্রবেশ না করতে পারে এবং বন্যা বা বৃষ্টির পানিতে বাঁধ যেন প্লাবিত না হয়। নিচু ঘেরের বাঁধ উঁচু করে বেঁধে বন্যামুক্ত করে চিংড়ি চাষের উপযুক্ত করা যায়।
  6. ঘেরের আকার ৩০-১০০ শতাংশ হলে ব্যবস্থাপনার জন্য সুবিধা হয়।
  7. ঘেরে যথেষ্ট সূর্যালোক পড়তে হবে।
  8. ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি বাজারজাত করার সুবিধা থাকতে হবে।
See also  চিংড়ি চাষে সফল হতে উক্ত চিংড়ি মাছের পরিবহন, সংরক্ষণ/প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি ও বাজারজাতকরণ পক্রিয়া সম্পর্কে জানাও জরুরি

গ) ঘের নির্মাণ

ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে ঘের আগাছা ও শ্যাওলামুক্ত হতে হবে। নালা থেকে পানি নিষ্কাশন করে কাদা অপসারণের পর তা রৌদ্রে শুকাতে হবে। নালা ও জমিতে চাষ দিতে হবে এবং ধানের গোড়া অপসারণ করতে হবে।

ঘেরের মাটির pH ৬ এর উপর হতে হবে। সুষ্ঠু ঘের ব্যবস্থাপনার জন্য ঘের এর আয়তন ২-১০ হে. হলে ভালো হয়। ঘের বর্গাকার বা আয়তাকার এবং চারদিকের বাঁধ মজবুত থাকতে হবে। পানির গভীরতা ১ মিটার হতে হবে।

i) বাঁধ নির্মাণ

  • ঘেরের চারপাশে বাঁধ বা উঁচু জমি না থাকলে সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে নিতে হবে। যে সব ঘেরের বাঁধ বা চারপাশের জমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় না তেমন ঘের নির্বাচন করতে হবে।
  • বাঁধ ভাঙ্গা থাকলে তা মেরামত করতে হবে।
  • বাঁধ যথেষ্ট শক্ত হতে হবে যাতে পানির চাপে ভেঙ্গে না যায় এবং চিংড়ি বের হয়ে যেতে না পারে।
  • বাঁধ যথেষ্ট উঁচু হওয়া উচিত যাতে বন্যার পানি সেখানে প্রবেশ না করতে পারে।
  • বাঁধ যথেষ্ট প্রশস্ত করে তাতে শাকসবজির চাষ করা যেতে পারে।

ii) নালা খনন

  • চিংড়ির চলাচল এবং অবস্থানের সুবিধার্থে ঘেরে নালা খনন করতে হবে।
  • নালা খননের ফলে এতে সবসময় পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়।
  • অত্যধিক গরমের সময় চিংড়ি নালায় এসে আশ্রয় নিতে পারে।
  • ঘেরে যখন ধান চাষ হয় তখন নালা নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
  • ঘেরের মাটি এবং জমির উপরিপৃষ্ঠের ধরনের উপর ভিত্তি করে ঘেরের চতুর্দিকে, মাঝখানে অথবা যে কোনো এক বা দুই পাশে নালা খনন করা যায়।
  • বাঁধের ভিতরে জমির সমতা বা ঢাল অনুসারে নালা খনন করতে হবে। নালার দৈর্ঘ্য হবে ঘেরের আয়তনের অনুপাতে। নালার প্রস্থ কমপক্ষে ৪-৬ ফুট এবং সমতল এলাকা থেকে গভীরতা ১.৫-২.০ ফুট হলে ভাল।

iii) পানি নির্গমন পথ তৈরি

  • বর্ষাকাল বা অন্য যে কোনো কারণে যদি ঘের পানিতে পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার জন্য বাঁধে পানি নির্গমন পথ তৈরি করতে হবে।
  • চিংড়ি যাতে বের হয়ে যেতে না পারে সে জন্য নির্গমন পথের মুখে জাল বা বাঁশের বানা স্থাপন করতে হবে।

গ) ঘের প্রস্তুতি

  • ঘের পুরাতন হলে পরিষ্কার ও প্রয়োজনীয় মেরামত করে প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনে ঘের সেচে ফেলে রুক্ষুসে মাছ ও তলার অতিরিক্ত কাঁদা অপসারণ করে রোদ লাগাতে হবে। নালা যদি শুকানো সম্ভব না হয় তবে রোটেনন বা অন্য কোন বিষ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত জলজ প্রাণী দূর করতে হবে। অতঃপর তলদেশে চাষ দিয়ে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • নালা ও সমস্ত জমিতে ১ কেজি/শতাংশ হিসাবে চুন প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে এবং নালার জৈব সার হিসেবে প্রতি শতাংশে ৫-৬ কেজি গোবর, অথবা ৮-১০ কেজি কম্পোষ্ট অথবা ৩-৫ কেজি হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা) প্রয়োগ করতে হবে এবং তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • ধানকাটার পর ঘের সাধারণত আস্তে আস্তে বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। তবে নালা শুকনোর পর তাতে জুভেনাইল (চিংড়ি পোনা) মজুদ করতে চাইলে অন্যান্য উৎস, যেমন-ডিপ টিউবয়েল, আশপাশের নদী,খাল, দীঘি ইত্যাদি থেকে পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • ঘেরের বাঁধে সূর্যালোককে বাধাদানকারী গাছপালা থাকলে তা অপসারণ বা ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। নালা যদি শুকনো সম্ভব না হয় তবে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • ঘের পানিতে পূর্ণ হলে তাল, নারিকেল ও খেজুরের পাতা, বাঁশের কঞ্চিসহ আগালি, প্লাস্টিকের ভাঙ্গা পাইপ ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে জুভেনাইলের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ) চিংড়ি চাষের সময়

ডিসেম্বর ফ্রেব্রুয়ারি এই সময়ের মধ্যে ঘের প্রস্তুতসহ চুন ও জৈবসার প্রয়োগ এবং পানি সরবরাহ করে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পোনা মজুদ করতে হবে।

ঙ) নার্সারিতে পোনা লালন

  • প্রাকৃতিক উৎস বা হ্যাচারির পোনা নার্সারি পুকুর বা পেনে ২-৬ সপ্তাহ পালন করে ঘেরে ছাড়লে মৃত্যুর হার কম হয়। এক্ষেত্রে পুকুরের প্রতি শতাংশে ২০০০-৪০০০ টি পোষ্ট লার্ভা মজুদ করে ২-৬ সপ্তাহ পালন করতে হয়। প্রতিদিন ৪ বার খাদ্য দিতে হয়। পোনা ৪-৫ সে. মি. হলে ঘেরে ছাড়তে হবে।
  • গলদা চিংড়ির পোনাকে পিএল (post larvae) বলা হয় এবং অপেক্ষাকৃত বড় পোনাকে জুভেনাইল বলা হয়। ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে জুভেনাইল-এর আকার একটু বড় হতে হবে এবং তা কমপক্ষে ৪-৫ সে. মি. আকারের হলে ভাল হয়।
  • নার্সারী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পিএল থেকে জুভেনাইল তৈরি করে তা ঘেরে ছাড়তে হবে। ঘেরের নালা বা নালার একটি অংশ অথবা আলাদা ছোট পুকুর নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
  • ঘেরে জুভেনাইল মজুদ হার নির্ভর করে চাষ পদ্ধতি, চাষের সময়কাল, জুভেনাইলের প্রাপ্যতা, মাটি ও পানির গুণাগুণ, ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল ইত্যাদির উপর। যদি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করা হয় তবে মজুদ ঘনত্ব কম হবে, তৈরি খাদ্য সরবরাহ করলে মজুদ ঘনত্ব বেশি হবে, পাশাপাশি পানি পরিবর্তন ও বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা থাকলে মজুদ ঘনত্ব আরও বেশি হবে।
  • তৈরি খাদ্য সরবরাহ করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৬০টি জুভেনাইল ছাড়তে হবে। অতিরিক্ত প্লাংকটন নিয়ন্ত্রণের জন্য শতাংশ প্রতি ২-৪টি সিলভার কার্প এবং কাতলার পোনা ছাড়তে হবে।
  • জুভেনাইল ছাড়ার আগে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মে-জুলাই মাসে জুভেনাইল ছাড়তে হয়। এ সময় জমিতে ২-৩ ফুট পানি থাকলে ভাল হয়। জমিতে পানি না থাকলে ঘেরের নালায় জুভেনাইল ছাড়তে হবে।
  • অনেক সময় ঘেরের নালা বা নালার অংশ নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। নালায় পিএল লালন করার পর বৃষ্টিতে যখন নালা পরিপূর্ণ হয়ে পানি সারা ঘেরে ছড়িয়ে পড়ে তখন জুভেনাইলও সারা ঘেরে ছড়িয়ে পরে। এক্ষেত্রে কী পরিমাণ জুভেনাইল মজুদ করা হলো তা জানা সম্ভবপর হয় না। কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ঘেরে কী পরিমাণ জুভেনাইল ছাড়া হলো তা অবশ্যই জানা দরকার। তাই নালাতে উৎপাদিত জুভেনাইল অবশ্যই গণনা করে সারা ঘেরে ছাড়তে হবে।
See also  ধানের সাথে গলদা চিংড়ি চাষ পদ্ধতি

চ) পানির গুণাগুণ

জোয়ার বা প্রাকৃতিক উৎস থেকে সরবরাকৃত পানির pH ৭.৫-৭.৮, তাপমাত্রা ২৫০-৩০০ সে. এবং ক্ষারত্ব ১০০-১৬০ পিপিএম হলে ভালো হয়। পানির গভীরতা ১-১.৫ মিটার ও স্বচ্ছতা ২৫-৩০ সে.মি. হলে উত্তম।

ছ) সার প্রয়োগ

ঘেরে পানি সরবরাহের ৫-৭ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হয়। হেক্টর প্রতি ২০ কেজি গোবর, ১ কেজি ইউরিয়া ও ১ কেজি টিএসপি একত্রে মিশিয়ে পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পর পানির গভীরতা ৪০-৫০ সে.মি. বাড়াতে হবে।

জ) পোনা মজুদ

সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর ৫-৭ সে. মি. আকারের পোনা ছাড়তে হবে। প্রচলিত চাষ পদ্ধতিতে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ টি, আধা নিবিড় পদ্ধতিতে ২০০-৩০০টি ও নিবিড় পদ্ধতিতে ১০০০-২০০০টি পোনা ছাড়তে হবে।

ঝ) খাদ্য পরীক্ষা

ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্যে গলদা চিংড়ি চাষকালীন সময়ে পুকুরে ১৫ দিন পর পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৪ কেজি গোবর প্রয়োগ করতে হবে। তবে সার প্রয়োগের মাত্রা পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতির উপর নির্ভর করবে।

সার প্রয়োগের ২০-২৫ দিন পর ঘেরে চিংড়ির প্রাকৃতির খাদ্য আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে।

ঞ) সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ

ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে চিংড়ির বৃদ্ধির জন্য সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। 

নিম্নের তালিকা অনুসারে খাদ্য তৈরি করতে হবে-

ক্রমিক নংখাদ্য উপাদানের নামপরিমাণ (গ্রাম)
১.চালের কুঁড়া/গমের ভূষি৪০০-৬০০
২.খৈল (সরিষা/সয়াবিন/তিল)১০০-২০০
৩.ফিস মিল২০০-৩০০
৪.শামুক/ঝিনুকের গুড়া৯৫
৫.লবণ২.৫
৬.ভিটামিন মিশ্রণ২.৫

এছাড়াও শামুক ও ঝিনুকের মাংস, ছোট মাছ, মাছের ডিম, কেচোঁ ও মরা চিংড়ি প্রভৃতি খাবার দিতে হবে। তৈরিকৃত খাদ্য পুকুরে ছিটিয়ে বা ট্রেতে দলা বেঁধে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ট) সার প্রয়োগ

প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য ১৫ দিন পর পর সার প্রয়োগ করতে হবে। 

প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিম্নরূপ-

ক্রমিক নংসারের নামসারের পরিমাণ (একরে)
১.গোবর১৫ কেজি
২.ইউরিয়া৬ কেজি
৩.টিএসপি২.৫ কেজি
৪.এমপি১ কেজি

ইউরিয়া ব্যাতীত অন্যান্য সারগুলো একত্র করে তিনগুণ পানির সাথে মিশিয়ে পুকুরে ছিটাতে হবে। দানাদার ইউরিয়া সরাসরি ছিটাতে হবে।

ঠ) পানি ব্যবস্থাপনা

ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিতে চিংড়ির সঠিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে, বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে অক্সিজেন বাড়াতে হবে। চুন নিয়ে পানির স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে।

ড) রোগবালাই দমন ও অন্যান্য পরিচর্যা

  • ঘেরে চিংড়ির রোগবালাই, মৃত্যুহার ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। খোলস বদলানোর সময় আশ্রয় নেয়ার জন্য পুকুরে পাতাবিহীন ডালপালা পুঁতে দিতে হবে।
  • চিংড়ি ঘেরে ছাড়ার পর থেকে গলদা চিংড়ির বৃদ্ধির হার প্রথমে বেশি থাকে এবং পরবর্তীতে কমতে থাকে। চিংড়ি বেঁচে থাকার হার, দৈহিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, রোগ-বালাই ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের জন্য নালা থেকে ঝাঁকি জাল দ্বারা ৫-৭ বার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে। সকালে বা বিকালে এ কাজটি করতে হবে।
  • রোগলক্ষণ পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘের নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে এবং কোনো অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় রাখতে হবে। অতি বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে ঘেরের পানি দ্রুত বেড়ে গেলে নির্গমন নালার মাধ্যমে পানি বের করে নিতে হবে

ণ) চিংড়ি আহরণ

  • ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতির ব্যবহারে গলদা চিংড়ি ৬-৮ মাসেই আহরণের উপযোগী হয়। এ অবস্থায় ১০- ১৫টি চিংড়ির ওজন ১ কেজি হলে চিংড়ি সংগ্রহ করা ভালো।
  • অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ঘেরের পানি কমে গেলে চিংড়ি আহরণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে একর প্রতি ২০০-২৫০ কেজি উৎপাদন হয়ে থাকে।
  • বড় গ্রেডের প্রতি কেজি চিংড়ির মূল্য অপেক্ষাকৃত ছোট চিংড়ির তুলনায় অনেক বেশি বিধায় আহরণের পর কিছু চিংড়ি পুনরায় নালায় মজুদ করা হয় যাতে পরবর্তী মৌসুমে বৃদ্ধি পেয়ে বড় গ্রেডের চিংড়িতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকলে অধিকাংশ চিংড়ি মারা যেতে পারে।
  • চাষের শুরুতে আগের বৎসরের ওভার উইন্টার (বাড়তি মজুদের পোনা) করা জুভেনাইল মজুদ করলে এক মৌসুমেই বড় গ্রেডের চিংড়ি পাওয়া সম্ভব।

প্রিয় খামারী বন্ধুগণ, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমার বিস্তরভাবে পুুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি এবং ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি, উভয় প্রকার গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারলাম।

বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে গলদা ও বাগদা এই দুইটি প্রজাতির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। তবে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ওপর চিংড়ি চাষের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে চিংড়ি চাষকে সনাতন, উন্নত-হালকা, আধা-নিবিড় এবং নিবিড় পদ্ধতিতে ভাগ করা যায়।

স্বাদুপানির চিংড়ির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতি হলো গলদা চিংড়ি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পানি গলদা চিংড়ি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। গলদা চিংড়ি বাগদা চিংড়ির চেয়ে কম রোগাক্রান্ত হয়। সারাদেশের অসংখ্য পুকুর জলাশয়ের পাশাপাশি নিচু ধানক্ষেতে ধানের সাথে বা ধান কাটার পরে ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করে চিংড়ি চাষ করলে চিংড়ি মাছের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

[সূত্র: ওপেন স্কুল]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts